ক্রাইমবাতা ডেস্করিপোট: চলতি মাসের ৬ তারিখে মৃত্যুবরণ করেছেন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। রেখে গেছেন তার অসংখ্য জনপ্রিয় গান। রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে অসংখ্য জনপ্রিয় গান রয়েছে তার চলচ্চিত্রে। আর নব্বই দশকজুড়ে এন্ড্রু কিশোর ও কনকচাঁপা জুটি চলচ্চিত্রে ধারাবাহিকভাবে উপহার দেন অনেক শ্রোতাপ্রিয় গান। দীর্ঘদিনের সহকর্মীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ কনকচাঁপা। এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে অনেক স্মৃতি রয়েছে এ শিল্পীর। সেগুলো স্মরণ করতে গিয়ে কনকচাঁপা বলেন, বাংলাদেশের বিশাল এবং প্রধানতম বিনোদনের জায়গা সিনেমা হল। পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্র ৩৫ মিলিমিটারের জন্য ফুলস্কেপে পুরো স্ক্রিনে গান ভাসিয়ে দেয়া ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ নামক শক্তির চেয়েও বেশি শক্তির অধিকারী হতে হয়।
আমাদের দেশে কণ্ঠশিল্পী আছেন কতজন আর ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’র এ যাবৎকালের ইতিহাসে নিয়মিত প্লে-ব্যাক সিঙ্গার আছেন ক’জন? প্লে-ব্যাক সিঙ্গার আছেন হাতেগোনা ক’জন। কারণ অন্যান্য গান গাওয়া যায়, কিন্তু পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্র ৩৫ মিলিমিটারের জন্য গান গাওয়া খুব কঠিন। সিনেমায় একমাত্র যাদের ফুল থ্রোট ওয়ালা কণ্ঠ আছে তাদের কণ্ঠই কাজে লাগে। সেই কণ্ঠকে পানির মতো বইয়ে দিতে হয়। সেটা বড় কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজ পানির মতো সহজ করে সফলতার সঙ্গে উপস্থাপন করে নিজেকে বাঘের মতো শক্তিশালী হিসেবে যিনি পরিচিত করতে পেরেছেন, তিনি আমাদের কণ্ঠরাজ এন্ড্রু কিশোর। আমি তার কণ্ঠকে বলি গলিত সোনা। সোনার চলমান ধারা। তার সঙ্গে পরিচয়ের আগেই আমি তার গান শুনি। ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে। হেসে-খেলে, তাচ্ছিল্য ভরে কেউ দুঃখ কইতে পারে- এ কথা আমি আগে জানতামই না। এতো দুঃখের অনুভূতি এমন হেসে-খেলে আসল ভাব বজায় রেখে গাইলেন আমাদের কিশোরদা। সেই থেকে শুরু। আমি আব্দুল আলীম থেকে একেবারে কিশোর দাতে স্থানান্তরিত হলাম। সে হয়তো ’৮০-৮১-এর কথা। এরপর ৮৬ সালে জীবনসঙ্গী ও সুরকার-সংগীত পরিচালক মইনুল ইসলাম খান সাহেবের ছবির গানের রেকর্ডে ওনাকে আমি সামনাসামনি দেখলাম। কিন্তু মনে হলো কতদিনের চেনা। হাতে একটা অফিসিয়াল ব্যাগ। সেখান থেকে কাগজ-কলম বের করে গান লিখে নিলেন! গান তোলার সময় কলমের হেড ঠোঁটের সঙ্গে কিপ করার মতো একটা ভঙ্গি করে গান তুলে নিলেন এক মুহূর্তেই। এরপর ইতিহাস! প্রতিটি গানই তার ইতিহাস। অথচ তিনি বলতেন আমি তো আম জনতার শিল্পী। ভদ্রলোকরা আমার গান শোনেন? অথচ নিউইয়র্কে ডাক্তারদের জন্য গান গেয়ে ইন্টারভেলে ব্যাকস্টেজে একদল ডাক্তার এসে যখন বললেন কিশোর দা, আপনার গান শুনে শুনে আমরা ডাক্তার হয়েছি। কিশোর দা চোখ সরু করে শুধান ‘সে কেমন?’ তাদের উত্তর ছিল, যখন মানবদেহের হাড্ডি-গুড্ডি আমাদের আঁকড়ে ধরতো মাথা কাজ করতো না তখন এন্ড্রু কিশোর ছেড়ে মাথা ঠাণ্ডা করতাম। তারপর সেটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল। আমি বললাম এবার বুঝলেন তো! তিনি শিশুর সরলতায় ফ্যালফ্যাল হাসেন। বাঘের মুখে শিশুর হাসি বড়ই সুন্দর! কত গান যে গাইলাম তার সঙ্গে! পৃথিবীর সব কিছুই যেন তার নখদর্পণে। কিন্তু কোনো কিছুতেই তার কিছু আসে যায় না। এই শক্তিশালী মানুষটিকে আমি কাঁদতেও দেখেছি জনসমক্ষে। রাজশাহীতে তার ওস্তাদজির অসুস্থতায় আমরা ক’জন যখন বিনা পারিশ্রমিকে গাইতে গেছি, তখন তিনি মঞ্চে কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন! সে কান্না মঞ্চের পেছনেও শেষ হয় না। আমাকে কিশোর দা অসম্ভব স্নেহ করতেন, যার কোনো তুলনা হয় না। আমার রান্না তার খুব পছন্দ। আর খেতে তিনি খুব ভালোবাসেন। আমাদের একজনই কিশোর দা, আমরা তার সুস্থতার আশায় পথ চেয়ে বসেছিলাম চাতকের মতো। কিন্তু আমাদের ছেড়ে তিনি চলে গেলেন। আমি খুব চাইতাম তাকে আর আলাউদ্দিন আলী ভাইকে রান্না করে খাওয়াবো! হলো না। কিছু ইচ্ছে এভাবে বাকি রয়ে যায়।