অস্তিত্ব–সংকটে সাতক্ষীরার উপকূলের মানুষ

ক্রাইমর্বাতা ডেস্ক রিপোট:  আমারগো আর এ এলাকায় বাস হবে না। ভিটেমাটি ছেড়ে ছেলেপুলে নে বাইরির দিক গেবরাতি হবেনে (চলে যেতে হবে)। ঝড় আর তুপান আলিই নদীর পানিতে সব ভাসে যায়। ঘুরে দাঁড়াতি দাঁড়াতি আবার বাঁধ ভাঙে পানিতে তলিয়ে যাতি হয়।’

সত্তোরোর্ধ্ব রোকসানা খাতুন কথা শেষ না করেই হাতের ইশারায় ইঙ্গিত করেন সমুদ্রের জলরাশি থেকে তাঁদের রক্ষাকারী উপকূল রক্ষা বাঁধের দুরবস্থার দিকে। দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরাকে ঘিরে রাখা চারপাশের উপকূল রক্ষা বাঁধের চরম জরাজীর্ণ দশা প্রতিটি মুহূর্তে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে বলে দাবি করেন রোকসানার প্রতিবেশী আজিজুল মোল্যাও।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সিডর, আইলা, বুলবুল কিংবা আম্পানের মতো প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ এলেই কেবল কর্তাব্যক্তিদের তৎপরতা চোখে পড়ে। কিন্তু কোনো রকমে বিপদ কেটে গেলেই ভীতিকর পরিস্থিতির কথা তাঁরা বেমালুম ভুলে যান।

প্রায় অভিন্ন অভিযোগ করে শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের প্রভাষক পরীক্ষিত মণ্ডল জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাতের পর প্রায় দুই মাস অতিক্রান্ত হতে চলল, কিন্তু এখন পর্যন্ত তাঁদের এলাকায় টেকসই উপকূল রক্ষা বাঁধ তৈরির কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। কেবল ভেঙে যাওয়া তিনটি স্থানে নামকাওয়াস্তে রিং বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।

বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের বিধবা জহুরা বেগম ও কেয়া খাতুন জানান, গত ২০ মে খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে অন্যান্য পরিবারের মতো তাঁরাও দীর্ঘদিন জোয়ার–ভাটার মধ্যে বসবাস করেছেন চরম দুর্ভোগের মধ্যে। ভাঙনকবলিত দুর্গাবাটি এলাকায় রিং বাঁধ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে নির্মাণ হওয়ার পর তাঁরা ক্ষতবিক্ষত বাস্তুভিটায় ফিরেছেন। বিধ্বস্ত ভিটায় দোচালা তুলে বসবাস শুরু করেছেন। কিন্তু উঁচু টেকসই বাঁধ নির্মাণ না হলে সামান্য জলোচ্ছ্বাসে আবার তাঁরা গৃহহীন হবেন ছেলেমেয়ে নিয়ে। এভাবে চলতে থাকলে তাঁদের বংশধরদের পরিচয় ও ঠিকানা হারিয়ে যাবে।

গোলাখালী গ্রামের আবুল হোসেন ও দুর্গাবাটি গ্রামের নীলকান্ত রপ্তান জানান, ষাটের দশকে নির্মিত শ্যামনগরের আওতাভুক্ত ৫ ও ১৫ নম্বর পোল্ডারের জীর্ণশীর্ণ বাঁধ নিয়ে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এ উপজেলায় বসবাসকারী প্রতিটি পরিবারই আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় গোটা এলাকা মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী কৈখালী, কাশিমাড়ীসহ গুরুত্বপূর্ণ জনপদ রক্ষা করতে হলে আইলার পর ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এ অঞ্চলে টেকসই প্রযুক্তিতে নতুন করে উপকূল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুর, কাশিমাড়ী, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জ, রমজাননগর, কৈখালী ইউনিয়নসহ উপজেলায় প্রায় দুই কিলোমিটার পাউবোর বাঁধ রয়েছে। এসব বাঁধ অধিকাংশ ষাটের দশকে নির্মাণ করা। বর্তমানে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বাঁধ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

কাশিমাড়ী, গাবুরা ও বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আম্পান আঘাতের পর গোটা উপকূল রক্ষা বাঁধ যেন সরু আইলে পরিণত হয়েছে। গাবুরার তিনটিসহ দাতিখালী, দুর্গাবাটি ও কাশিমাড়ীর অংশে রিং বাঁধ নির্মাণ করে আপাতত নদীর পানি লোকালয়ে ঢোকা আটকানো হয়েছে। তবে আবার বড় ধরনের কোনো জলোচ্ছ্বাসে তা নিমেষেই বিলীন হয়ে যেতে পারে।

পরিবেশ আন্দোলনের নেতা আশেক–ই–এলাহি জানান, আম্পানের আঘাতে লন্ডভন্ড হওয়ার পর থেকে উপকূলবর্তী শ্যামনগর ও আশাশুনির মানুষ ‘ত্রাণ নয়, টেকসহ বাঁধ চাই’ দাবি জানালেও এখনো পর্যন্ত পাউবো কর্তৃপক্ষের কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। আম্পানের দুই মাস হয়ে গেলেও রিং বাঁধ দেওয়া ছাড়া কিছুই হয়নি। চলতি বর্ষা মৌসুমে যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে আবার এসব এলাকা পানিতে তলিয়ে মানুষ সম্বলহীন হয়ে পড়তে পারেন।

এ বিষয়ে সাতক্ষীরা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের জানান, প্রাথমিকভাবে রিং বাঁধ দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢোকা বন্ধ করা হয়েছে। এখন এসব বাঁধে মাটি দিয়ে দেওয়া হবে। এসব বাঁধ নতুন করে নির্মাণ ও সংস্কার করার জন্য প্রকল্প করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন হলে কাজ হবে।

Check Also

সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ডের উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ড (রাজারবাগান ও সরকারপাড়া ইউনিট) এর উদ্যোগে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।