এখনো পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ: বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে চলছে খাদ্য সঙ্কট

স্টাফ রিপোর্টার : দেশের বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে চলছে মানবিক বিপর্যয়। কোনো কোনো এলাকায় বানের পানি কমলেও বেশিরভাগ এলাকা এখনো পানির নিচে। ৫০ হাজার থেকে শুরু করে কোনো কোনো জেলায় চার লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পাশাপাশি তলিয়ে গেলে ফসল, চাষের মাছ, বন্দি হয়ে পড়েছে গবাদিপশুও। তাছাড়া বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্য সঙ্কট। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে দ্রুত খাদ্য ও প্রায়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রি পৌঁছানোর দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। অন্যথায় না খেয়ে লাখ লাখ মানুষ আরো বড় ক্ষতির মধ্যে পড়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
ফের বিপৎসীমার ওপরে তিস্তার পানি : ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাড়ছে তিস্তা নদীর পানি। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় লালমনিরহাটের চারটি উপজেলার চরাঞ্চলগুলোতে আবারও বন্যা দেখা দিয়েছে। সঙ্গে তীব্র নদীভাঙন। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ১৫ হাজার পরিবার। শনিবার (৪ জুলাই) দুপুর ১২টায়ে তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর আগে সকাল ৬টায় বিপৎসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর, সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ব্যারাজ রক্ষার্থে ৪৪টি গেট খুলে দিয়ে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তিস্তার পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার) ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়নের স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত ৪০০ ফুট বালুর বাঁধটি হুমকির মুখে রয়েছে। প্রথম দফায় বন্যার কবল রক্ষা পেলেও এখন সেই বাঁধটিই ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
পানিবন্দি জামালপুরে ৪ লাখ মানুষ, খাদ্য সংকট তীব্র : জামালপুরে যমুনা নদীর পানি ধীর ধীরে কমতে শুরু করলেও বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বন্যায় মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। নতুন করে আরও দুই ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় জেলার আট পৌরসভা ও ৪৯টি ইউনিয়নের প্রায় চার লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিশুদ্ধ পানি ও চরম খাদ্য সংকটে পড়েছে বন্যা দুর্গতরা। জুলাইয়ের শুরুর দিকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী যমুনা নদীর পানি ১০ সেন্টিমিটার কমে শনিবার (৪ জুলাই) সকালে বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। যমুনার পানি কমতে থাকলেও জেলার পৌরসভাগুলোসহ ৪৯টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। পানিতে তলিয়ে আছে প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, ৪৫০টি গ্রামের কয়েক হাজার বসতবাড়ি। যোগাযোগের ব্যবস্থা না থাকায় পরিবার ও গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে মানুষ। বন্যার পানিতে ডুবে গেছে রান্না ঘর, শৌচাগার, গোয়াল ঘরসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। ভিজে গেছে ঘরের শুকনো ধান। বানভাসীদের এই মুহূর্তে শুকনো খাবারের বেশি প্রয়োজন।
সিরাজগঞ্জে দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি : একদিন বিরতি দিয়ে আবারও সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩ জুলাই সকাল থেকে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪৬ এবং কাজিপুর পয়েন্টে ৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নদী তীরবর্তী এলাকা ও চরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পাঁচ উপজেলার প্রায় ৩৩ ইউনিয়নের ২১৬টি গ্রামের ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৫৩ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে প্রায় ৩৫৬৫ হেক্টর জমির ফসল। অপরদিকে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পানিবন্দি মানুষ বিভিন্ন বাঁধের ওপর অশ্রয় নিচ্ছে। সেইসঙ্গে গবাদি পশু নিয়ে পড়েছেন বিপাকে।
ঠাকুরগাঁওয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত : উজানের ঢলে ঠাকুরগাঁওয়ে সবকটি নদ-নদীর পানি বাড়ছে। টাঙ্গন নদীর পানি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীর নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার গ্রামীণ সড়ক ডুবে গেছে। নিমজ্জিত হয়েছে পাট, ভুট্টা, সবজি ক্ষেত ও বীজতলা। ঠাকুরগাঁও পৌর শহরের জেলা শিল্পকলা একাডেমী ভবনে প্লাবিত এলাকার প্রায় কয়েক শতাধিক মানুষ তাদের পরিবার ও গবাদিপশু নিয়ে নিরাপদে থাকার জন্য আশ্রয় নিয়েছেন।
ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি এখনও বিপৎসীমার ওপরে : কুড়িগ্রামে কমতে শুরু করেছে নদনদীর পানি। ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চর ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় ঘরে ফিরতে পারছে না বানভাসীরা। দেড় সপ্তাহ যাবৎ বন্যার পানি অবস্থান করায় দুর্ভোগে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, চিকিৎসাসহ জ্বালানি ও গো-খাদ্যের সংকট। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চলতি বন্যায় ৩টি পৌরসভাসহ ৫৬টি ইউনিয়নের ৫৭৯টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়েছে ৬২ হাজার ৪শ’ মানুষ। নদীভাঙনে গৃহহীন হয়েছে ৫০০ শতাধিক পরিবার। ২৯.৫০ কিলোমিটার বাঁধ ও ৩৭ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও কৃষিতে আউশ, আমন বীজতলা, পাট, কাউন, তিল, শাকসবজিসহ বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯ হাজার ৭৮৯ হেক্টর ফসলি জমি।
ত্রাণ ‘দেয়া’ ‘না পাওয়ার’ চক্রে ক্ষতিগ্রস্তরা : কুড়িগ্রামে ত্রাণ নিয়ে সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়াও অপ্রতুল ত্রাণের কারণে প্রত্যন্ত এলাকায় হাহাকার অবস্থা বিরাজ করছে। উপজেলাগুলো থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে বরাদ্দ প্রদানের কথা বলা হলেও অনেক জনপ্রতিনিধি বরাদ্দ পাননি বলে জানিয়েছেন। বন্যার প্রায় দু’সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও অনেক জায়গায় পৌঁছায়নি বানভাসীদের জন্য পাঠানো ত্রাণসামগ্রী। ফলে এলাকায় ক্ষোভ বিরাজ করছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানিয়েছেন, ‘বন্যার শুরুতেই ২০৩ মেট্রিকটন চাল ও ৩৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকা উপজেলাগুলোতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ২ কোটি টাকা ও ২ হাজার টন চালের চাহিদা পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে আবারও ২ লাখ টাকা ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার পেয়েছি।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।