কবি মতিউর রহমান মল্লিক: টুকরো কথন:মুহাম্মাদ ওবায়দুল্লাহ

মুহাম্মাদ ওবায়দুল্লাহ *

কালজয়ী প্রতিভা কবি মতিউর রহমান মল্লিক। একজন বাংলাদেশী কবি, সাহিত্যিক, সংগীত শিল্পী, সুরকার ও গীতিকার। তিনি বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। যিনি ইসলামী ধারায় অসংখ্য গান ও কবিতা রচনা করেছেন। তাকে অনেকেই সবুজ জমিনের কবি ও মানবতার কবি বলে থাকেন।

মতিউর রহমান মল্লিক ১৯৫০ সালের ১ মার্চ বাগেরহাট সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের বারুইপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। মৃত্যু ২০১০ সালে ঢাকায়। তিনি জাতীয় জাগরণের কবি, প্রকৃতির কবি, চির সবুজের কবি, মানবতার কবি, চেতনার কবি। তিনি একাধারে কবি , গীতিকার , সুরকার, সঙ্গীত শিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক। তার ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা অসংখ্য ছোট-বড় সাত্যি-সাংস্কৃতিক সংগঠন দেশের অfনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে। তার পরশ পেয়ে অগণিত তরুণ-কিশোর সংস্কৃতি কর্মী, শিল্পী বা সাহিত্যিক হিসেবে বেড়ে উঠেছে। তার মার্জিত স্বভাব, নিরব প্রতিভার উর্মিমালার তরঙ্গাভিঘাত পড়েছে বহু জীবনে । অত্র লেখকের জীবনেও তার কিছু ছিঁটে-ফোঁটা এসে পড়েছিল বৈ কি। তারই দু/ একটা পাঠকদের সামনে তুলে ধরলাম।
এক:
ছাত্র ইসলামী ফোরামে যুক্ত হওয়ার পরের বছর ১৯৮২ সাল ছিল ছাত্র ইসলামী ফোরাম থেকে কিছু ভাইয়ের বিচ্যুতির বছর । খালি গলায় অডিও ক্যাসেটে বা সরাসরি গান শুনি , ”যা কিছু করতে চাও করতে পারো, অনুরোধ শুধু এই ঘর ভেঙো না।”মোহিত হলাম, কান খাড়া করে শুনতে থাকি। তারপর ১৯৮৪ কি ‘৮৫ সাল , মতিউর রহমান মল্লিক রচিত, সুরারোপিত ও স্বকণ্ঠে পরিবেশিত প্রতীতি-১ ও প্রতীতি-২ অডিও ক্যাসেট বের হলো । আমি কোন কালেই গায়ক বা শিল্পী নই, আমার কণ্ঠে কোন মাধুর্য নেই তা পরিচিত জন মাত্রই জানেন। তারপরও কণ্ঠে জোড়া লেগে গেলো, “এ আকাশ মেঘে ঢাকা রবে না , আলোয় আলোয় হেসে উঠবে, এ নদী গতিহীন হবে না , সাগরের পানে ছুটে চলবে…… বা, “না হয় হলো মন শুকনো কোনো মরুভূমি, আশাহত হয়ো নাকো তুমি…….।
দুই:
বাগেরহাটে ছাত্র ফোরামের কাজ দেখা শোনা করার জন্য ভর্তি হলাম তখনকার পিসি কলেজের একমাত্র অনার্স বিষয় বাংলা বিভাগে।ওটা যে মল্লিক ভাইয়ের জেলা। পুলকিত হলাম , উনি ঢাকায় থাকলেও যোগাযোগ তো হবে। ’৮৬’র সদস্য সম্মেলন শেষে আমি নিউ এলিফ্যান্ট রোডের মাসিক কলম পত্রিকা অফিসে মল্লিক ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেলাম। উনি রুটি ও ভাজি দিয়ে দুপুরের আহার সারলেন। বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে আমাকে খাওয়ালেন। আমি নবাগত তার অফিসে, চুপ চাপ আছি। মল্লিক ভাইয়ের সাহিত্যিক বন্ধুরাও আছেন। সকলে মল্লিক ভাইয়ের সাথে মস্করা করছেন।শুনে যা বুঝলাম তার বিষয়টা নিম্নরূপ:
“মল্লিক ভাই তার প্রবাসী ভক্তদের আমন্ত্রেণে ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় অনুরক্তরা, ভাইকে অনেক গিফট বা হাদিয়া দেন। দেশে ফিরে উনি দুটা বাদে সকল গিফট বিভিন্ন জনের মাঝে বিলিয়ে দেন। রেখেছিলেন, টেপরেকর্ডার ও স্লিপিং ব্যাগ (যে টা শীতের রাতে ঠাণ্ডার মাঝে খুবই উষ্ণতাদায়ক)। এ দুটা জিনিস ও কেউ না কেউ তাদের প্রয়োজনে নিয়ে গেছে- আর ফেরত দেয়নি। এ ক্ষেত্রে খেয়াল করলাম, ভাবীর সরলতার প্রতি ও তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ।”
তিন:
ঈদুল ফিতর ( ১৯৮৭ সাল ) উপলক্ষে মল্লিক ভাই গ্রামের বাড়ি বারুইপাড়া আসছেন। বাগেরহাট শহর ছাত্র ফোরামে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ভাইকে অতিথি করে ঈদ পুনর্মিলনী করা হবে। প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের স্বার্থে আমি ঈদে সাতক্ষীরায় ফেরা স্থগিত করলাম। বাগেরহাট শহরে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করেই বারুইপাড়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। মল্লিক ভাইকে বাড়িতে পেলাম না। নামাজ শেষে ভক্ত কিশোর-যুবাদের নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছেন। শুধু বাড়ি বাড়ি নয়, বিলের আলে আলে বেড়াতেন। আল্লাহর সৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করতেন। সারাদিন অপেক্ষার পর কিছুটা রাত হলে তিনি সদলবলে বাড়িতে ফিরলেন। রাতের আহার শেষে সবার শোয়ার পালা। ৩০/৪০ জন কিশোর যুবকের শোয়ার ব্যবস্থা তো বাড়িতে নেই। মল্লিক ভাই সবাইকে আদেশ দিলেন, খেজুরের চাটাই ও মশারি আনতে। ওনাদের বাড়ির উত্তর ও দক্ষিণ উভয় পাশে রাস্তা। দক্ষিণ পাশের নির্জন রাস্তায় চাটাই পাতা হলো। খুঁটি পুঁতে মশারি টানানো হলো। উপরে তারকা খচিত আকাশ, আর দক্ষিণে দিগন্ত বিস্তৃত বিলের অবারিত মৃদুমন্দ বাতাসে আমরা নিদ্রাভিভূত হলাম।
বাগেরহাট পুরাতন কোর্ট মসজিদের দোতলায় ছাত্র ও সূধিদের নিয়ে ঈদ পুনর্মিলনী হলো। বক্তব্য শেষে মল্লিক ভাই গাইলেন,” তোমার সৃষ্টি যদি হয় এতো সুন্দর, না জানি তা হলে তুমি কত সুন্দর……. ।” শ্রোতৃ মণ্ডলি তার দরদ ভরা কণ্ঠের আবেশে চক্ষু-কর্ণ একাকার করে বিস্ময়ে বিমূঢ় হলো।
চার:
বাগেরহাট জেলা ছাত্র ফোরামের উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে এক পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে আমি আমন্ত্রণ পেয়ে যোগ দিলাম। মল্লিক ভাইয়ের সাথে দেখা করে বললাম, সাতক্ষীরা অন্বেষা সাহিত্য সংসদের উদ্যোগে একুশে ফেব্রূয়ারি উপলক্ষে “প্রতীতি” নামে একটি ’লিটিল ম্যাগ ‘ বের হবে -কিছু একটা লেখা দেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে আমার ডাইরিতে ছোট্ট ছড়া লিখলেন- যেটা ১৯৯৭ সালে “প্রতীতি” সংকলনে প্রকাশ পায়-
একুশ নাকি রক্তচূড়া,
একুশ নাকি ফাগুন,
একুশ নাকি অগ্নিগিরি,
জ্বালায় বুকে আগুন।
একুশ এলে, একুশ ডাকে
জাগুন সবাই জাগুন।
পাঁচ:
মতিঝিলের বিসিআইসি মিলনায়তনে ২০০৪ সালে কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলনে সাতক্ষীরার প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছি। সারা দেশ থেকে শতাধিক শিল্পী গোষ্ঠী/ সাংস্কৃতিক সংস্থা অংশ নিচ্ছে। দুপুরে সবার প্যাকেট খাবার গ্রহণ শেষ। বিরতির পর আবার প্রোগাম শুরুর দিকে।সবাইকে খাইয়ে মল্লিক ভাই স্টেজের পিছনের দিকে উপস্থিত। দর্শক সারিতে বসে দেখতে পেলাম, এদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মহীরুহ মীর কাশেম আলী ভাই মল্লিক ভাইয়ের পেটে হাত বুলিয়েছেন। পাশের ভাইকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, মল্লিক ভাই নিজে খেয়েছেন কি না তাই মীর কাশেম আলী ভাই জানার চেষ্টা করছেন। এটাই মতিউর রহমান মল্লিক যিনি অন্যদের খাওয়ানোর পর নিজের খাওয়ার কথা মনে থাকতো না ।
ছয়:
প্রত্যাশা প্রাঙ্গণ, বাংলাদেশ সংস্কৃতিকেন্দ্রের উদ্যোগে সংস্কৃতি বিষয়ক সাংবাদিক কর্মশালা -২০০৮ এর আয়োজন করা হয়েছে। আমি তখন বিনা প্রশিক্ষণে সাতক্ষীরার দৈনিক আলোর পরশ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক পদে বসে গেছি। নিজ তাগিদে মল্লিক ভাইয়ের বিশেষ অনুমতি নিয়ে ঐ কর্মশালায় যোগ দিলাম। কর্মশালা চলাকালীন রাতের খাবার গ্রহণ শেষ হলে সবাই বিশ্রামে গেলেও মল্লিক ভাই ঘুমাতে যান না। উৎসুক শিল্পীদের নিয়ে লেগে যান অন্য কাজে। আর তা হচ্ছে, নতুন গানের সুরারোপ। আবার তাও নিজের নয়।এমন এক রাতে তরুণ শিল্পীদের নিয়ে তিনি সুরের সাধনা করছেন। সে গানের ভাষা টা এ রকম: “ আকাশের ঐ নীল আর উদাসী হাওয়া, মাতাল করেছে আমার এ মন…………. । “ এই গানের গীতিকার আর কেউ নন, মল্লিকের স্নেহধন্য শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ। সারা দিনের কর্ম ব্যস্ততার পরে সুরারোপ চূড়ান্ত করে রাত প্রায় দুটার সময় ঘুমাতে গেলেন তিনি।
মল্লিক ভাই মাত্র ৬০ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তিনি যে রোগ ভোগের পর ইন্তেকাল করেছেন তাতে প্রতীতি জন্মানো অস্বাভাবিক নয় যে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে নিজ কাছে টেনে নিয়েছেন। এ উপমহাদেশে আল্লামা ইকবাল সহ অনেক কবি ও বাংলাদেশে কবি নজরুল ইসলাম ও ফররুখ আহমদের মতো অনেক কবির আবির্ভাব হয়েছে- যারা ইসলামী ও দেশজ বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন, সাহিত্য সাধনা করেছেন। কিন্তু সংগঠিত কোন সাংস্কৃতিক আন্দোলন রেখে যাননি। মল্লিক এ দিক থেকে ব্যতিক্রম। তিনি নিজ রচনা কর্ম সৃষ্টির চেয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন বেশি। তিনি চেয়েছিলেন, এক ঝাঁক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মী তৈরি করতে-যাদের রচনা-কর্ম বিশেষ করে গান নদীর দু কূল ছাপিয়ে অপসংস্কৃতির মূল কেন্দ্র ভূমিকে প্লাবিত করে এদেশের তরুণ জনতার মননে তাওহীদের প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করবে।
*লেখক: প্রভাষক, বাংলা বিভাগ. সাতক্ষীরা পিএন স্কুল অ্যান্ড কলেজ।

Check Also

তালায় ইউপি পরিষদ কক্ষে দুই সাংবাদিকের উপর হামলা, প্রতিবাদে মানববন্ধন

তালা প্রতিনিধি তালার ইসলামকাটি ইউনিয়ন পরিষদে সাংবাদিক আক্তারুল ইসলাম ও আতাউর রহমানের ওপর সন্ত্রাসী রমজান আলী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।