বাংলাদেশের নরম পলিমাটি, ভেজা বাতাস, মৌসুমি বৃষ্টিপাত, সারা বছরের রোদ এই দেশকে করেছে উর্বর। এই দেশে দেয়ালের ওপরে গাছ জন্মায়, নিরেট ছাদের বুকে জন্মায় অশ্বত্থ বৃক্ষ, পাথরের গায়ে জন্মায় লতা-গুল্ম শেওলা, এমনকি আমাদের জামাকাপড়ে ছাতা পড়ে, আমরা বলি তিলা পড়েছে। এই দেশ এমনি সুজলা-সুফলা। কিন্তু এই দেশ সবচেয়ে বেশি করে জন্মদান করেছে ঠক আর প্রতারকদের।
এই দেশে এত ঠক আর প্রতারক কেন? সম্ভবত বেশির ভাগ মানুষ সরল, সোজা, আলাভোলা, আয়োডিনের অভাবে স্বল্পবুদ্ধি বলে এদের মধ্য থেকেই আরেক দল লোক হয়ে উঠেছে প্রতারক, প্রতারকদের সম্রাট। কিংবা স্বল্প আয়তনের মধ্যে বেশিসংখ্যক মানুষ গিজগিজ করায় সার্ভাইভাল অব দ্য ফিটেস্টের মাঠে অস্তিত্বের সংগ্রামে কিছুসংখ্যক মানুষ বেছে নিয়েছে প্রতারণার কৌশল।
আমাদের লোকগল্পগুলো প্রতারণার কৌশল বন্দনায় মুখর। এক দেশে ছিল দুই ঠক। একজন আমপাতা নিল এক বস্তা। আরেকজন কলার বিচি নিল এক ঝোলা। রাস্তায় গাছের নিচে বসল দুজন। তোমার বস্তায় কী? তেজপাতা। তোমার বস্তায় কী? গোলমরিচ। দুজনেই বস্তা বদল করল। তারপর খুলে দেখে তেজপাতা নয়, আমপাতা। গোলমরিচ নয়, কলার বিচি। আমাদের টোনা আর টুনি পিঠা তৈরি করে সব পশুপাখিকে বলে, দুপুরের পর এসো, তোমাদেরও ভাগ দেব। দুপুরের মধ্যে খেয়েদেয়ে সাফসুতরো করে টোনা আর টুনি উড়ে গিয়ে আশ্রয় নিল গাছের মগডালে।
কিন্তু সব ঠকের সেরা ঠক ছিল ঠগিরা। এদের জন্য ইংরেজদের অভিধানে আলাদা শব্দ যুক্ত করতে হয়েছে। এই উপমহাদেশে ছিল এক ভয়াবহ সম্প্রদায়, ঠগি সম্প্রদায়। তারা ছিল গোপন এক কাল্ট। আঠারো বছর হলে কেবল পুরুষেরা তার সদস্য হতে পারত। তাদের কার্যক্রম এত গোপন ছিল যে বউ-ছেলেমেয়েরাও জানত না যে বাড়ির পুরুষটা আসলে কী করে। তারা মানুষের সঙ্গে মিশে তাদের বন্ধু হতো। তারপর সুযোগ পেলে একখণ্ড হলুদ কাপড় গলায় পেঁচিয়ে লোকটাকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলত। তার টাকাপয়সা সব লুটে নিয়ে লাশ পুঁতে ফেলত।
উইকিপিডিয়া বলছে, ‘ঠগি বিশেষ শ্রেণির দস্যু দল যারা পথিকের গলায় রুমাল বা কাপড় জড়িয়ে হত্যা করত। ঠগিরা ১৩ থেকে ১৯ শতকে বাংলায় এবং উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা হিন্দুদের দেবী কালীর পূজা করত। তাদের কথা প্রথম জানা যায় ১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানি লিখিত ফিরোজ শাহর ইতিহাস গ্রন্থে। ১৮৩০ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ভারতে প্রশাসক উইলিয়াম হেনরি শ্লিম্যানকে ঠগিদের নির্মূল করতে নির্দেশ দেন। হেনরি শ্লিম্যান কয়েক বছরের চেষ্টার ফলে ঠগিদের নির্মূল করতে সমর্থ হন। কিছু হিসাব অনুযায়ী, ১৭৪০ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত ঠগিরা ১০ লাখের বেশি মানুষ হত্যা করেছিল। ঠগিরা সাধারণত দলগতভাবে ব্যবসায়ী, তীর্থযাত্রীর কিংবা সৈন্যের ছদ্মবেশে ভ্রমণ করত এবং পথিমধ্যে অন্য তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে তাদের সঙ্গে মিশে যেত। তারপর তারা হঠাৎ করেই কোনো যাত্রাবিরতিতে ভ্রমণকারীদের গলায় হলুদ রঙের কাপড় পেঁচিয়ে হত্যা করত।’
এখন কোভিড–১৯ মহামারিকালে বাংলাদেশে আবারও দেখা দিয়েছে এক মারাত্মক ঠগির দল। অতীতের ঠগিরা ১০০ বছরে উপমহাদেশজুড়ে হত্যা করেছিল ১০ লাখ মানুষ, আর এই নব্য ঠগিরা ১০ সপ্তাহে মারতে চায় ১০ লাখ। এ জন্য তারা এক নতুন কায়দা বের করেছে। সাজিয়েছে হাসপাতাল, বানিয়েছে নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষার কেন্দ্র, তারা কোভিড-১৯ উপদ্রুত বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে নমুনা নেয়, হাজার হাজার টাকা নেয়, তারপর ইচ্ছেমতো কাউকে লিখে দেয় পজিটিভ, কাউকে নেগেটিভ। কোটি কোটি টাকা লোপাট করে কয়েক সপ্তাহে।
আমরা খবরের কাগজে আর ফেসবুকে ছবি দেখছি প্রতারকদের। একজনের নাম সাহেদ, দেখা যাচ্ছে তিনি বড় বড় সাইনবোর্ড লাগিয়ে রেখেছেন হাসপাতালের নামে, প্লট বিক্রির ব্যবসা করছেন, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়ে বাণীও দিচ্ছেন, টেলিভিশনের টক শোতে হাজির হচ্ছেন, সব রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হচ্ছেন এবং সব বড় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে–বসে ছবি তুলছেন।
এই দেশ কেবল রাশি রাশি ভারা ভারা ধান উৎপাদন করে না, রাশি রাশি প্রতারকও উৎপাদন করে। আমরা দেখেছি, নির্মাণকাজে ইস্পাতের বদলে দেওয়া হয়েছে বাঁশ, বালিশ দুয়ার থেকে তিনতলায় তুলতে খরচ ধরা হয়েছে হাজার হাজার টাকা, তিন শ টাকার পর্দার দাম ধরা হয়েছে লাখ টাকা। আমরা দেখেছি, নকল ক্যাপসুলের কারখানা, ক্যাপসুলের ভেতরে আটা ভরে বিক্রি করা হয়েছে অ্যাসিডিটির ওষুধ হিসেবে। আমরা জানি, জিনের বাদশাহর ফোন আসে, কথা বলে অন্যের পকেটের টাকা নিজের পকেটে পোরার প্রতারণাকে এই দেশের মানুষ অতি নিপুণ শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। আপনার নামে ভুল করে টাকা পাঠানো হয়েছে কিংবা আমি বিকাশ অফিস থেকে বলছি, এ ধরনের প্রতারক চক্রের খপ্পরে অনেকেই পড়েছেন। প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন আমাদের বিদেশগামী যুবকেরা।
সারা পৃথিবী যখন করোনার আক্রমণে পর্যুদস্ত, যখন প্রতিদিন মৃত্যুর খবর শুনতে শুনতে বুকটা কবরস্থান হয়ে গেছে, যখন কবে আমার পালা আসবে বলে প্রস্তুত হয়ে বসে আছি, তখন রিজেন্টের রাজকীয় প্রতারণায় আমাদের অধিক শোকে পাথর হওয়ার জোগাড়। রিজেন্ট কথাটার মানেও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কোনো রাজ্যে রাজা যদি অপ্রাপ্তবয়স্ক হয় কিংবা অকর্মণ্য হয়, তখন ওই রাজ্যে যে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়, সেই হলো রিজেন্ট। আমাদের রাজ্যে রিজেন্টের দৌরাত্ম্য দেখতে হচ্ছে কেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘প্রশ্ন’ কবিতায় প্রশ্ন করেছিলেন, ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো।’সবাইকে ক্ষমা করতে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত পারেননি। হুমায়ুন আজাদের কবিতা উচ্চারণ করি, যদি রাগ-ক্ষোভ-দুঃখ তাতে খানিকটা প্রকাশিত হয়:
যে তুমি ফোটাও ফুল,
বনে বনে গন্ধ ভরপুর;
সেই তুমি কেমন ক’রে বাঙলা
সে তুমি কেমন ক’রে…
দিকে দিকে জন্ম দিচ্ছো—
পালেপালে শুয়োর কুকুর…
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক