সড়কপথে নানা জটিলতার কারণে প্রকৃতির অপরূপ সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে অনেকেই ভোগান্তিতে পড়েন। ফলে অনেকের ইচ্ছা থাকলেও পরিবার পরিজন নিয়ে সুন্দরবনে যেতে চান না।
কিন্তু এবার সুন্দরবন পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। ফলে ট্রেনে চড়েই চলে যাওয়া যাবে এ বনের কাছাকাছি।প্রকল্পের অধীনে যশোরের নাভারন থেকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করা হবে। মুন্সীগঞ্জ হচ্ছে সুন্দরবনেরই একটি পয়েন্ট। মুন্সীগঞ্জের চুনা নদীর ওপারেই গভীর বনাঞ্চল। এর মাধ্যমে রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনভূমি।
জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিশাল অংকের অর্থ প্রয়োজন। সে কারণে চীনের কাছে চাওয়া হয়েছে ঋণ।
‘কন্সট্রাকশন অব নিউ বিজি ট্র্যাক ফর্ম নাভারন টু সাতক্ষীরা’ প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৩২৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা চীনা ঋণের আশা করা হচ্ছে। প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৬২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৩৩২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। চলতি সময় থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। নাভারন থেকে মুন্সীগঞ্জ গ্যারেজ পর্যন্ত রেলপথের মোট দৈর্ঘ্য হবে ৯৮ দশমিক ৪২ কিলোমিটার।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে ট্রেনে চড়ে যাওয়া যাবে সুন্দরবনের খুব কাছাকাছি মুন্সীগঞ্জ পয়েন্টে। সেখান থেকে একটা নদী পাড়ি দিলেই মূল সুন্দরবন। সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্রের কথা চিন্তা করেই ১০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত ট্রেন যাবে। নতুন রেলপথ নির্মাণের ফলে সাতক্ষীরা জেলায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে। নাভারন থেকে মুন্সীগঞ্জ পর্যন্ত থাকবে ৮টি স্টেশন। এগুলো হলো- নাভারন, বাগআচড়া, কলারোয়া, সাতক্ষীরা, পারুলিয়া, কালিগঞ্জ, শ্যামনগর ও মুন্সীগঞ্জ। ব্রডগেজের এ রেললাইনের যাত্রীবাহী ট্রেনের গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। তবে সাধারণত পণ্যবাহী ট্রেন ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারবে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-প্রধান (পরিকল্পনা ) আ.ন.ম. আজিজুল হক বলেন, প্রকল্পের কাজ একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় আছে। যশোরের নাভারন থেকে সাতক্ষীরা হয়ে মুন্সীগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করা গেলে অর্থনৈতিকভাবে এলাকাগুলো শক্তিশালী হবে। পাশাপাশি নতুন রেলপথ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। রেলপথটি নির্মাণে চীনসহ কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগী খোঁজা হচ্ছে। সুবিধা মতো যার সঙ্গে মিলবে তাকেই এই প্রকল্পের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বেছে নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন জেলা সাতক্ষীরা। সাতক্ষীরা জেলায় প্রায় ২২ লাখ মানুষের বসবাস। এ জেলা থেকে দেশের অন্যান্য স্থানে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম সড়কপথ। সুন্দরবন, চিংড়ি সম্পদ এবং ভারত-বাংলাদেশ আমদানি-রপ্তানি (ভোমরা স্থলবন্দর) বাণিজ্য অর্থনৈতিকভাবে ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এসব কারণে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে একমাত্র সড়কপথটি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এসব কারণেও এখানে রেলপথ নির্মাণ করতে যাচ্ছে সরকার।
নতুন রেললাইন স্থাপনের ফলে সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগে পর্যটকদের যাতায়াত অনেক সহজ হবে। রেলপথের সেতু নির্মিত হবে বাঁকাল, লাবণ্যবতী, সাপমারা খাল ও কাকশিয়ালী নদীর ওপর। নাভারন থেকে মুন্সীগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হলে পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে। এখন সুন্দরবন দেখতে গেলে সড়ক ও নদীপথে যেতে হয়। তাতে খরচ, ভোগান্তি, ঝুঁকি সবই বেশি। রেলপথ হলে কম খরচে আরামদায়ক ট্রেন ভ্রমনে মানুষ সুন্দরবন দেখতে পারবে।
সুন্দরবন হলো সমুদ্র উপকূলবর্তী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি। ৬ হাজার ১৭ বর্গ কি.মি আয়তনের এই বনে রয়েছে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এ ছাড়া নানান ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। এছাড়া এই বনভূমিতে বিখ্যাত সুন্দরী ও গোলপাতা গাছও পাওয়া যায়। এই বনের মৌচাক থেকে প্রচুর মধু সংগ্রহ করা হয়। রেলপথ নির্মাণের ফলে সহজেই সুন্দরবনে যেতে পারবেন পর্যটকেরা।