সরকারি ঘর দেওয়ার কথা বলে চার শতাধিক হতদরিদ্র মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুর ইউপি চেয়ারম্যান রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে। এবিষয়ে ওই ইউনিয়নের ডাঙ্গিপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ আলী গত ৬ সেপ্টেম্বর রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
অভিযুক্ত চেয়ারম্যান ১২৫ জনের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তবে তিনি দাবি করেছেন ঘর দিতে না পারায় একশ’ জনকে টাকা ফেরত দিয়েছেন।
লিখিত অভিযোগে মোহাম্মদ আলী উল্লেখ করেছেন, ‘জমি আছে ঘর নেই’ প্রকল্পে সরকার থেকে বিনামূল্যে ঘর দেয়া হচ্ছে জানতে পেরে দুই বছর আগে তিনি চেয়ারম্যান রেজাউল করিমের কাছে যান। চেয়ারম্যান ১০ হাজার টাকা দিলে ঘর পাইয়ে দেবে বলে জানান। তিনি হতদরিদ্র মানুষ। সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে চেয়ারম্যানকে ১০ হাজার টাকা দেন। কিন্তু ঘর পাননি তিনি। দীর্ঘদিনেও ঘর না পাওয়ায় চেয়ারম্যানের কাছে টাকা চাইতে গেলে তিনি টাকা ফেরত দেননি। উল্টো চেয়ারম্যান গালমন্দ করেছেন।
তার মত মধ্যপাড়া গ্রামের হতদরিদ্র সাহেরা বেগম, জামাল মন্ডল, ফরহাদ মন্ডল, ভানু বেগম, শাহিনা বেগমসহ চার শতাধিক মানুষের কাছ থেকে চেয়ারম্যান ১০ হাজার করে টাকা নিয়েছেন।
বহরপুর ইউনিয়নের পাকালিয়া গ্রামের হতদরিদ্র ফরহাদ মন্ডলও ঘর পেতে চেয়ারম্যানকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। তার বাবা অহিদ মন্ডল জানান, ছেলে ফরহাদের স্ত্রী সাপের কামড়ে মারা যায়। গ্রামের মানুষের কাছ সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে স্ত্রীর কুলখানির জন্য টাকা গুছিয়েছিলেন। ওই সময় ফরহাদ জানতে পারে, ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ঘর পাওয়া যাচ্ছে। তখন ফরহাদ টাকা বাঁচিয়ে চেয়ারম্যানকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিল। কিন্তু ঘর আর পায়নি। এখন পরিবার নিয়ে তারা ভাঙা ঘরে বাস করছেন।
একই গ্রামের সিরাজুল ফকীর জানালেন, তিনি পেশায় দিনমজুর। সরকারি ঘর পাওয়ার আশায় চেয়ারম্যানকে ১০ হাজার টাকা দেন। ঘর পাননি, টাকাও ফেরত পাননি। টাকার অভাবে ঘর মেরামত করতে না পারায় অন্যের বাড়িতে বাস করছেন।
বহরপুর পূর্বপাড়া গ্রামের রূপবান বেগম জানান, অসুস্থতার কারণে তার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে ঘরে পড়ে আছে। সংসারে আয় রোজগার করার কেউ নেই। থাকেন ভাঙা ঘরে। সরকারি ঘর পাওয়ার কথা শুনে তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে ধার দেনা করে চেয়ারম্যানকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। তিনিও পাননি ঘর। বেশ কয়েকবার তিনি চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিলেন, কিন্তু টাকা ফেরত পাননি।
তবে ঘরের জন্য চেয়ারম্যানকে টাকা দিয়ে ফেরত পেয়েছেন দড়িপাড়া গ্রামের শাহাদত হোসেনের স্ত্রী রূপালি বেগম। তিনি জানান, তার স্বামী চলাফেরা করতে পারেন না। ছেলে মেয়ে কেউ নেই। ছাগল পালন করে চলে তার সংসার। তিনটি ছাগল বিক্রি করে চেয়ারম্যানকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। ঘর না পাওয়ায় বেশ কয়েকবার তার কাছে টাকা ফেরত চাইতে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিবারই বলেছেন ঘর দেবেন। গত মঙ্গলবার চেয়ারম্যান তাকে ডেকে টাকা ফেরত দিয়েছেন। আর বলেছেন, যা একটু চেষ্টা করতে চেয়েছিলাম। সাংবাদিকদের জন্য পারলাম না।
বহরপুর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের মেম্বার জিয়াউর রহমান জানান, সরকারি ঘর দেওয়ার কথা বলে তার ওয়ার্ডের অনেক মানুষের কাছ থেকে চেয়ারম্যান টাকা নিয়েছেন বলে শুনেছেন।
একই কথা জানিয়েছেন ১ নং ওয়ার্ডের মেম্বার শুকুর আলীও।
বহরপুর ইউপি চেয়ারম্যান রেজাউল করিমের কাছে এবিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্য একটি উপায়ে কিছু ঘর পাওয়া যাবে বলে জানতে পেরেনছিলাম। কিন্তু বিনিময়ে টাকা দিতে হবে। এজন্য কিছু মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলাম। যখন বুঝতে পারলাম, তথ্যটা সঠিক না, তখন টাকা ফেরত দিয়ে দিয়েছি।
কতজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন জানতে চাইলে বলেন, ১২০/২৫ জনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। একশ জনকে টাকা ফেরত দিয়েছি। এখন অনেকেই টাকা ফেরত চাইতে আসছেন। কিন্তু টাকা জমা দেওয়ার তালিকায় তাদের নাম নেই। হয়তো কিছু মেম্বার এসব টাকা নিয়েছে। ওইসব ভুক্তভোগীদের কাছে জানতে চাইলে তারা আমাকে বলেছে, অমুকের মাধ্যমে তমুকের মাধ্যমে টাকা দিয়েছি।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তার ইউনিয়নে প্রথম দফায় আটটি ও দ্বিতীয় দফায় তিনটি সরকারি ঘর বরাদ্দ দিয়েছেন। সেগুলো বিতরণ সম্পন্ন হয়েছে। ওই সব ঘরের জন্য কোনো টাকা নেওয়া হয়নি।
বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, গত বছর সরকারিভাবে পুরো উপজেলাতেই ঘর এসেছে ২১টি। সাত ইউনিয়নে তিনটি করে বরাদ্দ দিয়েছি। এতো মানুষের কাছ থেকে চেয়ারম্যান কীভাবে টাকা নিলেন, সেটাই আশ্চর্যের। বিষয়টি জানা নেই। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম বলেন, এ সংক্রান্ত একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।