এসপিকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে -র্যাব
* মামলার এজাহার ও পুলিশের বক্তব্যে গড়মিল
* এসপিকে গ্রেফতার দাবি আওয়ামী লীগ নেত্রীর
* ওসি প্রদীপের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন চান্দিনার ওসি ফয়সল
স্টাফ রিপোর্টার: সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলী করার নির্দেশ দিয়েছিলেন টেকনাফ থানার সদ্য প্রত্যাহার হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ। টেকনাফের বাহারছড়ার শামলাপুর চেকপোস্টে তল্লাশির সময় ওসির নির্দেশেই বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী সিনহাকে লক্ষ্য করে চারটি গুলী ছোড়েন। সব গুলীই সিনহার শরীরে লাগে। এতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ওসির সঙ্গে লিয়াকতের ফোনালাপের সূত্র ধরে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ তথ্য জানান। এ বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘ফোনালাপের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।’
র্যাবের একটি সূত্র জানায়, শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে মেজর (অব.) সিনহাকে গুলী করার ঘটনা ঘটে ৩১ জুলাই রাত ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে। এ সময় পরিদর্শক লিয়াকত ও তার দল ‘ডাকাত ধরা’র প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সিনহা সেখানে পৌঁছালে লিয়াকত পরিচয় জানতে চান। সিনহা গাড়ির ভেতর থেকে নিজের পরিচয় দেন। লিয়াকত তাঁকে হাত ওপরে তুলে বেরিয়ে আসতে বলেন। সিনহা বেরিয়ে আসার পরপরই লিয়াকত তাঁকে লক্ষ্য করে গুলীবর্ষণ করেন। ওসি প্রদীপের ফোনালাপের সূত্র ধরে একজন কর্মকর্তা জানান, রাত ৯টা ৩৩ মিনিটে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেনকে মোবাইলে ফোন করেন। ফোনে পুলিশ সুপার বিরক্ত হয়ে বলেন, এমন কী হয়েছে বলেন? জবাবে ওসি বলেন, ‘চেকপোস্টে লিয়াকত একটি গাড়িকে সিগন্যাল দিলে গাড়ি থেকে তাকে পিস্তল দিয়ে গুলী করে। তখন আমি বললাম, তুমি তাড়াতাড়ি তাকে গুলী করো। তখন সেও তাকে গুলী করেছে। আমি সেখানে যাচ্ছি।’ পুলিশ সুপার হঠাৎ এ কথা শুনে বলেন, ঠিক আছে যান। এর এক মিনিট পর রাত ৯টা ৩৪ মিনিটে পরিদর্শক লিয়াকত ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ সুপারকে ফোন করেন। লিয়াকত পুলিশ সুপারকে বলেন, ‘ঢাকা মেট্রো নম্বরে একটি গাড়িতে সেনাবাহিনীর পোশাক পরা এক ব্যক্তি। তাকে চার্জ করলে তিনি মেজর পরিচয় দিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে অস্ত্র তাক করলে আমি তাকে গুলী করি। একজনকে ডাউন করেছি, আর আরেকজনকে ধরে ফেলেছি।’ জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, ‘তোমারে গুলী করছে তোমার গায়ে লাগেনি, তুমি যেটা করছ সেটা তার গায়ে লাগছে।’ লিয়াকত বলেন, ‘জি, স্যার’। দুই পরিদর্শকের সঙ্গে কথোপকথনের ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাসুদ হোসেন একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ওসি ও লিয়াকতের কাছ থেকে ঘটনা শুনে প্রথমে পুলিশ দফতর ও পরে রামু সেনানিবাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জানাই। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলি।’ এই তল্লাশির বিষয়ে তিনি আগে থেকে কিছুই জানতেন না বলে জানান।
সিনহার মৃত্যুর পর ৩ জনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন তৎকালীন বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের প্রধান লিয়াকত। হত্যার বিষয়ে কথা হলেও মাদক বা অস্ত্র উদ্ধারের কোনো তথ্য ফোনালাপে পাওয়া যায়নি। ৩১ জুলাই রাত ৯টা ৩০ মিনিটে তৎকালীন বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের প্রধান পরিদর্শক লিয়াকত তার ব্যক্তিগত মোবাইল থেকে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপের অফিসিয়াল নম্বরে ফোন করেন। তিন মিনিট কথা বলেন তারা। এরপর ৯ টা ৩৩ মিনিটে মালখানার ইনচার্জ কনস্টেবল আরিফের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করেন। তার সাথে ১ মিনিট কথা বলেন। এরপর ৯টা ৩৪ মিনিটে কক্সবাজারের পুলিশ সুপারের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করেন লিয়াকত। সেখানে তাদের কথা হয় তিন মিনিট। কথোপকথনে লিয়াকত ঘটনা সম্পর্কে এসপিকে জানান। কিন্তু সেখানে মাদক ও অস্ত্র পাওয়ার কোনো কথা উল্লেখ করেননি।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা: সাবেক মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদকে মুহূর্তের মধ্যে তিনটি গুলীর মুখে পড়তে হয় বলে জানিয়েছেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন, চেকপোস্টে তিনি হাত উঁচু করে পুলিশের উদ্দেশে কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। সেই মুহূর্তে তাকে গুলী করা হয়। সিনহা হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছিলেন এমন একজন এ বর্ণনা দিয়েছেন। ৩১ জুলাই ঘটনার পরদিন ঈদের নামাজ পড়িয়ে গ্রামের বাড়ি যান ঘটনাস্থলের মসজিদের ইমাম। ছুটি শেষে ফেরার পর পরই তার সাথে কথা হয় একটি টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদকের। মসজিদের মোয়াজ্জিন এবং মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষার্থী কী দেখেছিলেন জানান তিনি। মসজিদের মোয়াজ্জিন বলেন, ‘একজন ভদ্রলোক উপরে হাত তুললো। আমি ছাদ থেকে কথা শুনিনি, তবে মনে হলো ভদ্রলোক হাত উঁচু করে কিছু বলছেন। হঠাৎ করেই ৩টি গুলী করা হলো। সেকেন্ড হবে না, একটার পর একটা গুলী চালানো হলো।’
এজাহারে যা বলা হয়েছে: বাহারছড়া শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে শুরুতেই মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন পরিদর্শক লিয়াকত আলী। অকথ্য ভাষায় গালাগালির পর টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপের পরামর্শে সিনহার ওপর গুলী চালান তিনি। ওসি প্রদীপের সঙ্গে মোবাইল ফোনে এর আগে লিয়াকত বলেন ‘ঠিক আছে, শেষ কইরা দিতাছি’। পুলিশের গুলীতে নিহত সিনহা হত্যা মামলার এজাহারে এমনটাই উল্লেখ করেন নিহতের বড় বোন শারমিন শাহরিয়া। তিনি দাবি করেন, সিনহার মৃত্যুর পরও শরীর-মুখে কয়েকটি লাথি মারেন ওসি প্রদীপ। চেহারা বিকৃত করতে ওসি তার পায়ের বুট দিয়ে মুখে আঘাত করেন। মামলার বাদি ও সিনহার বড় বোন শারমিন গণমাধ্যমকে বলেন, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপের নির্দেশেই সিনহাকে গুলী করেন পরিদর্শক লিয়াকত। খুব ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবেই এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছেন আসামীরা। হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে মাদকদ্রব্য ও সরকারি কাজে বাধা বিষয়ে মিথ্যা অভিযোগ তোলেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী, সাক্ষী ও স্থানীয়দের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার সত্যতা বেরিয়ে আসুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই। এজাহারে উল্লেখ করা হয়- মেজর (অব.) সিনহা স্বাভাবিকভাবে দুই হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে বের হন। লিয়াকত ক্ষেপে আরও গালি দিতে দিতে বলেন- ‘তোর মতো বহু মেজর আমি দেখছি, এইবার খেলা দেখামু’। একটু পাশে গিয়ে লিয়াকত টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে কল করেন, পরামর্শ করেন। কথোপকথনের একপর্যায় লিয়াকত মোবাইলে ওসিকে বলে- ‘ঠিক আছে, শেষ কইরা দিতাছি’। ফোন রাখার পরই নিজের পিস্তল দিয়ে সিনহাকে কয়েক রাউন্ড গুলী করেন। রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। জীবন বাঁচাতে ঘটনাস্থল থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলে কনস্টেবল সাফানুল করিম ও মো. মোস্তফা তাকে মাটির সঙ্গে শক্তভাবে চেপে ধরেন। এরপর মেজর (অব.) সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করতে লিয়াকত আরও এক রাউন্ড গুলী চালান। হত্যার পরপরই ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ঘটনান্থলে এসে মেজর (অব.) সিনহার শরীর ও মুখে কয়েকটি লাথি দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী সিফাতের মামা মাসুম বিল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, প্রথমে সিফাত ও শিপ্রার জামিন আবেদনে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হেয়ারিং করা হয়। সব সার্টিফায়েড কাগজপত্রের জন্য আবেদন করেছি। কাগজগুলো এলেই আমরা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ওদের জামিনের জন্য আবারও আবেদন করবো। সিফাত ও শিপ্রার সঙ্গে এখনও দেখা করতে পারিনি। শুধু কথা হয়েছে। সিফাতকে আবার পুলিশের দায়ের করা মামলার এজাহারে ৩০২ ধারায় আসামী রেখেছে। তিনি বলেন, সিফাতের ল্যাপটপ, হার্ডডিক্স, ঘড়ি ও জুতা পাওয়া যায়নি। শুধু আইফোন ও ক্যামেরা পাওয়া গেছে। সেগুলো জব্দ তালিকায়ও দেখায়নি পুলিশ।
ওসি প্রদীপ-এসপি মাসুদের ফোনালাপ খতিয়ে দেখছে র্যাব: সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ ও কক্সবাজারের এসপি মাসুদ হোসেনের যে ফোনালাপ গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে তা খতিয়ে দেখছে র্যাব। প্রয়োজনে এসপিকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে.কর্নেল আশিক বিল্লাহ এ তথ্য জানান। র্যাব পরিচালক আশিক বিল্লাহ বলেন, যে ফোনালাপ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এটা র্যাবের নজরে এসেছে। এই ফোনালাপের বিষয়টি যাচাই-বাছাই করছি। যাচাই করার সাপেক্ষে তদন্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরো বলেন, এই মামলায় মোট ৯ জন আসামীর নাম রয়েছে। এরমধ্যে ৭ জন আদালতে আত্মসমর্পন করেছে। বাকি দুজনের বিষয়ে আমরা খোঁজ খবর নিচ্ছি।
গুরুতর আহত সিনহাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল পুলিশ! : গুলীবিদ্ধ অবস্থায় আটক সিনহা রাশেদ জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছিলেন, তার (সিনহার) অস্ত্রের লাইসেন্স নীলিমা রিসোর্টে তার কক্ষে রয়েছে। পরে সেই কক্ষ থেকে দেশি বিদেশি মদ, এক পুরিয়া গাঁজাসহ শিপ্রা দেবনাথকে গ্রেফতার করা হয়। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী শিপ্রা দেবনাথের নামে রামু থানায় করা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলার এজাহারে এ কথা বলেছে পুলিশ। অথচ পুলিশই জানিয়েছিল, ‘পুলিশ বলছে, চেকপোস্টে পুলিশ গাড়িটি থামিয়ে তল্লাশি করতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত ওই সেনা কর্মকর্তা বাধা দেন। এই নিয়ে তর্কবিতর্কের একপর্যায়ে অবসরপ্রাপ্ত ওই সেনা কর্মকর্তা তার কাছে থাকা পিস্তল বের করলে পুলিশ গুলী চালায়। এতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা গুরুতর আহত হন। তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’ সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, গুরুতর আহত মেজর (অব.) সিনহাকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করল কখন এবং তিনি এত প্রশ্নের জবাবই বা দিলেন কীভাবে? তাছাড়া টেকনাফ থানায় দায়ের হওয়া মামলা, নিহত মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের বোন শাহরিয়া শারমিন ফেরদৌসের ফৌজদারি দরখাস্ত কিংবা পুলিশের বক্তব্যে কোথাও গুলীবিদ্ধ অবস্থায় সিনহাকে জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য ছিল না। তবে টেকনাফ থানায় নন্দদুলাল রক্ষিত যে মামলা দায়ের করেছেন, সেখানে সিনহাকে গুলীবিদ্ধ অবস্থায় আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের কোনো কথা উল্লেখ নেই। ওই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, চালকের আসনে থাকা ব্যক্তি নিজেকে সেনাবাহিনীর মেজর বলে পরিচয় দেন। আইসি স্যার (লিয়াকত আলী) তাকে গাড়ি থেকে নেমে হাত মাথার ওপর উঁচু করে দাঁড়াতে বলেন ও বিস্তারিত পরিচয় জানতে চান। কিছুক্ষণ পর মেজর পরিচয় দানকারী ব্যক্তি তর্ক করে গাড়ি থেকে নেমে আসেন। হঠাৎ কোমরের ডানপাশ থেকে পিস্তল বের করে গুলী করতে উদ্যত হন।’ এজাহারে বলা হয়, ওই সময় লিয়াকত আলী চার রাউন্ড গুলী ছোড়েন। সিনহার অস্ত্র নিজের হেফাজতে নেন। সিনহার সঙ্গে থাকা ব্যক্তির কাছ থেকে নাম ঠিকানা নেন এবং তাৎক্ষণিক গুলীবিদ্ধ ব্যক্তিকে দ্রুত কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর রাত ১১ টা ৫৫ মিনিটে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এসপিকে গ্রেফতার দাবি আওয়ামী লীগ নেত্রীর: সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ড ইস্যুতে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের গ্রেপ্তার ও রিমান্ড দাবি করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরওয়ার কাবেরী। একইসঙ্গে এসপি মাসুদ হোসেনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও পূর্ব অপরাধের বিচার দাবি করেছেন তিনি। এ দাবিতে নিজের ফেসবুক ওয়ালে একটি স্ট্যাটাস লেখেন জেলা আওয়ামী লীগ নেত্রী কাবেরী। স্ট্যাটাসে তিনি বলেন- ‘কক্সবাজার পুলিশ সুপার মাসুদ সাহেবকে অবিলম্বে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়া হউক। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড চাই। পূর্ব অপরাধেরও বিচার হউক।’ এদিকে তার এই স্ট্যাটাসে মুহূর্তের মধ্যেই ৫ শতাধিক কমেন্টস পড়ে। শত শত শেয়ার হয়ে যায়। সাহসী লিখনির জন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে অনেকেই। পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের বিরুদ্ধে এমন কঠোর স্ট্যাটাস দেয়ার কারণ সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেত্রী নাজনীন সরওয়ার কাবেরী গণমাধ্যমকে বলেন, কক্সবাজার জেলার কোনো থানায় টাকা ছাড়া মামলা হয় না। সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হয়। মামলার টাকার ভাগ পুলিশ সুপার পান। না হলে তিনি ব্যবস্থা কেন নেন না? তার দাবি, অনেক নিরীহ মানুষজনের পকেটে ইয়াবা, অস্ত্র ঢুকিয়ে দিয়ে ফাঁসানো হয়। অধীনস্থ অফিসারদের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগ করার পরও পুলিশ সুপার ব্যবস্থা নেন না। নাজনীন সরওয়ার কাবেরী বলেন, ব্যবস্থা তো নেন না, বরং শ্রেষ্ঠ অফিসার হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়। তিনি বলেন, মেজর সিনহা খুনের ঘটনায় জড়িত ইন্সপেক্টর লিয়াকতের সঙ্গে ফোনালাপে এসপি মাসুদ হোসেনের অপরাধ স্পষ্ট প্রমাণিত।
সিফাতের মুক্তির দাবিতে ডাকা মানববন্ধনে পুলিশের লাঠিচার্জ, আহত ১০: টেকনাফে পুলিশের গুলীতে সিনহা মো. রাশেদ খান নিহতের ঘটনায় গ্রেফতার প্রত্যক্ষদর্শী সাহেদুল ইসলাম সিফাতের মুক্তির দাবিতে ডাকা মানববন্ধনে লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ। এতে কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন। গতকাল শনিবার দুপুর ১২টায় বরগুনার বামনা উপজেলার কলেজ রোড এলাকায় সিফাতের সহপাঠী ও একই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করে। মানববন্ধন শুরু করলে পুলিশ বাধা দেয় এবং ব্যানার ও মাইক ছিনিয়ে নেয়। এরপরও মানববন্ধন চালিয়ে গেলে বামনা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইলিয়াস আলী তালুকদার এসে মানববন্ধনরত শিক্ষার্থীদের অতর্কিতে লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেন। এতে অন্তত ১০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। মানববন্ধনের আয়োজক বামনা সারওয়ারজান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মনোতোষ হাওলাদার বলেন, ‘সিফাত আমাদের একই এলাকার বাসিন্দা। তিনি অবসরপ্রাপ্ত মেজর রাশেদ নিহতের ঘটনায় একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। তাকে আটক করে দুটি মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে গ্রেফতার দেখিয়ে জেলহাজতে পাঠিয়েছে পুলিশ।’ তিনি বলেন, ‘বিনা অপরাধে এত বড় ঘটনার একজন সাক্ষীকে জেলে প্রেরণ কিছুতেই কাম্য নয়। আমরা দ্রুত সিফাতের মুক্তি দাবি করছি। একই সঙ্গে রাশেদ নিহতের ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’ এ বিষয়ে বামনা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইলিয়াস আলী তালুকদার বলেন, ‘এটি একটি রাষ্ট্রীয় স্পর্শকাতর বিষয়। আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও নিরাপত্তা রাখার স্বার্থে পুলিশ সদস্যরা কাজ করেছে। কাউকে লাঠিপেটার ঘটনা ঘটেনি।’
সিনহা হত্যা মামলায় চার আসামীকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু: অভিযুক্ত আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে র্যাব। গতকাল শনিবার দুপুর ২টার পর থেকে কক্সবাজার জেলা কারাগারের ফটকে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হওয়া ৪জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে র্যাব-১৫ এর তদন্ত দল। এছাড়া সাত দিন করে রিমান্ডে নেওয়া ৩ আসামী টেকনাফ বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির বরখাস্ত হওয়া ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী, বরখাস্ত টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতকে রোববার (৯ আগস্ট) র্যাব-১৫ এর হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে। কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর উপ অধিনায়ক মেজর মেহেদী হাসান এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে ঘটনার ক্লু উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা হবে।’ তবে কক্সবাজার জেলা কারাগারের জেল সুপার মোকাম্মেল হোসেন জানিয়েছেন, শনিবার (৮ আগস্ট) দুপুর দেড়টার দিকে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে মেজর সিনহা হত্যা মামলার রিমান্ডের আদেশ প্রাপ্ত ৭ আসামীর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নথিপত্র জেলা কারাগারে পৌঁছেছে। ফলে কারা ফটকে র্যাব সদস্যরা চার আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। রোববার ৭ দিনের রিমান্ডের আদেশপ্রাপ্ত আসামীদের র্যাব হেফাজতে নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। এরআগে রোববার রাতে টেকনাফ থানা পুলিশের সদ্য সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ সাত পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্ত অন্যরা হলেন- টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সদ্য সাবেক ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন।
ওসি প্রদীপের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন চান্দিনার ওসি ফয়সল: টেকনাফ থানার সমালোচিত ওসি প্রদীপ দাসের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন কুমিল্লার চান্দিনা থানার ওসি মো. আবুল ফয়সল। চট্টগ্রাম রেঞ্জ অফিস ডিআইজি কার্যালয়ের এক জরুরি আদেশে শনিবার কক্সবাজার পুলিশ সুপার কার্যালয়ে যোগদান করে টেকনাফ থানার দায়িত্ব নেবেন তিনি। শুক্রবার সন্ধ্যায় ডিআইজি কার্যালয় থেকে তার ওই বদলির আদেশটি কার্যকর করা হয়। ওসি আবুল ফয়সল ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর চান্দিনা থানায় ওসি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার পানিয়ারূপ গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ এর ছেলে। তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে স্নাতক পাসের পর ১৯৯৩ সালে উপপরিদর্শক (এসআই) হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। ২০০৯ সালে তিনি পুলিশ পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি লাভের পর ফেনীর দাগনভূঁইয়া থানা, কুমিল্লার দাউদকান্দি, তিতাস, হোমনা ও চৌদ্দগ্রাম এবং সর্বশেষ চান্দিনা থানায় ওসি হিসেবে দায়িত্বপালন করেন।
Check Also
তালায় ইউপি পরিষদ কক্ষে দুই সাংবাদিকের উপর হামলা, প্রতিবাদে মানববন্ধন
তালা প্রতিনিধি তালার ইসলামকাটি ইউনিয়ন পরিষদে সাংবাদিক আক্তারুল ইসলাম ও আতাউর রহমানের ওপর সন্ত্রাসী রমজান আলী …