ড. মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন : ইসলামী শরিয়তে কুরবানির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যধিক। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহীম আ. স্বপ্ন কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে বৃদ্ধ বয়সে প্রিয় সন্তান হজরত ইসমাঈলকে আ. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মক্কার মিনা প্রান্তরে নিয়ে যান এবং কুরবানি করার জন্য কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। হজরত ইবরাহীম আ. ত্যাগ ও কুরবানির অনন্য নজির স্থাপন করায় দয়াময় মেহেরবান আল্লাহ তায়ালা তা কবুল করেন এবং তদস্থলে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দেন। ফলে শিশুপুত্র হজরত ইসমাঈল আ.-এর পরিবর্তে সেদিন মিনা প্রান্তরে দুম্বা কুরবানি হয়েছিল। হজরত ইবরাহীম আ.-এর সুন্নাহ হিসেবে ইসলামী শরিয়তেও সামর্থ্যবান মুসলমানদের ওপর কুরবানির এ বিধান ওয়াজিব করা হয়েছে।
প্রত্যেক জাতির ওপর কুরবানির বিধান ছিল আবশ্যক : মানবসভ্যতার শুরু থেকে প্রতিটি শরিয়তেই আল্লাহ তায়ালা কুরবানির বিধান আবশ্যক করে দিয়েছেন। আদি মানব হজরত আদম আ.-এর পুত্রদ্বয় হাবিল ও কাবিলের কুরবানির ঘটনা বর্ণনা করে সূরা মায়িদার ২৭নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের অবস্থা পাঠ করে শোনান। যখন তারা উভয়ে কিছু কুরবানি পেশ করেছিল, তখন তাদের একজনের কুরবানি গৃহীত হয়েছিল এবং অপরজনের কুরবানি গৃহীত হয়নি।’ প্রতিটি জাতির ওপর কুরবানির বিধান আরোপ করে দেয়ার বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা সূরা হজের ৩৪নং আয়াতে বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানি নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’
কুরবানি যাদের ওপর ওয়াজিব : কুরবানির জন্য দিন ও তারিখ আল্লাহ তায়ালা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। তা হলো, জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ। এ সময়ে যদি কোনো মুসলমান নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হন, তাহলে তার ওপর কুরবানি করা ওয়াজিব। আর সম্পদের নিসাব হলো, সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য কিংবা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ। দেশীয় মুদ্রার ক্ষেত্রে এ দুই ধরনের মুদ্রার মাঝে যেটির মূল্য কম সে পরিমাণ মুদ্রার মালিক হওয়া। আমাদের দেশে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের চেয়ে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের মূল্যমান কম হওয়ায় উল্লিখিত দিনগুলোয় কোনো মুসলমান স্থায়ী সম্পদ ব্যতীত এ পরিমাণ টাকার মালিক হলে তার জন্য কুরবানি করা আবশ্যক। কুরবানির নিসাবের জন্য এক বছর সময়কাল সম্পদ কাছে থাকা কিংবা এক বছর সময় অতিবাহিত হওয়ার কোনো শর্ত নেই। কাজেই জিলহজ মাসের উল্লিখিত দিনগুলোয় নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ কারো কাছে মজুদ থাকলে আল্লাহর নাম স্মরণ করে সে ব্যক্তিকে চতুষ্পদ জন্তু কুরবানি দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে সূরা হজের ২৮নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যাতে তারা নির্দিষ্ট দিনগুলোয় তাঁর দেয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে।’
কুরবানি আল্লাহর নিকট অত্যন্ত প্রিয় একটি আমল : জিলহজ মাসের উল্লিখিত দিনগুলোয় আল্লাহর নিকট বান্দার সর্বাধিক প্রিয় ‘আমল হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পশু কুরবানি করা।’ এ প্রসঙ্গে রাসূলে আকরাম সা. এরশাদ করেন, “কুরবানির দিনগুলোয় আল্লাহর নিকট বনী আদমের সর্বাধিক প্রিয় ‘আমল হচ্ছে পশুর রক্ত প্রবাহিত করা।’ কিয়ামতের দিন উল্লিখিত পশুর শিং, পশম ও ক্ষুরসহ হাজির হবে।” সামর্থ্য থাকার পরও কুরবানি না দেয়া ইসলামের দৃষ্টিতে চরম নিন্দনীয় কাজ। যে সকল ঈমানদারকে আল্লাহ তায়ালা সচ্ছলতা দান করেছেন, তাদের উচিত সে সচ্ছলতার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কুরবানি প্রদান করা। যারা কুরবানি করে না তাদের জন্য ‘ঈদুল আজহার সালাত আদায় করা এবং ঈদগাহ মাঠে হাজির হওয়ার কোনো গুরুত্ব বহন করে না।’ তাই রাসূল সা. বলেন, ‘কুরবানি দেয়ার সামর্থ্য থাকার পরও যে ব্যক্তি কুরবানি দেয় না, সে যেন আমার ঈদগাহ মাঠে উপস্থিত না হয়।’
কুরবানির মুখ্য উদ্দেশ্য তাকওয়া : কুরবানি দিতে হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। কুরবানি না দিলে সমাজের মানুষ কৃপণ ভাববে কিংবা ঈদের সময় নাতি-নাতনি-ঝি-জামাইদের গোশত দিয়ে মেহমানদারী করার জন্য কুরবানি দেয়া কিংবা সামাজিকভাবে নিজের স্ট্যাটাস ধরে রাখার জন্য সর্বোচ্চ দামি গরু কুরবানি দেয়ার চিন্তা করা ইত্যাদি মনোবৃত্তি কোনো ভাইয়ের মাঝে থাকলে তার কুরবানি কবুল হবে না। শুধুমাত্র আল্লাহর হুকুম পালন ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই একজন মুমিন ব্যক্তিকে কুরবানি দিতে হবে। কারণ জবেহকৃত প্রাণীর গোশত কিংবা রক্ত কিংবা গোশত ও রক্তের পরিমাণ আল্লাহর নিকট মুখ্য বিষয় নয়; বরং মুখ্য বিষয় হলো আল্লাহর বিধান মানার ক্ষেত্রে বান্দার একাগ্রতা ও আন্তরিকতা। এ প্রসঙ্গে সূরা হজের ৩৭নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এ সকল প্রাণীর গোশত ও রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছে না; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ আদি পিতা হজরত আদম আ.-এর পুত্র হাবিল ও কাবিলের দেয়া কুরবানির মাঝে হাবিলের কুরবানি কবুল হওয়ার কারণ বর্ণনা করে আল্লাহ তায়ালা সূরা মায়িদার ২৭নং আয়াতে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের নিকট হতে কুরবানি গ্রহণ করে থাকেন।’
কুরবানির গোশত বণ্টন : ইসলামী শরিয়তে কুরবানির গোশত নিঃস্ব, অনাথ ও হতদরিদ্র ব্যক্তিদের মাঝে বণ্টনের পাশাপাশি কুরবানিদাতার নিজের ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য খাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে, যেন সমাজের ধনীর অট্টালিকা থেকে গরিবের কুঁড়েঘর পর্যন্ত সর্বত্র ও সর্বশ্রেণির মাঝে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে সূরা হজের ৩৬নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা উহা হতে খাও এবং নিঃস্ব (অথচ যারা হাত পাতে না) এবং সাহায্যপ্রার্থীদের মাঝে তা দিয়ে দাও।’ হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস থেকে জানা যায়, রাসূল সা. কুরবানির দিন জবেহকৃত পশুর নিকট গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন এবং হজরত আলীকে রা. নির্দেশ দিলেনÑ কুরবানির গোশত, চামড়া ও জিনসহ সমুদয় বস্তু বণ্টন করে দেয়ার জন্য। এ হাদীসে কুরবানির সমুদয় গোশত বণ্টন করে দেয়ার নির্দেশনা থাকলেও হজরত জাবির রা. হতে বর্ণিত অপর একটি হাদীস থেকে জানা যায়, প্রথম দিকে সাহাবায়ে কেরাম ৩ দিনের বেশি কুরবানির গোশত খেতেন না। অত:পর রাসূল সা. আরো বেশি দিন কুরবানির গোশত রাখার অনুমতি দিয়ে বলেন, ‘তোমরা খাও, জমা করে রাখ এবং সাদাকা করে পুণ্য অর্জন কর।’
উল্লিখিত কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনার আলোকে ফুকাহায়ে কেরাম কুরবানির গোশত ৩ ভাগ করার পক্ষে মতামত পেশ করেছেন। তা হলো, ফকির ও মিসকিনের জন্য এক ভাগ, আত্মীয়-স্বজনের জন্য এক ভাগ এবং নিজেদের জন্য এক ভাগ। অভাবগ্রস্ত ও নিঃস্বদের মাঝে যারা হাত পাতে, তাদের মাঝে বণ্টন করার পাশাপাশি যারা হাত পাতে না, তাদের বাসায় কুরবানির গোশত পৌঁছে দিতে হবে। প্রতিবেশীদের মাঝেও যারা অভাব-অনটনের মাঝে রয়েছে, তারা সাহায্যপ্রার্থী হোক কিংবা না হোক, তাদের মাঝে কুরবানির গোশত বণ্টন করতে হবে। অনুরূপভাবে আত্মীয়-স্বজনের মাঝেও গোশতের নির্দিষ্ট ভাগ বণ্টন করতে হবে। গোশত বণ্টনের ক্ষেত্রে কৃপণতা করা কিংবা মনে কষ্ট পাওয়া সমীচীন নয়। নিঃস্ব কোনো প্রতিবেশী কিংবা কোনো সাহায্যপ্রার্থী কুরবানির গোশত চাইতে এলে বিরক্ত হওয়া কিংবা অনুগ্রহ করার মানসিকতা দেখিয়ে ২/১ টুকরা দেয়া অনুচিত। মূলত কুরবানির গোশত বণ্টনের মাধ্যমে গরিবদের প্রতি অনুগ্রহ করছি, এটি মনে করা উচিত নয়। কারণ এটি গরিবদের হক।
ভাগে কুরবানি দেয়া : সামর্থ্যবানদের আর্থিক সচ্ছলতা ও সক্ষমতা অনুসারে দামি পশু কুরবানি করা উচিত। কুরবানি দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো অবস্থাতেই যেন প্রদর্শনেচ্ছা না আসে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ‘আজকের বাজারের সবচেয়ে দামি গরু আমি ক্রয় করবÑ যেন বাজারে আগত সকল মানুষের মাঝে এবং মিডিয়ায় তা ব্যাপক হারে প্রচারিত হয়’ এ মানসিকতা থাকলে কুরবানি শুদ্ধ হবে না। পশু কুরবানি করার ক্ষেত্রে গরু, মহিষ, উট ইত্যাদি ১ থেকে ৭ জন যৌথনামে কুরবানি দেয়া যাবে। সুনানে ইবনে মাজাতে হজরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়, সফরে থাকাবস্থায় রাসূল সা. এবং সাহাবায়ে কিরাম প্রতি ১০ জনে মিলে একটি উট এবং ৭ জন মিলে একটি গরু কুরবানি করেছেন। আবার হজরত জাবির রা. হতে সুনানে ইবনে মাজাতে বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়, হুদায়বিয়া নামক স্থানে রাসূল সা.সহ সাহাবায়ে কেরাম উট এবং গরুর ক্ষেত্রে ৭ জনে মিলিতভাবে কুরবানি দিয়েছেন। যেহেতু কুরবানি কবুল হওয়ার ক্ষেত্রে খুলুসিয়াত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাই সামর্থ্যরে মাঝে একাকী কুরবানি দেয়া অধিকতর উত্তম।
কুরবানির শিক্ষা : ১. কুরবানির পশু জবেহ করার মাধ্যমে আমাদের পশু প্রবৃত্তিকে দমন করতে হবে এবং মনুষ্যত্ববোধের বিকাশ ঘটাতে হবে। ২. লোকদেখানো কিংবা নিজের বড়ত্ব প্রকাশ নয়, বরং শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই আমাদের কুরবানি দিতে হবে। ৩. জীবনের সব ক্ষেত্রে শতভাগ আল্লাহর গোলামি করার দীপ্ত শপথ নিতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়।
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …