দেশের পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও টেকসই উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে কাজ করা ‘বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড’ বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বিলুপ্ত করে সরকার নতুন করে গঠন করছে ‘বাংলাদেশ পানিসম্পদ অধিদফতর’। একইসঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ‘বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন, ২০০০’। ভিন্ন আইনে পরিচালিত হবে বাংলাদেশ পানিসম্পদ অধিদফতর। এজন্য প্রণয়ন করা হচ্ছে ‘বাংলাদেশ পানিসম্পদ অধিদফতর আইন-২০২০’ নামে নতুন আইন। ইতোমধ্যেই এ আইনের মূল খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এখন আইনের খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। সব ঠিক থাকলে এ বছরের শেষ দিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে পানিসম্পদ অধিদফতরে রূপান্তরের কাজ শেষ হবে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, ১৯৫৪ এবং ১৯৫৫ সালের ভয়াবহ বন্যার পর বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানের লক্ষ্যে জাতিসংঘের অধীনে গঠিত ‘ক্রুগ মিশন’ এর সুপারিশক্রমে এ অঞ্চলের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের জন্য ১৯৫৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ইপিওয়াপদা) গঠন করা হয়। বর্তমান বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) ইপিওয়াপদা’র পানি উইং হিসেবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কৃষি ও মৎস্য সম্পদের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে দেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রধান সংস্থা হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নং: ৫৯ মোতাবেক ইপিওয়াপদা’র পানি অংশ একই ম্যান্ডেন্ট নিয়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) হিসেবে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীতে সংস্কার ও পুনর্গঠনের ধারাবাহিকতায় জাতীয় পানি নীতি ১৯৯৯ এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাপাউবো আইন, ২০০০ প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের আওতায় মন্ত্রী, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়’র নেতৃত্বে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট পানি পরিষদের মাধ্যমে বোর্ডের শীর্ষ নীতি নির্ধারণ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, দেশের পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও টেকসই উন্নয়ন সাধন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান ভিশন থাকলেও নতুন আইনে গঠিত অধিদফতরের মূল ভিশন হচ্ছে পানিসম্পদের টেকসই উন্নয়ন এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা । একই সঙ্গে বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা, আন্তর্জাতিক নদীর প্রবাহ, লবণাক্ততা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা ও প্রাকৃতিক পরিবেশের যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি, মৎস্য, বন ইত্যাদি ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন সাধন করাও হবে অধিদফতরের কাজ।
এতদিন বাপাউবো আইন অনুসারে জাতীয় পানি নীতি, জাতীয় পানি মহাপরিকল্পনা, অংশগ্রহণমূলক পানি ব্যবস্থাপনা গাইড লাইন এবং দেশের পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন করা হলেও এখন এ কাজগুলো পরিচালিত হবে পানি উন্নয়ন অধিদফতর আইন ২০২০ অনুসারে। মাঝারি এবং বড় প্রকল্পসমূহে স্থানীয় সংগঠনের সমন্বয়ে যৌথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাস্তাবায়িত হবে বলেও আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য কোনও ভিন্নতা ছাড়াই ৮টি সুনির্দিষ্ট মিশন নিয়ে কাজ করবে বাংলাদেশ পানিসম্পদ অধিদফতর। এগুলো হচ্ছে−(ক) সমাজের সকল স্তর, শ্রেণি ও পেশার লোকজনের অংশগ্রহণ ও জীবন মান উন্নয়ন নিশ্চিত করা। (খ) স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং আইনের পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। (গ) সকল শ্রেণি ও পেশা, বিশেষত দরিদ্র জনগণের জন্য কার্যকর ও দক্ষ সেবা প্রদান করা। (ঘ) দারিদ্র্য হ্রাস করা। (ঙ) খাদ্য নিরাপত্তা প্রদান করা। (চ) প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা ও (ছ) পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়ন কৌশল অনুসরণ।
জানা গেছে, ‘বাংলাদেশ পানিসম্পদ অধিদফতর আইন-২০২০’ আইনটি বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম শেষে জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন-২০০০ বিলুপ্ত হবে। একই সঙ্গে বিলুপ্ত হবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। গঠিত হবে বাংলাদেশ পানিসম্পদ অধিদফতর। নতুন আইনের চার ধারায় বলা আছে বাংলাদেশ পানিসম্পদ অধিদফতরের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তার পদবি হবে মহাপরিচালক বা ডিরেক্টর জেনারেল। এর সদর দফতর রাজধানী ঢাকায় হবে বলে খসড়া আইনের ৫ ধারায় উল্লেখ রয়েছে।
খসড়া আইনের ৭ ধারায় বলা হয়েছে−“(১) বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩ (২০১৩ সালের ১৪ নং আইন) এর অধীন প্রণীত জাতীয় পানি নীতি ও জাতীয় পানিসম্পদ পরিকল্পনার আলোকে এবং এই ধারার অন্যান্য বিধানাবলী সাপেক্ষে অধিদফতর নিম্নবর্ণিত কার্যাবলী সম্পাদন এবং তদুদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় প্রকল্প প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও মূল্যায়ন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম গ্রহণ করিতে পারিবে, যথা:
(ক) কাঠামোগত কার্যাবলীতে বলা হয়েছে−নদী ও নদী অববাহিকা ব্যবস্থাপনা ও তার উন্নয়ন এবং বন্যা ব্যবস্থাপনা, পানি নিষ্কাশন, সেচ ও খরা প্রতিরোধের লক্ষ্যে জলাধার, ব্যারেজ, বাঁধ, রেগুলেটর বা অন্য যে কোনও অবকাঠামো নির্মাণ করা। সেচ, মৎস্য চাষ, নৌ পরিবহন, বন্য ও জলজ প্রাণী সংরক্ষণ এবং পরিবেশ ও পরিবেশের সার্বিক উন্নয়নে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে পানি প্রবাহের উন্নয়ন ও পানি প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তনের জন্য জলপথ, খালবিল ইত্যাদি পুনঃখনন করা। বনায়ন ও সকল ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পদ্ধতির প্রয়োগ করা। উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ করা। নদীর তীর রক্ষা ও সংরক্ষণের মাধ্যমে মসজিদ, মাদ্রাসা, হাটবাজার স্কুল, কলেজ জনবসতিসহ ঐতিহাসিক ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান রক্ষা করা।
আইনের ১২ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পানি আইন-২০১৩ এর অধীন জাতীয় পানি নীতি ও জাতীয় পানিসম্পদ পরিকল্পনা এবং ডেল্টা প্লান-২১০০ এর আলোকে এবং উপ-আঞ্চলিক ও স্থানীয় পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া সাপেক্ষে ভবিষ্যৎ প্রকল্পের বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনা নির্ধারিত হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার বলেন, আইনটি চূড়ান্ত হওয়ার পথে। আরও কিছু কাজ বাকি আছে। আমরা সংশ্লিষ্টরা এ নিয়ে কাজ করছি। এর কাজ শেষ হলেই তা মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে জাতীয় সংসদে পাসের জন্য পাঠানো হবে আইনটি। জাতীয় সংসদে আইনটি পাসের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বিলুপ্ত হয়ে বাংলাদেশ পানিসম্পদ অধিদফতরে রূপান্তরিত হবে।