ক্রাইমর্বাতা ডেস্করিপোট : ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানির তোড়ে ছুটছে কুড়িগ্রামের মানুষ। ডুবে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। অনেকে গবাদিপশুসহ আশ্রয় নিয়েছে বাঁধের ওপর। কেউ কেউ ঘরের চালে। এভাবে বন্যার পানিতে ভাসছে মানুষ। তবে তাদের দ্রুত উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার পদক্ষেপ কম বলেই জানা গেছে। এ অবস্থায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের পাশাপাশি মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ছে। দুর্গত এলাকায় নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ।
এদিকে, গাইবান্ধা, বগুড়া, রংপুরসহ উত্তরের জনপদ ডুবিয়ে বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হতে শুরু করেছে দেশের মধ্যাঞ্চলেও। জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলকে প্লাবিত করে বানের পানি ঢুকে পড়েছে ঢাকার চারপাশে। উত্তরাঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, যমুনার পাশাপাশি মধ্যাঞ্চলে পদ্মা, মেঘনা, এমনকি ধলেশ্বরীর পানি পর্যন্ত হু হু করে বাড়ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস বলছে, দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকবে।
সরকারি হিসাবমতে, বন্যায় এখন পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। ১৭টি জেলার ৯১টি উপজেলার ৪৫০টি ইউনিয়ন বন্যা উপদ্রুত হয়েছে বলে তথ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের।
প্রায় পৌনে তিন লাখ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। ১৪ লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। দুর্গত এলাকায় সহস্রাধিক আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও বানভাসিদের আগ্রহ কম থাকার কথা বলছেন স্থানীয় কর্মকর্তারা। এ পর্যন্ত মাত্র ২০ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে গেছে। বন্যাকবলিত এলাকায় গঠিত ৫৯৬টি মেডিকেল টিমের মধ্যে ১৮২টি কাজ শুরু করেছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, এরই মধ্যে দেশের ২০টি জেলায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অচিরেই তা ২৫টিতে উন্নীত হতে পারে। আশপাশের জেলাগুলোতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়ে ঢাকার নিম্নাঞ্চলও তলিয়ে যেতে পারে।
সংস্থার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, গঙ্গা ও পদ্মার পানি বাড়ছে; তা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এর ফলে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী ও ঢাকার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। তবে সিলেট ও সুনামগঞ্জে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে।
গতকাল বুধবার ১৪টি জেলার ২১টি পয়েন্টে নদনদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২১টি পর্যবেক্ষণাধীন পয়েন্টের মধ্যে ৫৬টিতে পানি বেড়েছে, ৪১টিতে কমেছে এবং চারটিতে স্থিতিশীল। যমুনার প্রায় সব পয়েন্টে পানি উপচে উঠেছে। বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২৫ সেন্টিমিটার অতিক্রম করেছে। এ ছাড়া এ নদীর ফুলছড়ি, সারিয়াকান্দি, কাজীপুর, সিরাজগঞ্জ, আরিচা- সব পয়েন্টে পানি বেড়েছে। ঘাঘটের গাইবান্ধা পয়েন্টেও পানি বেড়েছে।
গাইবান্ধা :মঙ্গলবার বিকেল ৩টা থেকে বুধবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের পানি ১৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১১৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং এ সময় ঘাঘট নদীর পানি ১৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এতে ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের ভাষারপাড়া ও মাঝিপাড়া পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং সদর উপজেলার তালতলার বিপরীতে দক্ষিণ ঘাগোয়া এলাকায় কোমরনই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সদর উপজেলার এলাকায় এক লাখ ৩০ হাজার মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।
লালমনিরহাট :তিস্তা ও ধরলার পানি কমতে শুরু করায় লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে ভোগান্তি কমেনি বানভাসিদের। জেলার পাঁচটি উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের প্রায় ৩৫ হাজার পরিবার এখনও পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।
সিরাজগঞ্জ :জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সেইসঙ্গে যমুনার পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ জেলা পয়েন্টে পানি ৩৩ সেন্টিমিটার বেড়েছে। কাজীপুর উপজেলা পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার ওপরে। এদিকে, যমুনার পানি বাড়ায় কাজীপুর, শাহজাদপুর ও চৌহালীতে ভাঙন বেড়েছে।
মানিকগঞ্জ :উজান থেকে ধেয়ে আসা ঢলে পদ্মা-যমুনাসহ মানিকগঞ্জের অভ্যন্তরীণ নদনদীতে দ্রুত পানি বাড়ছে। এরই মধ্যে জেলার চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে গ্রামের রাস্তাঘাট। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে নিম্নাঞ্চলের সহস্রাধিক পরিবার। এদিকে, যমুনা নদীর পানি আরিচা পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক (গেজ রিডার) ফারুক আহম্মেদ জানান, ধলেশ্বরী, কালীগঙ্গাসহ অন্য নদীর পানিও বাড়ছে।
কুড়িগ্রাম :ধরলা নদীতে পানি ধীরগতিতে কমলেও ব্রহ্মপুত্রে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। এতে জেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের চর রসুলপুর, যাত্রাপুর ইউনিয়নের দ্বীপচর পার্বতীপুর এবং পাঁচগাছি ইউনিয়নের ছত্রপুর গ্রামের অধিকাংশ বাড়িঘরে পানি উঠে গেছে। রান্নার ব্যবস্থা নেই। তলিয়ে আছে নলকূপ। ফলে খাওয়ার পানি জুটছে না। শুলকুর বাজার এলাকার বাঁধ ও কুড়িগ্রাম-যাত্রাপুর সড়কে আশ্রয় নিয়েছে অনেক পরিবার।
নাটোর :জেলার সিংড়ায় পানির তোড়ে সিংড়া-তেমুখ নওগাঁ গ্রামীণ সড়ক ভেঙে গেছে। এতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অন্তত ১০টি গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা। চারটি ইউনিয়নের প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
নওগাঁ :জেলার রানীনগরে ছোট যমুনা নদীর নান্দাইবাড়ী-কৃষ্ণপুর ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধটি এবারও ভেঙে গেছে। গত মঙ্গলবার রাতে বাঁধটি ভেঙে কয়েক গ্রামের অন্তত ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এলাকার শতাধিক পুকুরের মাছ ভেসে গেছে বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। এদিকে, মান্দা উপজেলায় আত্রাই নদীর পানি জোতবাজার পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বুধবার আত্রাই উপজেলার নান্দাইবাড়ী-কৃষ্ণপুর-মালঞ্চি বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে রানীনগর ও আত্রাই উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম।
সারিয়াকান্দি (বগুড়া) :পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সারিয়াকান্দির মথুরাপাড়া পয়েন্টে যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় চরাঞ্চল ও নদী-তীরবর্তী এলাকার মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। বন্যার্ত মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে মালামাল ও গবাদিপশু নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে।
নেত্রকোনা :জেলার প্রধান নদী সোমেশ্বরী, উদ্ধাখালী, কংশ নদসহ বিভিন্ন নদনদীর পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় দেখা দিয়েছে নদী ও সড়কে ভাঙন। পানিবন্দি লাখো মানুষের বাড়ছে দুর্ভোগ। কলমাকান্দায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে দুর্ভোগ কমেনি। শতাধিক গ্রামে পানিবন্দি হয়ে আছে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।
সরিষাবাড়ী (জামালপুর) :যমুনা নদীর পানি ফের বৃদ্ধিতে জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে সড়ক তলিয়ে ফের চরাঞ্চল এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে উপজেলার আটটি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটির চরাঞ্চলের অন্তত অর্ধশতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। প্লাবিত ইউনিয়নগুলো হলো সাতপোয়া, কামরাবাদ, পোগলদিঘা, আওনা ও পিংনা ইউনিয়ন।
গজারিয়া (মুন্সীগঞ্জ) গজারিয়া উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের একটি পাকা সড়কের অংশবিশেষ পানির তোড়ে ধসে পড়ায় স্থানীয় কয়েক হজার মানুষের চলাচল ও পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে পড়েছে।
গজারিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জাহিদুল ইসলাম দুলাল গতকাল বলেন, বাঁশের সাঁকো ও বালুভর্তি বস্তা ফেলে রাস্তাটির ধসে পড়া অংশ মেরামতের চেষ্টা করছি। গজারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবু তালেব ভূঁইয়া জানান, তিনি ব্যক্তিগত তহবিল থেকে বালুভর্তি বস্তা ও ইট-বালু ফেলে ধসে যাওয়া অংশটুকু মেরামত করে আজকের (বৃহস্পতিবার) মধ্যে রাস্তাটি চলাচল উপযোগী করার চেষ্টা করছেন।
মেহেরপুর :আট-দশ দিনের টানা বৃষ্টিতে ভেসে গেছে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাজীপুর এলাকার দামুস্যা বিলের অন্তত ২০ লক্ষাধিক টাকার মাছ। একদিকে ভারি বর্ষণ, অন্যদিকে করোনা সংক্রমণে মাছ ঠিকমতো বাজারজাত করতে না পারায় এমন ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে বলে ওই এলাকার রূপালী মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্যরা জানান।
(প্রতিবেদনটি তৈরি করতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্নিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা)