লিবিয়া প্রশ্নে মিশর কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি

  মুহাম্মাদ ওবায়দুল্লাহ *
জাতিসংঘ-অনুমোদিত ও স্বীকৃত লিবিয়ান ন্যাশনাল অ্যাকর্ডের (জিএনএ) অনুগত বাহিনী রাজধানী ত্রিপোলি এবং লিবিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজির মাঝামাঝি আবু কুরাইনের অঞ্চলটিকে জেনারেল খলিফা হাফতারের অনুগত বাহিনীর দখল উদ্ধার করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।।
লিবিয়ার দ্বন্দ্বের উভয় পক্ষই সির্তে-জুফরা ফ্রন্টের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আল ওয়াতিয়া বিমান ঘাটিতে আমিরাতের ভবিষ্যতের আক্রমণ প্রতিরোধে তুরস্ক সাবধানতা অবলম্বন করছে।, তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হুলুসি আকর সোমবার লিবিয়া ও মাল্টার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে বৈঠক করেছেন। রাষ্ট্রপতি রেসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ঘোষণা করেছিলেন যে জাতিসংঘের সহায়তায় লিবিয়ায় একটি “নতুন চুক্তি” করা হবে। যদিও তুরস্ক বলছে, লিবিয়া সংকটের সমাধান শুধু রাজনৈতিক ভাবেই সম্ভব । তবু ও তুর্কি সরকার জিএনএ সরকারের সমর্থনে সামরিক সহ সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ত্রিপোলি সরকার ২০১৫ সালের অবস্থানে ফিরে আসার সুবিধার্থে সিরতে ও জুফরাকে মুক্ত করতে চায়। বেনগাজি জানে যে, সির্তে সহ তেল সমৃদ্ধ অঞ্চল গুলি হাত ছাড়া হলে বিতর্কিত জেনারেল খলিফা হাফতারকে বিদেশিদের সম্পূর্ণ সমর্থন হারাতে হবে। তুরস্ক ও রাশিয়া সহ বিশিষ্ট শক্তিগুলির কূটনৈতিক প্রচেষ্টা কী সির্তে ও জুফরাকে কেন্দ্র করে সহিংস সংঘাতকে বাধা দেবে? যদি দলগুলি ভবিষ্যতে তেলের রাজস্ব বরাদ্দের বিষয়ে একমত হয় তবে সির্তে কে ত্রিপোলি সরকারের হাতে এবং জুফরাকে তবরুক তথা বেনগাজি সরকারের হাতে সোপর্দ করার জন্য আলোচনার মাধ্যমে কোনও নিষ্পত্তি হতে পারে । এর উত্তর খুঁজে পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
মিশর, সির্তে এবং জুফরাকে তার “লাল রেখা” হিসাবে ঘোষণা করেছে, । রাশিয়ান ওয়াগনার গ্রূপ ও ভাড়াটিয়া বাহিনী যেখানে লিবিয়ায় সামরিক সমাধান আনতে ব্যর্থ হয়েছে সেখানে মিশরের সামরিক বাহিনীর সফল হোক- ফ্রান্স, গ্রিস এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত তা প্রত্যাশা করে । কায়রো লিবিয়ার সীমান্তের কাছে সামরিক মহড়া পরিচালনা করেছে এবং হাফতার ও তার সমর্থকদের মনোবল বৃদ্ধির চেষ্টা করেছে। এটা স্মরণ যোগ্য যে মিশর সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি ফলে লিবিয়ার উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ ত্রিপোলির সমর্থন থেকে বিরত রয়েছে। কায়রো সরকার বর্তমানে লিবিয়ায় একটি সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে। রাষ্ট্রপতি আবদেল-ফাত্তাহ আল-সিসির বক্তব্য হচ্ছে, পূর্ব লিবিয়ার উপজাতীয় নেতা, তব্রুকের পার্লামেন্টের চেয়ারম্যান আগুইলা সালেহ এর অনুরোধে মিশর লিবিয়াকে “তুর্কি দখল” থেকে রক্ষা করবে। একই সময়ে, মিশরের প্রধান মুফতি হাজিয়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদ হিসেবে ব্যবহারের অনুমতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন।
ন্যাটো-র সহায়তায় ফ্রান্স লিবিয়ার উপরে তুরস্কের প্রভাব হ্রাস করতে ব্যর্থ হয়েছে। জার্মানি, ফ্রান্স এবং ইতালি বাইরের শক্তি গুলোর লিবিয়ার সংঘাতে জড়িত হওয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা অনুমোদনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদি এই নিষেধাজ্ঞাগুলি পক্ষপাতমূলক ভাবে তুরস্ককে টার্গেট করে হয় তবে তা , আঙ্কারা এবং ব্রাসেলসের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কূটনীতিক হিসাবে, জোসেপ বোরেল বলেছেন, তুরস্কের সাথে সম্পর্ক পরিচালনা করা এই সংস্থাটির জন্য আজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বোরেল এই বিষয়টি খুব ভাল করেই জানেন যে ব্রাসেলস ও আঙ্কারার মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি শরণার্থী সংকট এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান সহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে সহায়তা করবে না। একক বৈদেশিক নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রে অক্ষমতার কারণে তিনি চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মের্কেলের কাছে সাহায্য প্রত্যাশী হওয়া ছাড়া তার হাতে আর কোন বিকল্প নেই।
লিবিয়ায় মিশরের সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের আরেক সমর্থক সংযুক্ত আরব আমিরাত কায়রোকে উৎসাহ দিয়ে তুরস্ক বিরোধী অবস্থান নিয়ে আরব জাতীয়তাবাদের আবেগকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করছে। (নিজেকে বাঁচানোর আগে) সৌদি আরবকে ইয়েমেনের যুদ্ধে টেনে নিয়ে যাওয়ার পরে, আমিরাতীরা এখন মিশরকে যার সমাপ্তি নেই এমন একটি যুদ্ধে জড়াতে উস্কানি দিচ্ছে। ইয়েমেনে জামাল আবদেল নাসেরের পরাজয়ের পর প্রথমবারের মতো, মিশর নিজেকে একটি ঝুঁকিপূর্ণ সংঘাতে জড়িয়ে ফেলছে। ২০১৩ সালের প্রথম অবাধ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট মুরসি ও তার সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান হাজার হাজার গণতণ্ত্রকামী নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার কারণে আরব বিশ্বের হেভিওয়েট হিসেবে সিসির ভাব মর্যাদা সব সময় কালিমা লিপ্ত রয়ে গেছে। এরপর ও মিশর কে উপসাগরীয় আরব ক্রাউন প্রিন্সদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য বলি দেওয়া হতে পারে। হাসপাতালে ভর্তি সৌদি বাদশাহ সালমান যদি মারা যান তবে তার ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের উপর সংযুক্ত আরব আমিরাতের পক্ষ থেকে মিশরের সহযোগিতার জন্য চাপ বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। দেখা যাক, এখন সিসি কী করেন ? তিনি কি সংযুক্ত আরব আমিরাত বা গ্রিসের অ্যাডভেঞ্চারিজম ও ভূমধ্যসাগরে ইসরাঈলের স্বার্থে লিবিয়ায় এক অন্তহীন যুদ্ধে জড়িয়ে দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেবেন ?
মিশরীয় শাসক, যিনি নীলনদের উপরে রেনেসাঁ বাঁধটি নির্মাণের ব্যাপারে ইথিওপিয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে চাপের মুখোমুখি রয়েছেন। , তিনি লিবিয়ায় সম্ভাব্য ব্যর্থ সামরিক অভিযান চালিয়ে তার নিজের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পথ সুগম করতে পারেন। মিশরীয় সামরিক বাহিনী, যে সিনাই উপদ্বীপে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গুলির বিরুদ্ধে লড়াই এ সফল হয় নি । তবুও সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষতার সাথে মিশরকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে কেবল তার ইস্রায়েলপন্থী মিশন কে বাস্তবায়ন করছে। পর্যবেক্ষকদের প্রশ্ন, মিশরীয় শাসক, অর্থনৈতিক সংকটের জন্য অসন্তুষ্ট মিশরীয় সেনাবাহিনীর মনোযোগ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার উদ্দেশ্যে কি তিনি লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করতে চলেছেন ? যে কোন সময় তার পরিণতি হোসনি মোবারকের মতো হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
*লেখক : শিক্ষক ও সংবাদ কর্মী

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।