সাতক্ষীরা প্রাণ সায়ের খালের প্রাণ ফিরে পেলে স্বস্থি মিলবে শহরের ৫ লক্ষ মানুষের: নকশা অনুযায়ী খননের দাবী: চলছে শত বছরের অবৈধ স্থপনা উচ্ছেদ অভিযান

আবু সাইদ বিশ্বাস, ক্রাইমবার্তা রিপোট: সাতক্ষীরা: খননের নামে লুটপাট ও অনিয়ম বন্ধ হলে প্রাণ ফিরে পাবে সাতক্ষীরার সায়র খাল। স্বস্থি মিলবে শহরের পাঁচ লক্ষ মানুষের। হ্রাস পবে শহরের জলাবদ্ধতা। উৎপাদন বাড়বে কৃষি ও শিল্পের। জলাবদ্ধতা ও বন্যা প্রতিরোধ, ময়লা-পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন,যানজট নিরসন ও শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি এমনটায় আশা করছেন প্রাণ সায়র খালের তীরবর্তী কয়েক লক্ষ মানুষ।

খালের দু’তীরে শতবছরের অবৈধ স্থপনা গুড়িয়ে দিচ্ছেন সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন ও পানিউন্নয়ন বোর্ড। শনিবার সকাল থেকে শহরের সুলতানপুর বড়বাজার সংলগ্ন খাল ঘেষে গড়ে তুলা অভেধ স্থপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। অভিযান চলতে থাকবে জানালে প্রশাসন।

সাতক্ষীরাবাসীর দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবী ছিলো জেলা শহরের ঠিক মাঝ দিয়ে প্রাবিহ প্রাণ সায়ের খালের দু’ধার শোভাবন্ধন ও দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা। কিন্তু অর্থের অভাব, প্রভাবশালী দখলদারদের উচ্ছেদসহ সংশ্লিষ্টদের নতজানু মনোভাবের কারনে এতোদিন সে-টি হয়ে উঠেনি। দিন দিন দখলদারদের কালোথাবায় প্রাণ সায়ের খাল যেনো প্রাণ হারিয়ে স্মৃতির পাতা থেকে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল যেদিন সাতক্ষীরাতে যোগদান করেন ঠিক সেদিনই প্রাণ সায়ের খালের করুণ চিত্র তার চোখে পড়ে। তিনি জেলা ম্যাজিস্টেটের দায়িত্ব নিয়েই সাতক্ষীরার সিনিয়র সাংবাদিকসহ সুশিলসমাজের নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে প্রাণ সায়ের খালের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পদযাত্রা করেন। অবৈধ দখল আর খালের নোংড়া পরিবেশ দেখে তিনি রিতিমতো হতবাক হন। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামালের সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে গত বছরের পহেলা আগষ্ট বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয় প্রাণ সায়ের খালের দু’ধারের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের কাজ।

কাজের এক পর্যায়ে প্রভাবশালীদের বাঁধার মুখে তা আবার বন্ধ হয়ে যায়। সব বাঁধা উপেক্ষা করে গতকাল থেকে আবারও সেই উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ জেলা প্রশাসনকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।

সূত্র জানায় সাতক্ষীরা পওর বিভাগ-১ এর অধীনে খাল এবং জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্প (১ম পর্যায়) এর আওতায় প্রাণ-সায়ের খাল খনন করা হচ্ছে। প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪ কিলো মিটার খাল খনন করার কথা থাকলেও খাল খননে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠে

১৮৬৫ সালে অবিভক্ত বাংলার সাতক্ষীরার জমিদার প্রাণনাথ রায় শিক্ষার প্রসার ঘটাতে পিএন হাইস্কুল এন্ড কলেজ এবং ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধার্থে প্রাণসায়ের খাল খনন করেন। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার খেজুরডাঙ্গি বেতনা নদী থেকে সাতক্ষীরা শহর হয়ে এল্লারচর মরিচ্চাপ নদী পর্যন্ত এ খালের দূরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার। প্রথমাবস্থায় এ খালের চওড়া ছিল ২০০ ফুটের বেশি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সে সময় বড় বড় বাণিজ্যিক নৌকা এসে ভিড় জমাতো এ খালে। এর ফলে সাতক্ষীরা শহর ক্রমশ সমৃদ্ধশালী শহরে পরিণত হয়। আর ১৯৬৫ সালের প্রথম দিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণের নামে খালের দুই প্রান্তে পানি উন্নয়ন বোর্ড স্লুইস গেট নির্মাণ করে। এতে খালে স্বাভাবিক জোয়ার-ভাটা বন্ধ হয়ে যায় এবং এটি বদ্ধ খালে পরিণত হয়।
এরপর জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের আওতায় ২০১২ সালের ১৮ অক্টোবর খালটি খনন করা হয়। ৯২ লাখ ৫৫ হাজার টাকায় ১০ কিলোমিটার খাল সংস্কারে নামমাত্র খনন করে প্রকল্পের সিংহভাগ টাকাই লোপাট করার অভিযোগ উঠে। খাল খননের নামে খালের দুই ধারে শতশত গাছ কেটে ফেলা হয়।

আবারো নেমে আসে শহর বাসীর দুর্ভোগ। শীতকালেও শহরে জলাবদ্ধা বিরাজ করে। বন্ধ হয়ে যায় খালের পানি প্রবাহ।

২০১৮-১৯ অর্থ বছরে সাতক্ষীরা পওর বিভাগ-১ এর অধীন ‘৬৪টি জেলার অভ্যন্তরস্থ ছোট নদী, খাল এবং জলাশয় পুনঃ খনন প্রকল্প (১ম পর্যায়) এর আওতায় প্রাণ-সায়ের খাল খনন করা শুরু হয়।

সাতক্ষীরা স্টেডিয়াম ব্রিজ হতে খেজুরডাঙ্গা ৬ ভেন্ট স্লুইস গেটস্থ বেতনা নদীর সংযোগস্থল পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার এলাকা খননের জন্য টেন্ডারের মাধ্যমে ৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা চুক্তি কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। এই অংশে খননকৃত মাটির পরিমাণ ৯৩ লাখ ২৮ হাজার ৬৭৯ দশমিক ৯০ সিএফটি। আর দ্বিতীয় অংশে ১ দশমিক ০৮০ কিলোমিটারে রয়েছে খেজুরডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে খেজুরডাঙ্গা ৬ (ছয়) ভেন্ট স্লুইস গেট পর্যন্ত।

এ অংশে খননকৃত মাটির পরিমাণ ১৬ লাখ ৭৯ হাজার ৪২৮ দশমিক ৬৯ সিএফটি। অপর গ্রুপে চরবালিথা হতে সাতক্ষীরা স্টেডিয়াম ব্রিজ পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার পুনঃ খননের জন্য টেন্ডারের মাধ্যমে ৭ কোটি ৪৮ দশমিক ৪১ লক্ষ টাকা চুক্তি মূল্যে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। এই অংশে খননকৃত মাটির পরিমাণ ১ কোটি ৫১ লাখ ৬৬ হাজার ৫৯৭ দশমিক ৩৫ সিএফটি। টেন্ডার অনুযায়ী খালটির ডিজাইন দুই ভাগে বিভক্ত। যার প্রথম অংশে চরবালিথা হতে কুখরালী দক্ষিণপাড়া ঈদগাহ পর্যন্ত খনন করা হবে। যার বেশির ভাগ ইত্যোমধ্যে খনন করা হয়েছে।

এই অংশে খননকৃত মাটির পরিমাণ ৮৬ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬৮ দশমিক ৪৯ সিএফটি। আর দ্বিতীয় অংশে কুখরালী দক্ষিণপাড়া ঈদগাহ হতে সাতক্ষীরা স্টেডিয়াম ব্রিজ পর্যন্ত। এই অংশে খননকৃত মাটির পরিমাণ ৬৪ লাখ ৮২ হাজার ৮২৮ দশমিক ৮৬ সিএফটি। এই অংশের ইটাগাছা পূর্বপাড়া হতে সাতক্ষীরা স্টেডিয়াম ব্রিজ পর্যন্ত খননকৃত ৪৩ লাখ ৯৭ হাজার ৯৪৬ দশমিক ১৬ সিএফটি মাটি ড্রাম ট্রাকের মাধ্যমে শহরের মধ্য থেকে নিরাপদ দূরত্বে স্থানান্তর করা হবে।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল জানান, প্রাণসায়ের খাল সম্পুর্ণ অবৈধ দখলমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিকল্পিত, দৃষ্টিনন্দন ও আধুনিক সাতক্ষীরা শহর গড়ার লক্ষ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শেষ হওয়ার সাথে সাথে সাতক্ষীরা প্রাণ সায়ের খালের দু’ধারে দৃষ্টিনন্দন কাজ শুরু হবে। ইতোমধ্যে কাজের অনেকাংশ শেষ হয়েছে।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।