মুহাম্মাদ ওবায়দুল্লাহ*
মীর আব্দুস শুকুর আল মাহমুদ, যিনি আল মাহমুদ নামে সর্বাধিক পরিচিত, তিনি একজন কবি, ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্প লেখক,সাংবাদিক ও সম্পাদক। বিংশ শতাব্দীতে আবির্ভূত বাংলা ভাষার অন্যতম সেরা কবিদের একজন তিনি। আঞ্চলিক উপভাষার ব্যবহার, ভাষা আন্দোলনের ঘটনা, জাতীয়তাবাদ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিপীড়ন সামাজিক বৈষম্য ও ইসলামী অনুষঙ্গ এর মত বিষয় তার লেখায় ফুটে উঠে এসেছে।
তিনি ১৯৩৬ সালে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের নিকটস্থ মোরাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব ও মাধ্যমিক শিক্ষা দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর সংলগ্ন এই গ্রামে অতিবাহিত হয়। ১৯৫৪ সালে আল মাহমুদ একজন সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন । সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাস ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত বিখ্যাত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তার নাম সুপরিচিত হয়ে ওঠে এবং তাকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়।
১৯৬৩ সালে তার প্রথম কাব্য গ্রন্থ লোক-লোকান্তর প্রকাশিত হয় । ১৯৬৬ সালে সোনালি কাবিন পাঠক ও সমালোচকদের মধ্যে বেশ আলোচিত হয়, যা তাকে খ্যাতির শিখরে নিয়ে যায়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি ছোটগল্প এবং উপন্যাস লিখে তার প্রতিভা অসাধারণ এবং বহুমুখী তা প্রমাণ করেন।
তিনি তার কবিতায় যুগের চেতনা ধারণ করেছেন, একই সাথে উদ্ভিদ ও প্রাণী, নদী ও নারী, নতুন এবং বাংলার ঐতিহ্যের উপস্থাপণ করেছেন। তিনি তার কবিতায় নদী, পাখি, পোকামাকড়, প্রকৃতির তারুণ্য ও নাগরিক জীবনের যন্ত্রণার সাথে তিনি সমগ্র বাংলাদেশের স্বপ্ন বহন করেছেন- তার কবিতা সমূহে তিনি এর স্বাক্ষর রেখেছেন-
ঈদ আমাদের ধর্মীয় সামাজিক ঐতিহ্য ,এর সাথে তিনি মায়ের স্নেহের স্মৃতিচারণ করে ‘মাতৃছায়া’ কবিতায় বলেন-
ঈদের দিনে জেদ ধরি না আর
কানে আমার বাজে না সেই
মায়ের অলঙ্কার।
কেউ বলে না খাও
পাতের ভেতর ঠাণ্ডা হলো
কোর্মা ও পোলাও।
‘ভর দুপুরে’ কবিতায় তিনি মেঘনা নদী, তিতাস , মেঘ, নৌকার পালের দড়ি ,বোয়াল মাছ প্রভৃতি নিয়ে এক চমৎকার দৃশ্য পাঠক মহলে হাজির করেছেন।
মেঘনা নদীর শান্ত মেয়ে তিতাসে !
মেঘের মত পাল উড়িয়ে কী ভাসে ।
মাছের মত দেখতে এ কোন পাটুনি
ভর দুপুরে খাটছে এ সুখের খাটুনি ।
ও মা এ যে কাজল বিলের বোয়ালে
পালের দড়ি আটকে আছে চোয়ালে।
‘না ঘুমানোর দল’ কবিতায় তিনি চাঁদ,নারকেল গাছ, জোনাকি পোকা ইত্যাদি নিয়ে ঘুমন্ত ও নিস্তব্ধ শহরের এক অসাধারণ চিত্র উপস্থিত করেছেন।
নারকেলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল
ডাবের মতো চাঁদ উঠেছে লম্বা ও গোলগাল।
……………………………………………………………
পাহাড়টাকে হাত বুলিয়ে লাল দীঘিটার পাড়
এগিয়ে দেখি জোনাকিদের বসেছে দরবার।
……………………………………………………………
দীঘির কথায় উঠলো হেসে ফুল পাখিদের সব
কাব্য হবে কাব্য হবে জুড়লো কলরব।
‘একুশের কবিতায় ’ তিনি লেখেন-
ফেব্রূয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায় ?
বরকতেরই রক্ত।
‘হায়রে মানুষ’ কবিতায় কবি শৈশব- কৈশোরে যেভাবে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন তাতে যেকোন মানুষকে তার কৈশোর স্মৃতি কাতর করবেই-
একটু যখন বয়েস ছিল ছোট্ট ছিলাম আমি
আমার কাছে খেলাই ছিল কাজের চেয়ে দামি।
উঠোন জুড়ে ফুল ফুটেছে আকাশ ভরা তারা
তারার দেশে উড়তো আমার পরান আত্মহারা ।
জোছনা রাতে বুড়িগঙ্গা তুলতো যখন ঢেউ
আমার পিঠে পরীর ডানা পরিয়ে দিতো কেউ।
শৈশব-কৈশোরে কল্পনার বিচরণ ক্ষেত্রের কোন সীমা নেই । সে সময়ে চাওয়া পাওয়াও থাকে বিচিত্র। ‘পাখির মতো’ কবিতায় এর চিত্রকল্প তাই আমাদের বিমোহিত করে-
আম্মু বলেন পড়রে সোনা
আব্বু বলেন মন দে ;
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠাল চাঁপার গন্ধে।
………………………………
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলির কুলটায় ,
দুধ ভরা ঐ চাঁদের বাটি
ফেরেশতারা উল্টায়।
১৯৭৪ সালে তৎকালীন সরকার জাসদ সমর্থিত ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকার সম্পাদক থাকার অপরাধে কবিকে কারাগারে নিক্ষেপ করে।এক বছরের কারাবাস তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। তিনি আল কুরআন অধ্যয়নে ধাতস্থ হন। এই কুরআন হয়ে উঠে তার গন্তব্যের শেষ ঠিকানা। তার ‘আলোর মিছিল’ ও ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ প্রভৃতি কবিতায় ইসলামী অনুষঙ্গ ও চেতনা এভাবেই ধরা পড়েছে-
মায়ের ছড়াগানে কৌতূহলী কানপাতে বালিশে
নিজের দিলের শব্দ বালিশের সিনার ভিতর।
সে ভাবে সে শুনতে পাচ্ছে ঘোড়দৌড়।
বলে, কে মা বখতিয়ার?
আমি বখতিয়ারের ঘোড়া দেখবো।
মা পাখা ঘোরাতে ঘোরাতে হাসেন,
আল্লার সেপাই তিনি, দুঃখীদের রাজা।
যেখানে আজান দিতে ভয় পান মোমেনেরা,
আর মানুষ করে মানুষের পূজা,
সেখানেই আসেন তিনি।
খিলজীদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি। (বখতিয়ারের ঘোড়া)
‘আলোর মিছিল’ কবিতায় তিনি লেখেন-
আমাদের এ মিছিল নিকট অতীত থেকে অনন্ত কালের দিকে ।
আমরা বদর থেকে ওহুদ হয়ে এখানে,
শত সংঘাতের মধ্যে এ শিবিরে এসে দাঁড়িয়েছি।
কে জিজ্ঞেস করে আমরা কোথায় যাব?
আমরা তো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্ত কালের।
…………………………………………………………………………………………….
আমাদের ভয় দেখিয়ে শয়তান নিজেই অন্ধকারে পালিয়ে যায় ।
আমদের মুখায়বে আগামি ঊষার উদয় কালের নরম আলোর ঝলকানি ।
আমদের মিছিল ভয় ও ধ্বংসের মাঝে বিশ্রাম নেইনি,নেবো না।
আমাদের পতাকায় কালেমা এ তাইয়েবা
আমাদের এই বানী কাউকে কোনদিন থামতে দেয়নি
আমরাও থামবোনা।
বাংলা সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ আল মাহমুদ একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও কবি জসিম উদ্দিন পুরস্কারে ভূষিত হন। শিল্পমান এবং প্রকরণের বিচারে কোন কোন সমালোচক তাকে জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি হিসেবে অভিহিত করেন। ‘৭৪ পরবর্তী সময়ে তাকে তার ইসলামী আদর্শ ও কুরআন মুখীনতার বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলতেন, ‘আমি ধর্মান্ধ নই, আমি বিধাতাক্রান্ত মানুষ’ ‘ তার বিশ্বাসের কারণে এক শ্রেণির কথিত প্রগতিশীলদের পক্ষ থেকে তাকে কোনঠাসা করার প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়। তাতে তিনি আমৃত্যু ঋজু ও আরও মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়েছিলেন।
*লেখক : প্রভাষক, সাতক্ষীরা পিএন স্কুল অ্যান্ড কলেজ।