সরকারি তথ্যে ফুটে উঠছে না প্রকৃত চিত্র স্থায়ী হতে পারে এবারের বন্যা:করোনা-বন্যার দুর্যোগে এলো ঈদ বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াই

স্টাফ রিপোর্টার :আরও একটি ঈদ রাত পোহানোর অপেক্ষায়। ত্যাগ আর উৎসর্গের আদর্শে মহিমান্বিত পবিত্র ঈদুল আজহা আগামীকাল শনিবার। এবারের ঈদ এসেছে এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। করোনা মহামারির সঙ্গে বন্যার আঘাতে বিপর্যস্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অগণিত মানুষ। তাদের জীবনের ওপর নেমে আসা এ দুঃসময়ের অন্ধকার কবে কাটবে, তাও অজানা। উৎসর্গের বাণী নিয়ে আসা কোরবানির এই ঈদে করোনা, বন্যায় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ালে তাদের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে।
রমজানের ঈদের মতো দিন গোনার আনন্দময় অপেক্ষা নেই ঈদুল আজহায়। আরও ৯ দিন আগেই জানা হয়ে গেছে ১ আগস্ট, শনিবার কোরবানির ঈদ। এবারের রোজার ঈদের মতো এই ঈদের সঙ্গেও আসেনি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়া চিরায়ত খুশির আমেজ। গত মার্চ থেকে শুরু হওয়া করোনা মহামারি তিন হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়েছে। লাখো মানুষের জীবিকা ছিনিয়ে নিয়েছে। রোজগার হারানো মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামমুখী হয়েছে। সঞ্চয় ভেঙে, ত্রাণে কিংবা ধারদেনায় যাদের জীবন চলছে তাদের ঘর থেকে ঈদ দূর আকাশের চাঁদের মতোই দূরের বিষয় হয়ে গেছে।
মাসখানেক ধরে চলা বন্যায় অর্ধকোটি মানুষ আক্রান্ত। গ্রামের পর গ্রাম, জনপদ, বসতবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। লাখো মানুষ আশ্রিত বাঁধে কিংবা শিবিরে। তাদের জীবনে এবারের জিলহজের চাঁদ ঈদ আনেনি। ঈদগাহ, মসজিদে থৈ থৈ পানি। ঈদের নামাজও হয়তো তাদের ভাগ্যে জুটবে না।
তবুও জীবনের গতি থেমে থাকে না কোনো বাধাতেই। যত দুর্যোগই থাকুক, ঈদ বলে কথা! সবকিছুর পরও এই দিনটিতে একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানাবে মানুষ। সাধ্যমতো দান, খয়রাত, কোরবানির মাংস বিলি, খাওয়া-দাওয়া হবে। দুঃসহ দিনে কিছুটা হলেও আনন্দের সুযোগ তৈরি হবে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে ঈদুল আজহার ত্যাগের শিক্ষায় সবাইকে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়াও দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরসহ শীর্ষ রাজনীতিকরা।
ধর্মীয় চিন্তাবিদরা বলেছেন, কোরবানির ঈদ যতটা না আনন্দের তার চেয়ে বেশি উৎসর্গের। পবিত্র কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, চার হাজার বছর আগে আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইব্রাহিম (আ.) তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু নিজ সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু আল্লাহর কুদরতে হজরত ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি হয়। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর এই ত্যাগের মনোভাবের কথা স্মরণ করে প্রতিবছর মুসলমানরা কোরবানি করে থাকেন।
শোলাকিয়া ঈদগাহর খতিব মাওলানা ফরিদউদ্দীন মাসঊদ বলেছেন, ঈদ মানে খুশি। কোরাবানির ঈদ একই সঙ্গে ত্যাগের। যাদের হারিয়েছি বন্যায়, করোনায় তাদের স্মরণ করতে, তাদের জন্য দোয়া করতে হবে। যারা অসহায় বিপদগ্রস্ত তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কোরবানি মানে শুধু পশু জবাই করে ভূরিভোজ নয়। কোরবানি মানে নিজেকে সর্বান্তকরণে উৎসর্গ করা। এই দুঃসময়ই নিজেকে উৎসর্গের সর্বোত্তম সময়।
কোরবানির মাংসের তিন ভাগের এক ভাগ দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করার বিধান রয়েছে। জিলহজ মাসের ১০ তারিখ পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হলেও ১০, ১১ ও ১২ তারিখের যে কোনো দিন পশু কোরবানি দেওয়া যায়। সে হিসেবে আগামী রবি ও সোমবারও কোরবানি করা যাবে।


তবে যে খামারি সারা বছর কোরবানির অপেক্ষায় থাকেন এবার তাদেরও দুর্দিন। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অনেকেই কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য হারিয়েছেন। পশুর হাটে স্বাস্থ্যাবিধি মানার প্রবণতা যেমন কম, গরু, ছাগলের চাহিদাও কম। ক্ষেত্রবিশেষে দামও কম। ফলে খামারিরা পড়েছেন লোকসানের মুখে। কয়েক বছর ধরে অনলাইনে গরু, ছাগল বিক্রি হচ্ছে। এবার অনলাইনে যতটা বিক্রির আশা ছিল, সেটাও হয়নি বলে জানা গেছে। করোনার কারণে সবাই আর্থিক সমস্যায় রয়েছেন। যিনি আগে একাই একটা গরু কোরবানি দিতেন, তিনি এবার কয়েকজনের সঙ্গে ভাগে দিচ্ছেন।
প্রতি বছর ঈদে শহর ছেড়ে স্বজনের কাছে গ্রামে ফেরেন কোটি মানুষ। পথে যানজট, ভাঙা সড়কে যত দুর্ভোগ হোক তবু ঘরে ফেরা চাই। করোনার কারণে ঈদুল ফিতরের সময় গণপরিবহন বন্ধ থাকায় স্মরণকালে প্রথমবার ঈদযাত্রা হয়নি। এবার গণপরিবহন চালু থাকলেও অনেকেই বাড়ি যাচ্ছেন না। আবার কাজ হারিয়ে অনেকে আগেই একেবারে গ্রামে চলে গেছেন। করোনার কারণে এবারও ঈদগাহের পরিবর্তে ঈদ জামাত হবে মসজিদে। রাজধানীতে প্রধান ঈদের জামাত হবে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে সকাল ৭টায়। রমজানের ঈদে রাজধানীর ছাদে ছাদে ঈদ জামাত হয়। এবারও একই আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে।

–0—-

টানা বন্যার সঙ্গে মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে নদী ভাঙন। কোনো কোনো এলাকায় দ্রুতই ভাঙছে জনপদ। ভাঙনের ফলে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে অসংখ্য পরিবার। নদী ভাঙনের ফলে সামর্থ্যবানরা অন্যত্র বাড়ি নির্মাণ করতে পারলেও দরিদ্র জনগোষ্ঠী পড়েছে মহাবিপদে। তারা কেউ অন্যের বাড়িতে সাময়িক আশ্রয় নিচ্ছে, আবার কেউ রয়েছে খোলা আকাশের নিচে। সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩০টি জেলায় নদী ভাঙন চলছে। এসব এলাকার নদী ভাঙন ঠেকানোর কাজও চলছে। চলমান বন্যায় সবচেয়ে বেশি ভাঙনের মুখে আছে ১২টি জেলা। এর মধ্যে বেশি ভাঙছে পদ্মাপারের জেলা শরীয়তপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ ও ফরিদপুর। এছাড়া ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও এর ছোট ছোট শাখানদীর তীরও ভাঙছে। নদী শাসনের অভাবে ও দুর্নীতির কারণে কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, জামালপুর, ভোলা, টাঙ্গাইল, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়েও ভাঙন চলছে। এতে ভবন, বাজার, বসতভিটা, ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সরকারি হিসাবের বাইরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে নদী ভাঙছে। সেসব ভাঙনের পরিসংখ্যান সরকারের নজরে আসছে না। বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদী ভাঙন আরও বাড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
দেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা ভোলার মানুষ নদী ভাঙনের কারণে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। জেলার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে তেঁতুলিয়া, পূর্বে মেঘনা আর উত্তরে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া মিলিত হয়েছে। প্রতি বর্ষায় জেলার শত শত পরিবার ভাঙনের শিকার হয়। মানচিত্র একসময় এই জেলাটির আকৃতি ছিল আমের মতো গোলাকার। মেঘনা ও তেঁতুলিয়ার ভাঙনে এটি এখন লম্বা শসার মতো হয়ে গেছে। জেলার উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার লম্বা এ জেলাটির পূর্ব ও পশ্চিমে প্রস্থ ছিল ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার। প্রায় ২৫ বছর ধরে টানা ভাঙনে এ জেলার প্রস্থ কোনো কোনো এলাকায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটারে পৌঁছেছে। ২৪ জুলাই ভোলার চরফ্যাশনে বেতুয়া নামক এলাকায় মেঘনার তীরে মাছ শিকার করতে যান স্থানীয় যুবক জসিম উদ্দিন। তীরে দাঁড়িয়ে নদীতে জাল ফেলার অবস্থায় পায়ের নিচের মাটিসহ তলিয়ে যান জসিম। দু’দিন পর ২৬ জুলাই তার লাশ ভেসে ওঠে। এভাবে প্রতিনিয়তই ভাঙছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ, হারাচ্ছে প্রাণও। এসব ভাঙন ঠেকাতে সরকারের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। প্রতি বছরই নদী ভাঙন ঠেকাতে বরাদ্দ আসে, তা ব্যয় হয় অপরিকল্পিতভাবে। ফলে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
জানা গেছে, শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলায় বেশি ভাঙছে। শুধু জাজিরা নয়, শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলাও এ বছর নতুন করে ভাঙনের মুখে পড়েছে। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ওই উপজেলায় ভাঙন কমছিল। তবে ২০১৮ সালে আবার ভাঙন শুরু হয়। ওই বছর প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা পদ্মার বুকে চলে যায়। এরপর ভাঙন রোধে শতাধিক কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প নেয় সরকার। যে কারণে গত বছর সেখানে কোনো ভাঙন হয়নি। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে সেই নড়িয়া আবারও ভাঙনের মুখে পড়েছে। নড়িয়া উপজেলার ছয়টি এলাকায় ভাঙন ঠেকাতে নির্মাণ করা অবকাঠামো সরে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। পদ্মার পাড় ধরে এক কিলোমিটার এলাকায় নির্মাণ করা প্রতিরক্ষা অবকাঠামোও ভাঙনের মুখে পড়েছে। এর প্রায় ৩০০ মিটার অংশের ব্লক সরে গেছে। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের শরীয়তপুর জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম আহসান হাবিব গণমাধ্যমকে বলেন, ভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলোয় জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। আর এবার বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং পদ্মায় তীব্র স্রোত হবে, সেটা ধারণার বাইরে ছিল। ভাঙন ঠেকাতে দিন-রাত কাজ চলছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় ২৬ জুলাই পর্যন্ত দেশের ৩১টি জেলায় ৪৫ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এদের মধ্যে প্রায় এক লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। বাকিরা সড়ক, বেড়িবাঁধ ও উঁচু স্থানে আশ্রয়ে আছেন। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আরও বেশ কয়েকদিন পদ্মার পানি বাড়তে পারে। এতে রাজধানীর নিম্নাঞ্চলে ঢুকে তা বিস্তৃত হতে পারে। বিশেষ করে ডেমরা-মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানি চলে আসবে। তবে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রে বন্যার পানি কমতে পারে।

Check Also

ঘোনা ইউনিয়নে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন

আবুল হোসেন সদর প্রতিনিধি : ঘোনা ইউনিয়নে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।