মুসলিমদের পবিত্র ভূমি আল-আকসা মসজিদ চত্বর বিভক্ত হয়ে যেতে পারে

আমেরিকার মধ্যস্থতায় আরব আমিরাত ও বাহরাইন তথা উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্কের ঘোষণায় মুসলিমদের তৃতীয় পবিত্র ভূমি আল-আকসা মসজিদ চত্বর বিভক্ত হয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক চুক্তি মসজিদের বর্তমান স্থিতিশীলতার আইনকে বিনষ্ট করবে।

টেরিস্ট্রিয়াল জেরুজালেমে (টিজে) প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বর্তমানের জেরুজালেমের ‘স্থিতিশীল অবস্থার আমূল পরিবর্তন’ ও ‘সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ ও সম্ভাব্য বিস্ফোরণ’ হওয়ার কথা তুলে ধরা হয়। ১৯৬৭ সালের স্থিতিশীল অবস্থায় ৩৫ একরের ‘আল-হারাম আল-শরিফ’ তথা ‘আল-আকসা মসজিদ’ চত্বরে শুধু মুসলিমরা ইবাদত করতে পারত। অমুসলিমরা তা পরিদর্শন করতে পারত, তবে কোনো ইবাদত করার সুযোগ ছিল না। ২০১৫ সালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ওই স্থিতিশীল অবস্থাকে আইনি বৈধতা দেন।

তবে সাম্প্রতিক সময়ের ইসরায়েল ও উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর স্বাভাবিক সম্পর্কের চুক্তির কারণে হয়তো আগের স্থিতিশীল অবস্থা আর থাকবে না। কারণ ইসরায়েল ও আমেরিকার যৌথ বিবৃতিতে গত ১৩ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ‘শান্তির লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা হিসেবে যে মুসলিমরা শান্তিতে এগিয়ে আসবে, তারা আল-আকসা পরিদর্শন ও উপাসনা করতে পারবে। এবং জেরুজালেমের অন্য পবিত্র স্থানগুলোও সব ধর্মাবলম্বীর জন্য উন্মুক্ত থাকবে।’

টিজের প্রতিবেদন মতে, আল-আকসাকে একটি মসজিদের অবকাঠামো হিসেবে বিবেচনা করে ইসরায়েল। প্রতিবেদনে বলা হয়, “মসজিদের অবয়ব ছাড়া যেকোনো স্থাপনা জেরুজালেমের পবিত্র স্থান হিসেবে সাব্যস্ত হবে এবং তা ইহুদিগোষ্ঠীসহ সবার উপাসনার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। আর তাই জেরুজালেমের প্রাচীন স্থাপনা আল-আকসা মসজিদের শুধু সম্মুখভাগের নামাজের স্থান বোঝাতে ‘আল-আকসা মসজিদ’ পরিভাষা চালু করে। আর অবশিষ্ট স্থানের কথা বোঝাতে ইহুদিগোষ্ঠীর উপাসনালয় পাহাড়ের গির্জা (Temple Mount) ব্যবহার করছে। আর মসজিদের পুরো প্রাঙ্গণ বোঝাতে ‘আল-হারাম আল-শরিফ’ ব্যবহার করা হয়। পরিভাষার এমন ব্যবহার অহেতুক বা ভুলবশত নয়; বরং তা পাহাড়ের উপাসনালয় ইহুদি উপাসকদের জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত করার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গোপন প্রচেষ্টার অংশবিশেষ।” গত শুক্রবার (১১ সেপ্টেম্বর) ইসরায়েলের সঙ্গে বাহরাইনের স্বাভাবিক সম্পর্ক ঘোষণাকালেও এমনই বিবৃতি দেওয়া হয়।

ফিলিস্তিনিরা পবিত্র মসজিদ ভাগ হওয়ার প্রচেষ্টা নিয়ে দীর্ঘকাল উদ্বিগ্ন। যেমনটি হেবরনের ইবরাহিমি মসজিদের ক্ষেত্রে হয়েছে। টিজের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত বছরগুলোতে গির্জাবিষয়ক আন্দোলন শুরু হয়েছে, যারা চরম জাতীয়তাবাদী ইহুদি ধর্মীয় অধিকারের মাধ্যমে স্থিতিশীলতার পরিবর্তন করতে চাচ্ছে। অনেকে আল-আকসার মসজিদ প্রাঙ্গণে ইহুদিদের জন্য উপাসনার আহ্বান করে। আবার অনেকে কুব্বাহ সাখরার ধ্বংসাবশেষের ওপর তৃতীয় গির্জা নির্মাণ করতে আগ্রহী। খ্রিস্টানদের বিশ্বাস মতে, পথপ্রদর্শক মাসিহ [ঈসা (আ.)]-এর আগমনের পূর্বাভাস বলে মনে করা হয়।

জেরুজালেমের ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ইসরায়েলি আইনজীবী ড্যানিয়েল সাইদম্যান ‘যা ঘটছে তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন’ বলে মন্তব্য করেন।’ তিনি বলেন, “আমরা জেরুজালেমে একটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর উত্থান দেখতে পাচ্ছি, যারা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। আমরা এমন এক কক্ষপথে আছি, যা আমাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। আমরা জানি, আমেরিকা ও ইসরায়েলের যৌথ দলের বিবৃতির সব কথাই একসঙ্গে কাজ করছে। তা ছাড়া ‘আল-হারাম শরিফ’-এর অবয়ব থেকে ‘আল-আকসা মসজিদ’ রূপ ধারণ করা কোনো দুর্ঘটনা নয়। তা ইচ্ছাকৃত লিখিত। গত জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে নেতানিয়াহুর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষিত মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক পরিকল্পনার ‘শতাব্দীর শান্তিচুক্তি’-এর মধ্যে ভয়ানক এই বিবৃতিও যুক্ত ছিল।”

ড্যানিয়েল আরো বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা ও হোয়াইট হাউসের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জ্যারেদ কুশনার এই শান্তি প্রস্তাবনায় প্রধান ব্যক্তি হিসেবে কাজ করেন। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত রোন ডার্মার চুক্তিনামা তৈরিতে সম্পৃক্ত আছেন। চুক্তিতে বলা হয়, ‘আল-হারাম আল-শরিফ বা পর্বত গির্জায় স্থিতাবস্থা বহাল থাকবে।’ তবে পাশাপাশি এ কথাও বলা হয়, ‘হারাম আল-শরিফ বা পর্বতের গির্জায় সব বিশ্বাসের মানুষ উপাসনা করতে পারবে।’ চুক্তির এ কথাটি প্রবল বিতর্ক তৈরি করে। ফলে ২৮ জানুয়ারি ইসরায়েলে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফ্রডম্যান চুক্তির ওই ধারাটি তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘পরিকল্পনায় এমন কিছু থাকবে না, যা কোনো পক্ষের চুক্তিতে চাপিয়ে দিয়ে বর্তমানের স্থিতাবস্থায় পরিবর্তন ঘটাতে পারে।’

আল-আকসা ও জেরুজালেম বিশেষজ্ঞ ফিলিস্তিনি আইনজীবী খালেদ জাবারকা মনে করেন যে আরব আমিরাত ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কারণ ২০১৪ সালে দখল করা পশ্চিম জেরুজালেমের গোলান ভূমি থেকে পুরোপুরি অবৈধভাবে ইসরায়েলের অধিবাসীকে ৩০টি আবাসন দেওয়ার সময় তারাই সহায়তা করেছিল। এ ঘটনা থেকে বর্তমান পরিভাষার পরিবর্তনে আমিরাতের ভূমিকা থাকার বিষয়টি স্পষ্ট। তা ছাড়া ইসরায়েল কর্তৃক পুরো আল-আকসা চত্বর নিয়ন্ত্রণে আমিরাতেরও সমর্থন আছে।

সাইদম্যান বলেন, ১৫ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত ইসরায়েলের সঙ্গে আরব আমিরাত ও বাহরাইনের ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির অনুষ্ঠানে আরব রাষ্ট্রগুলোকে সুস্পষ্টভাবে দাবি জানাতে হবে যে ‘জেরুজালেমের বর্তমান স্থিতাবস্থা নিরাপদ’ থাকবে।

ফিলিস্তিন ইস্যুতে স্থলমাইন স্থাপন করে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন ও নেতানিয়াহু সরকার। আমেরিকা ও ইসরায়েলের পরবর্তী প্রশাসন ও সরকার আল-হারাম আল-শরিফ বা আল-আকসা বা পর্বত গির্জার বিষয়ে যেমন ইচ্ছা তেমন সিদ্ধান্ত নেবে। কোনো সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না; বরং ধীরে ধীরে বিষয়টি আলোহীন প্রদীপের সলতের মতো হয়ে পড়বে। সলতে কখনো দীর্ঘ সময় থাকে, আবার কখনো দ্রুত জ্বলে ওঠে। আর জ্বলে ওঠার সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি।

তথ্যসূত্র : আলজাজিরা

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।