প্রতারণার প্রমাণ মিলেছে ডা. সাবরিনার বিরুদ্ধে তদন্ত দম্পতি ভয়ঙ্কর

ক্রাইমবাতা ডেস্করিপোট :  ডা. সাবরিনা চৌধুরী। পেশায় হৃদরোগ সার্জন। টেলিভিশনেও পরিচিত মুখ। টকশোতে স্বাস্থ্য বিষয়ক আলোচনায় নিয়মিত অংশ নিতেন। দিতেন সুস্থ্য থাকার নানা টিপস। সবকিছু ছাড়িয়ে ভয়ঙ্কর এক প্রতারণার অভিযোগে এখন তিনি আলোচনায়। খলনায়ক তার স্বামী আরিফ চৌধুরী।  যার চতুর্থ স্ত্রী হিসাবেই সাবরিনা পরিচিত। আরিফের দুই স্ত্রী থাকেন রাশিয়া ও লন্ডনে।

আরেক স্ত্রী  দেশেই থাকেন। স্ত্রীর অধিকার পাবার জন্য স্বামীর পেছনে হন্যে হয়ে ছুটছেন। এসব বিষয়ে কম যান না সাবরিনাও। আরিফ চৌধুরী তাকে একদিন এক চিকিৎসকরে সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটানো অবস্থায় পেয়েছেন। পরে আরিফের মারধরের শিকার হন ওই চিকিৎসক। এনিয়ে সাবরিনা শেরেবাংলা থানায় একটি জিডি করেছিলেন। এসব নিয়ে সেই সময় আলোচনার কমতি ছিল না। সম্প্রতি এই দম্পতি নতুন করে আলোচনায় এসেছেন। জেকেজি হেলথ কেয়ার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা ২৭ হাজার করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে কোনো রকম পরীক্ষা ছাড়াই ১৫ হাজার ৪৬০টি মনগড়া ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছেন। বাকি ১১ হাজার ৫৪০টি রিপোর্ট দিয়েছে আইইডিসিআরের মাধ্যমে। জেকেজির গুলশানের অফিস থেকে ১৫ হাজার ৪৬০টি ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে এই দম্পতি হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ৮ কোটি টাকা। করোনার রিপোর্ট জালিয়াতির কারণে সাবরিনা চৌধুরীর স্বামী আরিফ চৌধুরীসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপির তেজগাঁও ডিভিশন। তারা এখন কারাগারে আছেন। পুলিশি তদন্তে তাদের ভুয়া রিপোর্ট প্রদানের সত্যতাও মেলেছে। এমনকি জালিয়াতির কাজে সংশ্লিষ্টতা মিলেছে ডা. সাবরিনা চৌধুরীর। জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের রেজিষ্টার সার্জন হয়েও তিনি একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন। সরকারি চাকরি করেও তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রভাব খাটিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ ভাগাতেন। এর বাইরে এই দম্পতির বিরুদ্ধে নানা অনৈতিক কর্মকান্ড, মাদকতা, বিশিষ্টজনের নাম ভাঙ্গিয়ে ফায়দা নেয়া, হুমকি-দামকি, সন্ত্রাসী বাহিনী লালন পালনসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
জেকেজি প্রতিষ্ঠানের সিইও আরিফ চৌধুরীর নামে জালিয়াতি, সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর হামলাসহ আরও কয়েকটি অভিযোগে চারটি মামলা করেছে পুলিশ। এসব মামলার কোনোটিতেই আসামি করা হয়নি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরীকে। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, প্রথমদিকে সাবরিনার সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া না গেলেও পরে তদন্তে সাবরিনার সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে রিপোর্ট জালিয়াতি, তিতুমীর কলেজে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সংবাদকর্মীদের ওপর হামলায় সাবরিনার সংশ্লিষ্টতা মিলেছে। আরও কিছু তথ্য প্রমান পেলেই সাবরিনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।  যদিও সাবরিনা এই ঘটনার পর থেকেই দাবি করছেন জেকেজির সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এই প্রতিষ্ঠানটি তার স্বামী আরিফ চৌধুরীর।

এদিকে গতকাল একটি বেসরকারি টেলিভিশনে ডা. সাবরিনা চৌধুরী জেকেজির সঙ্গে বর্তমানে তার সম্পৃক্ততা নেই বলে জানিয়েছেন। আগেই তিনি প্রতিষ্ঠান থেকে সরে এসেছেন। তিনি বলেছেন, জেকেজির চেয়ারম্যান হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। এটি ওভাল গ্রুপের একটি অঙ্গসংগঠন। আর ওভাল গ্রুপ একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। যার মালিক আরিফ চৌধুরী। সাবরিনা বলেন, আমি আরিফকে কাজ পাইয়ে দিয়েছি বা দিতাম এগুলো একেবারে মিথ্যা কথা। বরং জেকেজির জাল সনদ তৈরির কথা তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজিকে জানিয়েছেন বলে দাবি করেছেন। তবে আরিফ পুলিশের কাছে শিকার করেছেন জেকেজির সঙ্গে সাবরিনার সম্পৃক্ততা রয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টসূত্র বলছে, সাবরিনা-আরিফ দম্পতি দীর্ঘদিন ধরে দিব্যি জালিয়াতির কারবার চালিয়ে যাচ্ছিলো। হয়তোবা তাদের এমন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কেউই কোনোদিন জানতে পারতো না। তবে তিতুমীর কলেজে করোনার বুথ স্থাপন করে অনৈতিক কর্মকাণ্ড, গান বাজনা, পার্টি ও কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি ও শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ তাদের জালিয়াতির বিষয়টি ধরতে পারে। জালিয়াতির ঘটনায়ই পুলিশ আরিফ ও তার ৫ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে ২৫শে জুন। পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তার করে তেজগাঁও থানায়  নিয়ে আসে। এরপর ওইদিন রাতেই আরিফকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিতে একটি বিশেষ দলের পরিচয় দিয়ে অন্তত ৬০/৭০ জন লোক তেজগাঁও থানায় হামলা করেছিলো। হামলাকারীরা ওইদিন থানার কেচিগেট ভাংচুর করে। পুলিশের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকেই হামলাকারী ১৮ জনকে আটক করে পৃথক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, হামলাকারীরা নিজেদের আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের পরিচয় দিয়েছিল। তারা আরিফকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য এতটাই মারমুখী ছিল প্রথমদিকে থানার পুলিশও অসহায় হয়ে পড়েছিল। পরে বাধ্য হয়ে পুলিশ তাদেরকে আটক করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এছাড়া খোদ আরিফকে  গ্রেপ্তার করে আনার পর সে পুলিশের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে। মাদকাসক্ত আরিফ থানায় এসে পুলিশের কাছে নেশাদ্রব্য চায়। পুলিশ তাকে নেশাদ্রব্য না দেওয়াতে সে চড়াও হয়ে থানার সিসি ক্যামেরা ভাংচুর করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আরিফ সবসময় নিজেকে আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয় দিত। আদতে সে দলীয় কোনো পদপদবিতে ছিল না। শুধু দলীয় নাম ভাঙ্গিয়ে সে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে ফায়দা নিতো। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে সে দাফট দেখাত। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচয় দিয়েও সে মানুষকে হুমকি দামকি দিত। এই পরিচয় দিয়ে আরিফ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালককে হুমকি দিয়েছে বলেও অভিযোগ আছে।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সাবরিনা ও আরিফ দম্পতি দীর্ঘদিন ধরেই বেপরোয়া। নানান অনৈতিক কাজের সঙ্গে তারা জড়িত। বিভিন্ন অনৈতিক কাজকর্ম করে তারা কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। করোনার সনদ জালিয়াতির প্রতিবাদ করে বেতন বাড়ানোর প্রতিবাদ করাতে তাদের প্রতিষ্ঠানের দুজন কর্মীকে চাকরিচ্যুত করেন। পরে অবশ্য তাদের কাছ থেকে চুরি বিদ্যা শিখে ওই দুজনও করোনার নুমনা সংগ্রহ করে জালিয়াতি শুরু করেন। সম্পর্কে তারাও স্বামী স্ত্রী। আরিফ ও সাবরিনার প্রতিষ্ঠান জেকেজিতে তারা চাকরি করতেন।

এদিকে জালিয়াতি ও অন্যান্য মামলায় এখনও সাবরিনাকে গ্রেপ্তার করতে করেনি পুলিশ। পুলিশ বলছে, প্রাথমিকভাবে এসব অনৈতিক কাজে সাবরিনার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। পুরোপুরি সংশ্লিষ্টা পাওয়া গেলেই শিগগির তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে। এছাড়া তাদের এই কর্মকাণ্ডে যারা সহযোগীতা করেছেন তাদের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। অপকর্ম করে তারা কত টাকা কামিয়েছেন সে বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে পুলিশ।
পুলিশের তেজগাঁও ডিভিশনের উপ কমিশনার হারুন অর রশীদ গতকাল মানবজমিনকে বলেন, করোনার জাল সনদ জালিয়াতির ঘটনা মামলা হয়েছে। মামলার তদন্ত চলছে। তদন্তে সাবরিনার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাকেও গ্রেপ্তার করা হবে। তেজগাঁও পুলিশের একাধিকসূত্র জানিয়েছে, আলোচিত এই ঘটনার তদন্তে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্যই মিলেছে। তদন্তও প্রায় শেষ পর্যায়ে। পুলিশি তদন্তে সাবরিনা ও আরিফের খুঁটির জোরের সন্ধান মিলেছে। যাদের প্রভাব খাটিয়ে তারা বেপরোয়াভাবে অপকর্ম করে যাচ্ছিলো। প্রভাব কাটিয়ে তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তাদের ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানে করোনার নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে আসে। শুধুমাত্র তিতুমির কলেজে বুথ স্থাপন করে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি পেলেও তারা প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে শুরু করে ঢাকার বাইরে থেকেও মাঠকর্মী পাটিয়ে নমুনা সংগ্রহ করত। অল্প কিছুদিনেই তারা ২৭ হাজার মানুষের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে। যারমধ্যে ১৫ হাজারের ওপরে ভুয়া সনদ দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকাসহ, নায়ায়নগঞ্জ, নরসিংদী ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ৪৪টি বুথ স্থাপন করেছিল সাবরিনা-আরিফের দম্পতির জেকেজি প্রতিষ্ঠান। নমুনা সংগ্রহের জন্য মাঠকর্মী নিয়োগ দেয়া ছিল। তাদের হটলাইন নম্বরে রোগীরা ফোন দিলে মাঠ কর্মীরা বাড়ি গিয়েও নমুনা সংগ্রহ করতেন। আবার অনেককে জেকেজির বুথের ঠিকানা দেয়া হতে। এভাবে কর্মীরা প্রতিদিন গড়ে ৫০০ মানুষের নমুনা সংগ্রহ করতো। পরে তাদের গুলশানের একটি ভবনের ১৫ তলার অফিসের একটি ল্যাপটপ থেকে ভুয়া সনদ দিত। ওই ল্যাপটপ থেকে জিকেজির কর্মীরা রাতদিন শুধু জাল রিপোর্ট তৈরির কাজ করত। প্রতিটা সনদের জন্য নেয়া হতো ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। যদিও শর্ত ছিল বিনামূল্য নমুনা সংগ্রহ করে সরকার নির্ধারিত ল্যাবে পাঠাতে হবে। কিন্তু তারা সকল প্রকার শর্তভঙ্গ করে পরীক্ষা ছাড়াই রিপোর্ট দিত। গতকাল জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে জানা যায় ডা. সাবরিনা নিয়মিতই অফিস করছেন। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা পত্রপত্রিকায় সাবরিনার বিষয়ে জেনেছেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত অভিযোগ পাননি। হাসপাতালের অধ্যক্ষ ও পরিচালক ডা. মীর জামাল উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, আমরা বিষয়টি শুনেছি। সাবরিনা নিয়মিত অফিস করছেন। সাবরিনা সরকারি হাসপাতালে চাকরি করে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। এখনই কিছু বলা যাবে না। সাবরিনার বিষয়টি তদন্তের জন্য হাসপাতালের  পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকে বলা হয়েছে।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।