ক্রাইমর্বাতা ডেস্করিপোট : উজানের পানির চাপে মধ্যাঞ্চলে অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে বন্যা। এর প্রভাবে তলিয়ে গেছে মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী ও ঢাকা জেলার নিম্নাঞ্চল। যমুনায়ও ভয়াল রূপ। পানি স্থিতিশীল থাকায় জামালপুর, গাইবান্ধা ও বগুড়ায় এখনও অনেক মানুষ পানিবন্দি। গত দু’দিনে ব্রহ্মপুত্রের পানি কিছুটা নেমে যাওয়ায় উত্তরাঞ্চলে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। তবে ওই অঞ্চলে বানভাসি মানুষের হাহাকার চলছে। দু-তিন দিনের মধ্যে সেদিকে ফের পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
বন্যায় এ পর্যন্ত সারাদেশে আটজনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ১৮টি জেলায় পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা পাঁচ লাখ ৪৮ হাজার ৮১৬। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ২৩ লাখ ৩৬ হাজার ৭১৯ জন। বেশি দুর্গত এলাকায় প্রায় দেড় হাজার আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে ৫৬ হাজার গবাদিপশুসহ আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় ৬০ হাজার মানুষ। দুই শতাধিক মেডিকেল টিম বন্যা উপদ্রুত এলাকায় কাজ করছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া সমকালকে বলেন, এ মুহূর্তে জামালপুর ও গাইবান্ধায় বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে পানি কমলেও পরিস্থিতি এখনও খারাপ। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্রের পানি আবারও বেড়ে যাওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। এতে সহসাই বন্যা পরিস্থিতি কাটছে না। চলতি মাস এ রকমই থাকতে পারে।
পূর্বাভাস কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, দেশের নদ-নদীর ১০১টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ৪৪টি পয়েন্টেই গতকাল শুক্রবার পানি বেড়েছে। এর মধ্যে বিপদসীমার ওপরে বয়ে যাচ্ছে ২২টি পয়েন্টে। ৫৭টি স্টেশনে পানি কমতে শুরু করেছে। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ধরলা, ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র ও গুড় নদীর পানি চারটি পয়েন্টে এবং যমুনা নদীর পানি দুটি পয়েন্টে কমেছে। মেঘনা অববাহিকার সুরমা, কুশিয়ারা ও পুরোনো সুরমার পানি তিনটি পয়েন্টে এবং গঙ্গা অববাহিকার নদী আত্রাইয়ের পানি একটি পয়েন্টে কমে এসেছে।
এর ফলে সিলেট, সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, নাটোর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে এবং আগামী ২৪ ঘণ্টা তা অব্যাহত থাকতে পারে। তবে ভাটির দিকে পানির চাপ বাড়ায় দেশের মধ্যাঞ্চলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকার নদ-নদীগুলোর পানি বাড়ার প্রবণতা আগামী দু’দিন অব্যাহত থাকবে। নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
জামালপুর, সরিষাবাড়ী ও মাদারগঞ্জ :বন্যার পানির স্রোতে গত বৃহস্পতিবার রাতে জামালপুর-শেরপুর ও বকশীগঞ্জ সড়কের তিনটি ব্রিজের ডাইভারশন ভেঙে যাওয়ায় জামালপুরের সঙ্গে শেরপুর ও বকশীগঞ্জের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এদিকে ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জের বেশ ক’টি আশ্রয়কেন্দ্র ও দুর্গত এলাকার মানুষ অভিযোগ করেছেন, এখনও বেশিরভাগ মানুষের কাছে পৌঁছেনি ত্রাণসামগ্রী। সরিষাবাড়ীতে হাসপাতাল, পুলিশ স্টেশন, ফায়ার সার্ভিস, খাদ্যগুদাম, বাস টার্মিনাল, হাটবাজারসহ বাড়িঘরে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। তলিয়ে গেছে রেললাইন। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এ উপজেলার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। মাদারগঞ্জ উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণ করেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম এমপি। শুক্রবার তিনি উপজেলার পাকরুল চরে বন্যাকবলিত ও নদীভাঙনের শিকার পাঁচশ’ পরিবারের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন।
গাইবান্ধা ও সুন্দরগঞ্জ :গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সদর উপজেলার ২৬টি ইউনিয়নের এক লাখ ২৫ হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি। কিন্তু বানভাসি বেশিরভাগ মানুষের হাতে এখনও ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি। সুন্দরগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। টানা বর্ষণ ও পানির স্রোতে অসংখ্য বড় গর্তের সৃষ্টি হওয়ায় সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের তিস্তা নদীর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধটি হুমকির মুখে পড়েছে।
কুড়িগ্রাম :ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি এখনও বিপদসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার বন্যাকবলিত এলাকাগুলো এখনও পানিতে ভাসছে। ফলে বাড়িঘর ছেড়ে বাঁধ ও রাস্তায় আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলোও বাড়ি ফিরতে পারেনি। এদিকে কুড়িগ্রামে বন্যার্তদের জন্য বরাদ্দকৃত ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ কারণে অধিকাংশের হাতে এখন পর্যন্ত সরকারের ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
সিরাজগঞ্জ ও উল্লাপাড়া :গত ক’দিনের তুলনায় শুক্রবার সিরাজগঞ্জ জেলা পয়েন্টে যমুনার পানি কিছুটা কমলেও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনার পশ্চিম তীর, শাহজাদপুরের কৈজুরী ও এনায়েতপুরে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। গতকাল শুক্রবার সদর উপজেলার সয়দাবাদ ও কালিয়া হরিপুর ইউনিয়নে ত্রাণ বিতরণ করেন সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না। উল্লাপাড়া উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার দুই শতাধিক গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। গতকাল পানিতে ডুবে মারা গেছে উপজেলার কালীগঞ্জ ও পাটধারী গ্রামের দুটি শিশু। ডুবে গেছে পাকা ও কাঁচা অনেক রাস্তা।
রাজবাড়ী :রাজবাড়ী সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের চরমৌকুড়ি, আমবাড়িয়া, চর আমবাড়িয়া, কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া, কালিকাপুর ও পাংশার হাবাসপুর ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি গ্রামে ঢুকে পড়েছে বন্যার পানি। ডুবে গেছে ক্ষেতের ফসল।
টাঙ্গাইল :টাঙ্গাইলের বাসাইল-কাঞ্চনপুর সড়কের ছনকাপাড়া নামক স্থানে বন্যার পানির তীব্র স্রোতে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ব্রিজ ভেঙে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে বাসাইল ও মির্জাপুর উপজেলার প্রায় ৩০টি গ্রামের মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।
ফরিদপুর, আলফাডাঙ্গ, সদরপুর ও চরভদ্রাসন :শহরের ভাজনডাঙা এলাকায় পদ্মা নদীর পাড় ভেঙে ফরিদপুর পৌরসভার আড়াই সহস্রাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ফরিদপুর সদরের নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের দুর্গত এক হাজার পরিবারের মধ্যে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও ডিক্রিরচর ইউনিয়নের চার শতাধিক পরিবারের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। আলফাডাঙ্গা উপজেলার টগরবন্দ ইউনিয়নে মধুমতী নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে পাকা সড়ক। সদরপুর উপজেলায় পদ্মা আড়িয়াল খাঁ নদে পানি বৃদ্ধি পেয়ে পাঁচটি ইউনিয়ন নতুন করে বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। মানুষ গবাদিপশু নিয়ে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র ও বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিচ্ছেন। চরভদ্রাসন উপজেলায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
নওগাঁ :পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের আত্রাই নদীর ছয়টি পয়েন্টে বাঁধ ও বেশ কিছু বেড়িবাঁধ ভেঙে জেলার রানীনগর, আত্রাই ও মান্দা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার মানুষ এখন উঁচু স্থানে, সড়ক বাঁধ ও আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। জেলা প্রশাসক মো. হারুন অর রশীদ, জেলা পুলিশ সুপার প্রকৌশলী মো. আব্দুল মান্নান বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে বেশ কিছু এলাকায় সরকারি ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন।
মুন্সীগঞ্জ :পানি বৃদ্ধির সঙ্গে উত্তাল পদ্মায় বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ার সঙ্গে প্রচণ্ড গতিবেগে ঘূর্ণায়মান স্রোতের সোঁ সোঁ শব্দ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠায় মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার নদী তীরবর্তী গ্রামের মানুষ ভয়ে ঘুমাতেও পারছেন না। মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বড়াইল গ্রামের বৃদ্ধা আলেয়া বেগম ভয়ার্ত কণ্ঠে জানান এ কথা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃদ্ধা আলেয়া বেগমের মতো একই অবস্থা টঙ্গিবাড়ী ও লৌহজং উপজেলার পদ্মা তীরবর্তী গ্রামগুলোর শত শত পরিবারের। অন্যদিকে টঙ্গিবাড়ীর ভাঙুনিয়া এলাকায় পদ্মার পানির স্রোতের তোড়ে ভেঙে গেছে কামারখাড়া ও হাসাইল-বানারী ইউনিয়নের একমাত্র সংযোগ সড়ক এবং দীঘিরপাড় ও রাজাবাড়ী চরের সড়কটিও।
নেত্রকোনা :নেত্রকোনার বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চলে পানি জমে থাকায় মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। জেলার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, বারহাট্টা, সদর উপজেলা, পূর্বধলাসহ বিভিন্ন উপজেলায় লক্ষাধিক মানুষ গত ক’দিন ধরে পানিবন্দি অবস্থায় আছে। জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার গ্রামীণ সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া :ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিতাস নদীর পানি বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই সরাইল উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।samakal.com
Check Also
ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়
দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …