হিজল বনে পালিয়ে গেছে পাখি যতই তারে করুণ কেঁদে ডাকি

কবি গোলাম মোহাম্মাদ : গান ও কবিতা
মুহাম্মাদ ওবায়দুল্লাহ

’হিজল বনে পালিয়ে গেছে পাখি
যতই তারে করুণ কেঁদে ডাকি
দেয় না সাড়া নিরব গহীন বন
বাতাসে তার ব্যথার গুঞ্জরণ ।
কোথাও সাগর আকাশ মুখোমুখি
কিংবা পাতা ফুলের লুকোলুকি
—————————
বিচিত্র এই অনন্ত সংসার
সবাই শুধু ছুটছে দুর্নিবার
পাখির পাখায় সময় সন্দীপন
হৃদয় বুঝি তাই করে ক্রন্দন। ’
এই গান অনেকেই শুনেছেন,কিন্তু এ রকম সুন্দর গানের গীতিকার কে তা অনেকেই জানেন না। গান তো এক ধরনের গীতি কবিতা।এ রকম সুন্দর শব্দ চয়ন, উপমা , শব্দ বিন্যাস, বিষয় ও ভাব গাম্ভীর্য এর স্রষ্টা আর কেউ নন- তিনি অকালে এ পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া কবি গোলাম মোহাম্মাদ।তিনি তার গান ও কবিতায় বাংলাদেশের প্রকৃতিকে এনেছেন। এর গাছ-গাছালি, ফুল, পাখি,আকাশ,বাতাস,সাগর ,বনানী ইত্যাদিকে উপস্থাপণ করেছেন। পাশাপাশি বিশ্ব স্রষ্টার সুমহান ধ্যান ও এর সৌন্দর্য সুষমাকে তার সাথে সমন্বিত করে এক অপরূপ আবহ তৈরি করেছেন। এই গানে কবি যেমন প্রাকৃতিক দৃশ্যের সার্থক আবতারণা করেছেন, সাথে সাথে ’সবাই শুধু ছুটছে দুর্নিবার” বাক্যের মধ্য দিয়ে প্রকান্তরে সুরা তাকাছুরের শিক্ষাকেই তুলে ধরেছেন।
কবি গোলাম মোহাম্মাদ ১৯৫৯ সালে মাগুরা জেলার গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। আশির দশকের অন্যতম আদর্শবাদী কবি। কবি গোলাম মোহাম্মদের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে,অদৃশ্যের চিল (১৯৯৭), ফিরে চলা এক নদী (১৯৯৮), হিজল বনের পাখি (১৯৯৯), ঘাসফুল বেদনা (২০০০) হে সুদুর হে নৈকট্য (২০০২), এছাড়া ছড়া গ্রন্থ,’ ছড়ায় ছড়ায় সুরের মিনার’ (২০০১) এবং নানুর বাড়ী (২০০২)। কবির প্রকাশিত প্রতিটি গ্রন্থই ব্যাপকভাবে পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে। তিনি শুধু গান-কবিতা লিখতেন না – ছবিও একেঁছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। চারু শিল্পী হিসেবে বিশেষ করে ক্যাালওগ্রাফিতে তার দক্ষতা ছিলো অসাধারণ।
ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক, সাহিত্য সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ যতই কবির লেখা পড়েছেন, ততই বিস্মিত হয়েছেন যে এমন নিভৃতচারী, প্রচার বিমুখ ব্যক্তি তার লেখার ভাব ও ভাষার ক্ষেত্রে কতটা পারঙ্গম হতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘কবিতা লিখতেন গোলাম মোহাম্মদ (১৯৫৯-২০০২), গান লিখতেন, ছবি আঁকতেন। তাঁর ছোট প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছিলেন শিল্পকোণ। মানুষটি ছিলেন যেন একটি বিজনতার অধিবাসী, স্মিতহাস্যময়, স্বল্পভাষী। ছন্দোবদ্ধ পদ লেখেন যাঁরা, তারা সবসময় পদ্যে পড়ে থাকে, কবিতায় উত্তীর্ণ হয় না। গোলাম মোহাম্মদের কবিতায় পেতাম কবিতারই আস্বাদ।’ (হিজল বনেরপাখি, কবি গোলাম মোহাম্মদ স্মারক,পৃষ্ঠা:৭)
”মায়ের কথা মনে পড়ে গানে” ছোট্ নদীর কথা,ফুল ঝরে যাওয়া, বোশেখের ঝড়,ভোরের পাখির গান, মাঠের ধান, খুকির চুল,নদী তীরের বালু ওড়া-উড়ি,মাঠের রাঙা আলু,মায়ের শিরনি রাঁধা -প্রভৃতির মাধ্যমে যেমন চিরায়ত বাংলার এক দৃশ্যকল্প হাজির করেছেন-অপর দিকে মায়ের ছোট্ট মাটির ঘরে প্রস্থানকে এক সকরুণ মায়াবী চিত্রের মাঝ দিয়ে পাঠক ও শ্রোতাদের মনকে তার সাথে একাকার করেছেন। গানটিতে আমরা একটু চোখ বুলিয়ে নেই।
আমার মায়ের কথা শুধু মনে পড়ে ,
মা যে আমার কেমন আছে দুরের মাটির ঘরে ।
কেমন আছে ছোট্ট নদী টুকু
কেমন আছে মিষ্টি আমার খুকু,
কত ফুল যে ঝরে পড়ে
কাল বোশেখির ঝড়ে ।
ওদের মাঠে কেমন হলো ধান ?
ভোরের পাখি কেমন করে গান ?
কেমন আছে ঝরা পাতা ফুল।
নদীতে ওড়ে নাকি বালু ,
মাঠে মাঠে হয় কি রাঙা আলু ?
মা কি এখন শিরনি রাঁধে-
সে সব মনে পড়ে।
কবি ’এই নদীর দেশে, পলির দেশে’তে এদেশের নদীও তার পলি,এর মিষ্টি শীতল পানির কথা বলেছেন,ছায়া ঢাকা বন-বনানীর কথা তুলে ধরেই তিনি মহান আল্লাহ তাআলার প্রসংশা করেছেন, কৃতজ্ঞতার ভারে মাথা আনত করেছেন।
এই নদীর দেশে, পলির দেশে
যিনি আমায় ভালোবেসে
সৃজন করেছে ।
হাজার শোকর দরবারে তার
প্রশংসা গাই লক্ষ্ হাজার
যিনি আমায় রহম দিয়ে
সুস্থ রেখেছে ।
মিষ্টি শীতল নদীর পানি
ছায়া ঢাকা বন বনানী
প্রশংসা তার লক্ষ্ হাজার
যিনি দিয়েছে।
দেশের প্রতি ভালোবাসা , প্রকৃতির নিখুঁত চিত্র তুলে ধরা ও মানবিকতার জয়গান,মজলুম ও স্বাধীনতাকামী মানুষের হৃদয়ের আকুতি বাঙ্ময় করার দিক দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কবি। কবির লেখায় উঠে এসেছে এ দেশ, এদেশের সমাজ-সামাজিকতার হাজারো চিত্র। কবিতা, ছড়া এবং গানে তিনি দেশ ও জাতির মুসলিম উম্মার জন্য বলিষ্ঠ ভাষায় সাহসী উচ্চারণ করেছেন। আল কুরআনের ভাষায় যে সমস্ত কবিরা “ প্রান্তরে প্রান্তরে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায় ‘ তিনি তাদের বিপরীতে এক বিশ্বাসীদের এক সার্থক স্রোতধারা সৃষ্টিতে সফল হয়েছেন। হামদ, না’ত, ইসলামী গান ও দেশাত্মবোধক সহ বিভিন্ন বিষয় মিলিয়ে তিনি ছয় শতাধিক গানের রচয়িতা।তিনি নিভৃতচারী ঠিকই কিন্তুএকটি সুন্দর মানবিকতাপূর্ণ সমাজের প্রত্যাশা ও চেষ্টায় ছিলেন নিরন্তর-তার লেখণীতে উচ্চারিত হয়েছে-
’সেই সংগ্রামী মানুষের সারিতে
আমাকেও রাখিও রহমান
যারা কুরআনের আহ্বানে নির্ভীক
নির্ভয়ে সব করে দান।
———————————————
শাহাদাতে চলে শত ব্যথা ভুলে
তোমার প্রেমের ফুল হৃদয়ে তুলে
আছে সেই আলোময় ফুলের পথে
বিজয়ের পূত উদ্যান।’

তিনি সব কিছু উজাড় করে আল কুরআনের শাসনের আল্লাহর কাছে আকুতি জানিয়েছেন-

‘খোদা সকল কিছুর বদল হলেও
তোমার শাসন দাও/ শক্তি নাও মোর সম্পদ নাও
না হয় আমার জীবন নাও’।

‘হলদে ডানার সেই পাখিটি’ শীর্ষক গানে তিনি শান্তি, স্থিতি,মানবিকতার অবর্তমানে এর প্রভাব শুধু যে সমাজে পড়ে না সাথে সাথে প্রকৃতিতেও এর ছায়াপাত ঘটে। খুন-খারাবি, জুলুম-নির্যাতন, অনাচার-অবিচারে ভরে যায়-
‘হলদে ডানার সেই পাখিটি
এখন ডালে ডাকে না

মনের কোণে রঙিন ছবি

এখন সে আর আঁকে না।

এখন কেন হচ্ছে মানুষ খুন ?

নফসের দাসত্বের বিপরীতে পবিত্রতা অর্জনকেই মুখ্য করেছিলেন। স্রষ্টার সৃষ্টির মহিমা তিনি যতই অবলোকন করেছেন, ততই তিনি সিজদাবনত হয়েছেন। তিনি যিকিরের মাধ্যমে ,কালামের ভাষার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে মনের আকুতি পেশ করেছেন।
’হে ঘুম জড়তা অবসাদ
তোমরা আমাকে নিষ্কৃতি দাও।
আমাকে কথা বলতে দাও পরম সত্যের সাথে
আমাকে বলতে দাও, অশ্রূ ফেলতে দাও
বিনীত উচ্চারণে আমাকে প্রার্থনা করতে দাও
তোমাদের সাথে তো আছি ৪২ বছর
ঘুমে অলসতায় অসতর্ক চেতনাহীন।
হে কান্তি
নিমগ্ন হতে দাও যিকিরে যিকিরে
ডুবে যেতে দাও অনন্ত সুরের সাথে
আমাকে উচ্চারণ করতে দাও মাগফেরাতের
শব্দমালা, পবিত্র কালামের ভাষা
শব্দের অলঙ্কারে ধ্বনির মাধুর্য হৃদয়ের
সবটুকু নিবেদন।
আমাকে জাগতে দাও। কাঁদতে দাও
চাইতো দাও প্রভুর কাছে দু’হাত ভরে। ’
শব্দে-ছন্দে, ভাব-কল্পনায়, আদর্শ-উদ্দীপনায়, গোলাম মোহাম্মদের কবিতা অতুলনীয়, অসাধারণ ও অনন্য। তার কবিতা পাঠককে পুলকিত, শিহরিত ও চমকিত করে, মনকে আন্দোলিত করে, উদ্দীপিত করে, বিমোহিত করে। তার গান কবিতা একজন মানুষকে বিশেষত তরুনদের আদর্শবান, বড় ও ভালো মানুষ হবার স্বপ্ন জাগায়। স্রষ্টায় আত্মনিবেদিত হতে , আল-কুরআনের পতাকাবাহী হতে স্বপ্নাতুর করে। পাঠক বর্গ আমি এখানেই থেমে যেতে পারতাম। কিন্তু একটি কবিতা উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না। আর তা হচ্ছে কবির তরুণ-যুবকদের উদ্দেশ্যে লিখিত ‘হে দ্রুতগামী’ শীর্ষক কবিতা-
‘যুবক উঁচু মাথা খোলা তলোয়ার
আল্লাহর রঙ যে তোমাকেই মানায়
তোমার গরান কাঠের মতো বাহুতে
যদি ফসলের মাঠের মতো পতাকা উড়তে থাকে ।
যদিএগিয়ে চলা মিছিলের মাঝে
ফেটে পড়ে তোমার বজ্রের মতো শ্লোগান ।
—————————————————
দুর্গন্ধ ঘৃণার নিচে কেন তুমি ডুবে যাবে ?
এই আলোর নদীতে এসো,
হাল ধরো দূর যাত্রায় ।
সবই তো সময়ের শিমুল-পলাশ
জান্নাতের সুঘ্রাণে ভরে তোল আকাশ-বাতাস।’
————–০—————-
*লেখক: প্রভাষক , বাংলা বিভাগ, সাতক্ষীরা পিএন স্কুল অ্যান্ড কলেজ।

Check Also

সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা  অনুষ্ঠিত হয়েছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।