ক্রাইমবার্তা রিপোট : করোনা ভাইরাস মহামারিতে বিপর্যস্ত সার্কভুক্ত দেশগুলো। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, নেপাল ও আফগানিস্তানে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন কমপক্ষে ৩২ লাখ ২৫ হাজার ৮৮২ জন। এসব দেশে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মারা গেছেন কমপক্ষে ৬১ হাজার ৩৯৭ জন। সব দেশেই ঘটেছে সংক্রমণ। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ভারতের। ভারতে আক্রান্ত হয়েছেন কমপক্ষে ২৫ লাখ ৯০ হাজার ৫০১ জন। মারা গেছেন কমপক্ষে ৫০ হাজার ৯৯ জন। আর আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে ভাল অবস্থায় আছে শ্রীলঙ্কা।
সেখানে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আক্রান্ত হয়েছেন মোট ২৮৯০ জন। মারা গেছেন মাত্র ১১ জন। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরেই সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পাকিস্তানের। সেখানে আক্রান্ত হয়েছেন দুই লাখ ৮৮ হাজার ৭১৭ জন। মারা গেছেন ৬ হাজার ১৬৮ জন। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভয়াবহতার দিক দিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। এখানে শনিবারের তথ্য অনুযায়ী আক্রান্ত হয়েছেন দুই লাখ ৭৪ হাজার ৫২৫ জন। মারা গেছেন ৩ হাজার ৬২৫ জন। ভারতে প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১০০০। এ অবস্থায় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বেশির ভাগ দেশেই লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে। আবার কোনো কোনো দেশে স্থানীয় পর্যায়ে লকডাউন করা হচ্ছে।
রোববার ভারতে নতুন সংক্রমণ রেকর্ড করা হয়েছে ৬৩ হাজার ৪৮৯। মারা গেছেন ৯৪৪ জন। পাকিস্তানে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ৮৮ হাজার ৪৬১। মারা গেছেন ৬১৬৬ জন। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সেখানকার সিন্ধু প্রদেশে। সেখানে আক্রান্ত হয়েছেন এক লাখ ২৫ হাজার ৯০৪ জন।
ওদিকে, নেপাল সরকার ১০ই আগস্ট জেলা ও সাব-জেলা পর্যায়ের কর্তৃপক্ষকে স্থানীয় পর্যায়ে লকডাউন আরোপের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। সেখানে বেশির ভাগ রেস্তোরাঁ, হোটেল এখন খোলা থাকলেও সিনেমা হল, সেলুন এবং স্পা বন্ধ রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া তথা সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে নেপালে। ৫ই জানুয়ারি চীন থেকে ফেরা এক ব্যক্তির দেহে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় ২৩ শে জানুয়ারি। ২রা জুলাই দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশে কমপক্ষে একজন করে করোনা রোগী শনাক্ত হয়। লকডাউন আরোপ করে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও মালদ্বীপ। কোয়ারেন্টিন কারফিউ জারি করে শ্রীলঙ্কা। দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করে ভারত ও নেপাল। আন্তর্জাতিক সফরের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম কঠোরতা অবলম্বন করে কিছু দেশ। কিছু দেশ তাদের সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। স্থগিত করে দেয় বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের দিক দিয়ে চীনকে টপকে যায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান। মধ্য মে’তে চীনকে এ হিসাবে টপকে যায় প্রথম দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে ভারত। এরপর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে পাকিস্তান চীনকে টপকে যায়। ১৩ই জুন চীনকে টপকে তৃতীয় দেশ হয় বাংলাদেশ। আবার ১০ই জুন সক্রিয় সংক্রমণের চেয়ে প্রথম সুস্থ হওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায় ভারতে। এ ঘটনা ৩রা জুলাই ঘটে পাকিস্তানে। আর ১২ই জুলাই একই ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে।
সার্কভুক্ত দেশগুলো করোনা মহামারিতে সহযোগিতামুলক পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নেয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এমন প্রস্তাব করেন। তিনি এক কোটি ডলারের একটি তহবিল গড়ে তোলার আহ্বান জানান। এতে সাড়া দেয় শ্রীলঙ্কা। তারা ১১ই এপ্রিল ঘোষণা দেয় যে, সার্ক কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি ফান্ডে ৫০ লাখ ডলার দেবে। পাকিস্তান ৩০ লাখ ডলার, বাংলাদেশ ১৫ লাখ ডলার দিতে সম্মত হয়। আফগানিস্তান ও নেপাল ১০ লাখ ডলার করে দিতে রাজি হয়। অন্যদিকে মালদ্বীপ দুই লাখ ডলার এবং ভুটান এক লাখ ডলার দিকে সম্মত হয়।
বাংলাদেশে মার্চে বিস্তার শুরু হয় করোনা ভাইরাসের। ৭ই মার্চ আইইডিসিআর দেশে প্রথম তিনজন করোনা আক্রান্ত শনাক্ত করে। ২৯ শে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার মোট পরীক্ষা চালায় ১০৯৫ জনের নমুনা। তাতে মোট ৪৮ জন করোনা শনাক্ত হন। সুস্থ হন ১৫ জন। মারা যান ৫ জন। ২২ শে মার্চ বাংলাদেশে ২৬ শে মার্চ থেকে ৪ঠা এপ্রিল পর্যন্ত শাটডাউন ঘোষণা করে। এর পর থেকে প্রতিদিনই সংক্রমিতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন সংখ্যা। এখনও এখানে বন্ধ রয়েছে স্কুল কলেজ। তবে সীমিত পরিসরে খুলেছে অন্য সব প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস।
ভুটানে ৬ই মার্চ প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি মার্কিন একজন ৭৬ বছর বয়সী পুরুষ। তিনি ভারত হয়ে ভুটানে সফর করছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন এমন প্রায় ৯০ জনকে কোয়ারেন্টিনে নেয়া হয়। দু’সপ্তাহের জন্য বিদেশি পর্যটকদের প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করে ভুটান। ২০ শে মার্চ মার্কিন ওই পর্যটকের ৫৯ বছর বয়সী সঙ্গীর দেহে করোনা পজেটিভ পাওয়া যায়। ২২শে মার্চ ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগায়েল ওয়াংচুক জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। এতে তিনি স্থল সীমান্তগুলো বন্ধ করেন দেয়ার ঘোষণা দেন। ২৪ শে মার্চ ভারতের সঙ্গে সব সীমান্ত বন্ধ করে দেয় ভুটান সরকার। ২৫ শে মার্চ দেশে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে বৃটেন ফেরত একজন ছাত্রের শরীরে করোনা ভাইরাস পজেটিভ পাওয়া যায়।
শুধু সার্ক বা দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, সারা এশিয়ায় এখন সবচেয়ে বেশি করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ভারতে। এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের পরেই সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের স্থানে চলে আসে ভারত। ১৯ শে মে এই সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যায়। ৩রা জুন দুই লাখ ছাড়িয়ে যায়। ১৭ই জুলাই তা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত হয়েছে মুম্বই, দিল্লি, আহমেদাবাদ, চেন্নাই, পুনে ও কলকাতায়। ২৪ শে মে পর্যন্ত লক্ষদ্বীপ সেখানকার একমাত্র অঞ্চল, যেখানে করোনা সংক্রমণ ঘটেনি। ভারতের সুস্থতার শতকরা হার ২৩ শে জুলাই ছিল ৬৩.১৮ ভাগ। ২২ শে মার্চ ভারতে ১৪ ঘন্টার জন্য পালন করা হয় স্বেচ্ছায় জন-কারফিউ। ২৪ শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশজুড়ে ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেন। এতে ভারতের ১৩০ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। ১৪ই এপ্রিল লকডাউন বৃদ্ধি করা হয় ৩রা মে পর্যন্ত। তা আবার দুই সপ্তাহের জন্য ১৭ই মে পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। ভারতে একটিমাত্র প্রদেশ মিজোরামে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১০০০-এর নিচে।
মালদ্বীপে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় ৭ই মার্চ। সেখানকার কুরেদু রিসোর্ট এন্ড স্পা’তে সময় কাটিয়ে ইতালিয়ান একজন পর্যটক ফিরলে তার দেহে করোনা ধরা পড়ে। দেশটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক এজেন্সি ওই রিসোর্টের দু’জনের দেহে করোনার উপস্থিতি পান। এরপর থেকে ওই হোটেল লকডাউন করা হয়। এতে আটকা পড়েন বেশ কয়েকজন পর্যটক। ১১ই মার্চ কুরেদু, ভিলামেন্দু, বাতালা এবং কুরামাথি দ্বীপকে অস্থায়ী কোয়ারেন্টিনে নেয়া হয়। ১২ই মার্চ কোভিড-১৯ নিয়ে জন স্বাস্থ্য বিষয়ক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে মালদ্বীপ। ২৭ শে মার্চ সেখানে প্রথম স্বদেশীয় এক ব্যক্তির দেহে করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে। তিনি বৃটেন থেকে দেশে ফিরেছিলেন।
চীনের উহান থেকে রাজধানী কাঠমান্ডুতে ফেরার পর নেপালি একজন শিক্ষার্থীর দেহে প্রথম করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে। এটাই দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম করোনা সংক্রমণ। দ্বিতীয় আক্রান্ত শনাক্ত হয় ২৩ শে মার্চ। ১৪ই মে পর্যন্ত নেপালে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪৯। বন্ধ করে দেয়া হয় চীন ও ভারতের সঙ্গে সব সীমান্ত। সাময়িক স্থগিত করা হয় সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠিানের পরীক্ষা বাতিল করা হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় স্কুল কলেজ। দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করা হয় ২৪ শে মার্চ। তা শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৮ই মে। ‘ভিজিট নেপাল ইয়ার ২০২০’ বিষয়ক কর্মকান্ডের আন্তর্জাতিক প্রোমোশনাল কর্মকান্ড বাতিল করে নেপাল। করোনা ভাইরাসের কারণে সেখানে বিদেশি কর্মক্ষেত্র, পর্যটন, উৎপাদন, নির্মাণ এবং বাণিজ্য- সবই আক্রান্ত হয়েছে। এর মারাত্মক ক্ষতিকর একটি প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে।
পাকিস্তানেও করোনা অবস্থা ভয়াবহ। ভারত, রাশিয়া, ইরান, সৌদি আরবের পর এশিয়ায় সংক্রমণের দিক দিয়ে পাকিস্তান ৫ম স্থানে উঠে আসে। দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান হয়ে ওঠে দ্বিতীয়। প্রথম স্থানে থাকে ভারত। পাকিস্তানে মৃত্যুর হার শতকরা ২.১৪ ভাগ, যা এশিয়ার অন্যান্য স্থানের মতোই। ১০ই আগস্ট পর্যন্ত পাকিস্তানে মোট করোনা সংক্রমিত হয়েছেন প্রায় দুই লাখ ৮৭ হাজার মানুষ। করোনায় ওই তারিখ পর্যন্ত মারা গেছেন প্রায় ২৩০০০ মানুষ। ৯ই মে পর্যন্ত পাকিস্তান ছিল দেশজুড়ে লকডাউনের অধীনে। ১লা এপ্রিলে এই লকডাউন ঘোষণা করে তা দুই দফা বৃদ্ধি করা হয়। করাচিতে আক্রান্ত হয়েছেন রেকর্ড ৮৯০০০ মানুষ। দেশে যত মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন তার মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগের বেশি আক্রান্ত হয়েছেন এই করাচিতে। ওদিকে ১১ই আগস্ট পর্যন্ত আরেকটি বড় শহর লাহোরে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৮০০০ মানুষ। ইসলামাবাদ ক্যাপিট্যাল টেরিটোরি এবং পেশোয়ার ডিস্ট্রিক্টে আক্রান্ত হয়েছেন ১০০০০ মানুষ। করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ ও পেশোয়ারে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৬৬ হাজার মানুষ।
৬ই জুলাই নাগাদ শ্রীলঙ্কায় করোনায় আক্রান্ত হন ২০৭৬ জন। এ সময়ের মধ্যে মারা গেছেন ১০ জন। ১লা আগস্ট পর্যন্ত বিদেশি আগমন সেখানে নিষিদ্ধ করা হয়। করোনার কারণে সরকার সব রকম পাবলিক ইভেন্টের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। পরবর্তী নোটিশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয় সব স্কুল। সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে শ্রীলঙ্কা অনেক ভাল অবস্থানে আছে। দীর্ঘ সময় সেখানে করোনা সংক্রমণ ঘটেছে। কিন্তু তারা এতে আক্রান্তের সংখ্যাকে সীমিত রাখতে সক্ষম হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় করোনায় মৃত্যুর হার শতকরা ০.৫ ভাগের কাছাকাছি।