তুরস্ক, পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও লুজান চুক্তি

মুহাম্মাদ ওবায়দুল্লাহ* ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের জলসীমায় আবিষ্কৃত গ্যাসকে কীভাবে উন্নয়ন ও রপ্তানির কাজে লাগানো যায় সে উদ্দেশ্যে ইসরাইল, মিসর, সাইপ্রাস, গ্রিস, ইতালি ও জর্ডান সমন্বয়ে ‘East Mediterranean Gas Forum’ প্রতিষ্ঠিত হয় । এখানে তুরস্ক, উত্তর সাইপ্রাস, লেবানন, লিবিয়া ও সিরিয়াকে বাদ দেওয়া হয়েছে।এই এক পাক্ষিক চুক্তির কারণে তুরস্ক, গ্রিস, সাইপ্রাস, মিসর, ইসরাইল, লেবানন ও লিবিয়া পূর্ব ভূমধ্যসাগরে জলসীমা তথা নব্য আবিষ্কৃত গ্যাসের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য পক্ষে-বিপক্ষে ভাগ হয়ে গেছে। কারণ, যার জল-সীমানা যত বেশি তার সম্পদ প্রাপ্তির সম্ভাবনাও তত বেশি। প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পর্কিত এই বিবাদ এই অঞ্চলের কিছু দেশকে মুখোমুখি দাড় করিয়েছে।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় গ্যাস ফোরাম থেকে তুরস্কের বাদ পড়া এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরের পাইপলাইন (ইস্ট মেড) পরিকল্পনা তুরস্কের সমুদ্র-সীমা তথা সম্পদ সংরক্ষণের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।। ইসরায়েল-মিসর-সাইপ্রাস-গ্রিস, লিবিয়াকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করে তুরস্ককে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে পুরোপুরি ঘেরাও করে ফেলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই উদ্দে্শ্যে ফ্রান্স, আমিরাত, মিশর , গ্রীস প্রভৃতি দেশ আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে লিবিয়ার বিতর্কিত জেনারেল হাফতারকে অস্ত্র ও ভাড়াটে বাহিনী সরবরাহ করছে। যিনি গত এক বছর ধরে ত্রিপোলি দখলের অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়েছেন।

এমতাবস্থায়, ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর লিবিয়ায় ত্রিপলিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান এবং লিবিয়ার জিএনএ প্রধান ফায়েজ আল সারাজের মধ্যে এক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। । এই চুক্তি তুরস্ক এবং লিবিয়া উভয়ের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই চুক্তিতে তুরস্ক ও লিবিয়ার সমুদ্র-সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে যেখানে উভয় দেশের অর্থনৈতিক সমুদ্র-সীমা সংযোগ করে একটি করিডোর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাই কোন ধরনের পাইপলাইন পূর্ব ভূমধ্যসাগর থেকে ইউরোপে যেতে হলে এই করিডোর দিয়ে যেতে হবে এবং এক্ষেত্রে এই দুই দেশের অনুমতি লাগবে।

তুরস্ককে বাদ দিয়ে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে গ্যাস সহ অন্যান্য সম্পদ আহরণের এই তোড়-জোড় কেন ? আর কেনই বা পূর্ব ভূমধ্যসাগরের সাথে যে দেশ অর্থাৎ ফ্রান্সের কোন সীমানা নেই সে কেন গ্রিস- ইসরায়েল-মিসর এর সাথে জোট বাঁধছে এবং গ্রিসের সমর্থনে নৌ ও বিমান বহর মোতায়েন করছে ? এর উত্তর পেতে গেলে আমাদের একশত বছর পেছনে ফিরে যেতে হবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় খিলাফতের পতন ঘটলে তুরস্কের মূলভূমি ছাড়া সাম্রাজ্যের বাকি অংশ ব্রিটিশ আর ফরাসিরা ভাগাভাগি করে নেয়। এমনকি ব্রিটিশরা অটোমানদের রাজধানী ইস্তাম্বুল এবং বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালিরও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। আর তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রিস, ইতালি, ফ্রান্স ও আর্মেনিয়া তুরস্কের চতুর্মুখী দখল নেয়। অতঃপর, কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বাধীন তুর্কি বাহিনী গ্রিক, আর্মেনিয়ান আর ব্রিটিশদের হারিয়ে দেয়। ১৯২০ সালে স্বাক্ষরিত ‘সেভরেস’ চুক্তি তুরস্ক মানতে অস্বীকার করলে ১৯২৩ সালে সুইজারল্যান্ডের ‘লুজানে’ অনুষ্ঠিত সম্মেলন ও চুক্তির মাধ্যমে বর্তমান সীমানা নিয়ে বর্তমান তুর্কী প্রজাতন্ত্র পাশ্চাত্যের স্বীকৃতি লাভ করলেও এর বহু ধারা তাদের জন্য বেদনাদায়ক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
এই চুক্তির আওতায় ব্রিটেন ও ফ্রান্স, লিবিয়া, মিশর, সুদান, ইরাক,জর্ডান এবং লেবানন নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা বৈধ করে নেয়।তারা তুরস্কের উপর বহু অন্যায় ও অপমানজনক শর্ত চাপিয়ে দেয়। যেমন : ওসমানীয় খিলাফত বিলুপ্তি, তুরস্কের বাইরে খলিফা এবং তার বংশধরদের নির্বাসন (যাদের অধিকাংশই গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছে), এবং তাদের সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত, এবং তুরস্ককে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষণা, এবং বসফরাস প্রণালীকে আন্তর্জাতিক করিডোর ঘোষণা করা হয় (যা কৃষ্ণ সাগর এবং মারমারা সাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে)। এবং এই প্রণালী দিয়ে যাতায়াতকারী জাহাজ থেকে ফি আদায় করা থেকে তুরস্ককে বঞ্চিত করা হয় । এ ছাড়া এজিয়ান সাগরে তুর্কী ভূখণ্ডের খুবই কাছের এমন কিছু দ্বীপকে গ্রিসকে দেওয়া যেন তারা (তুরস্ক) তাদের জলসীমা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। তা ছাড়া তুরস্ককে চলমান সভ্যতার প্রাণশক্তি তেল-গ্যাস অনুসন্ধান থেকে বিরত রাখার বন্দোবস্ত পাকাপোক্ত করা হয়।
এর পাশাপাশি তুরস্কের পশ্চিমের জলসীমায় পূর্ব ইজিয়ান সাগরে অনেকগুলো গ্রিক দ্বীপ রয়েছে ।যাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমুদ্র-সীমা যথাক্রমে ১২ ও ২০০ নটিক্যাল মাইল ধরা হলে তুরস্কের জলসীমার নিয়ন্ত্রণ মারাত্মক ভাবে ক্ষুণ্ণ হয়। এই আশংকায় তারা আন্তর্জাতিক সমুদ্র-সীমা আইন-১৯৮২তে স্বাক্ষর দেয়নি । তুরস্ক এই রাজনৈতিক সীমা ৬ নটিক্যাল মাইল বজায় রাখতে চাপ অব্যাহত রাখছে যা কয়েক দশক ধরে তুরস্ক ও গ্রিস উভয়ে মেনে আসছিল। কিন্তু গ্রিস তার সমুদ্র-সীমা এখন ১২ নটিক্যাল মাইল নির্ধারণের কথা বলছে। আবার, তুরস্ক-গ্রিস স্বাক্ষরিত বিভিন্ন চুক্তিতে পূর্ব ইজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলোতে সামরিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হলেও বর্তমানে গ্রিসের অব্যাহত সামরিকীকরন দুই দেশের সম্পর্কে আরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
বর্তমানে ফ্রান্স পূর্ব ভূমধ্যসাগরের সীমান্তবর্তী না হওয়া সত্ত্বেও যে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে তার পিছনে তাদের শতবর্ষ পুরাতন উপনিবেশিক নীতি ও ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে তুরস্কের গ্যাস পাইপ লাইন নির্ভরতা এড়ানোর চেতনা দ্বারা তাড়িত বলে ওয়াকিফহাল সূত্র মনে করে।
১০০ বছর পূর্তির পর ২০২৩ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে এবং পর্যবেক্ষকরা এরদোগানের মন্তব্য বুঝতে পারছেন, তার ভাষায় বিরোধীরা তুরস্ককে ১৯২০ সালে “সেভরেস চুক্তি” স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছে, এবং ১৯২৩ সালে লুজান চুক্তির ফলে তুরস্ক গ্রীসের এজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলোর অধিকার হারিয়েছে, এবং তিনি সেভরেস চুক্তিকে ওসমানীয় খিলাফতের পিঠের প্রথম কাঁটা হিসেবে বর্ণনা করেছেন ।তিনি ইতোমধ্যে ( ২০১৭) বলেছেন, লুজান চুক্তির “কিছু ধারা” “অস্পষ্ট” এবং তাদের পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন। । তাছাড়া পূর্ব ভূমধ্যসাগরে নিজ জলসীমায় তেল অনুসন্ধান তৎপরতা ২০২৩ সালে চুক্তির মেয়াদপূর্তির সাথে সম্পর্ক আছে বলে তারা মনে করছেন। সেই সাথে বসফরাস প্রণালী র মধ্য দিয়ে যাওয়া জাহাজ থেকে ফি সংগ্রহ করা এবং কৃষ্ণ সাগর এবং মারমারা সাগরের সংযোগকারী একটি নতুন চ্যানেল খনন করার উদ্যোগ তুরস্ক গ্রহণ করছে কি ? তার জন্য আমাদের আরও তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে।

*লেখক: প্রভাষক,সাতক্ষীরা পি এন স্কুল অ্যান্ড কলেজ

Check Also

ট্রাইব্যুনালে আ.লীগ নেতাদের বিচার দেখতে এসে যা বললেন সাঈদী পুত্র

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।