ক্রাইমবার্তা রিপোট: সাতক্ষীরা: ভারত সীমান্তের স্থলবন্দরগুলোতে আটকে থাকা পেঁয়াজ নিয়ে অবশেষে জট খুলেছে। রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে পাঁচ দিন ধরে সেখানে ট্রাকে থাকা পেঁয়াজ গতকাল শুক্রবার রাতে ছাড়ের অনুমতি দিয়েছে ভারত সরকার। আজ শনিবার থেকে এসব পেঁয়াজ সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকবে।
হিলি স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশিদ সীমান্তে আটকে থাকা পেঁয়াজ ছাড়ের বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
সূত্র জানায়, ভারতের পররাষ্ট্র, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগ যৌথ এক বৈঠকে সীমান্তে আটকে থাকা ২৫ হাজার টন পেঁয়াজ বাংলাদেশে রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে। পরে পরিস্থিতি বিবেচনায় আরও ১০ হাজার টন রপ্তানি বাড়াতে পারে। নষ্টের আশঙ্কায় আগের এলসির পেঁয়াজে ভারত ছাড় দিয়েছে বলে মনে করছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। তারা আশা করছেন, এসব পেঁয়াজ ঢুকলে দাম নিয়ে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে তা অনেকটাই কমে আসবে। খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি পেঁয়াজ ৫০ টাকারও কমে বিক্রি হবে। এদিকে গতকালই কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দরে মিয়ানমার থেকে ৩০ টন পেঁয়াজ এসেছে।
এর আগে গতকাল সকালে বাংলাদেশের আমদানিকারকরা জানান, স্থলবন্দরগুলোতে দেড় হাজার ট্রাক পেঁয়াজ আটকে রয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার টন। তাদের অভিযোগ, ইতোমধ্যে ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে, যার দাম প্রায় ১০ কোটি টাকা।
দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, ট্রাকের পেঁয়াজ বাংলাদেশ পাবে কিনা তা নিয়ে শেষ দু-তিন দিন ধরেই দেনদরবার চলে। সর্বশেষ গতকাল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সে দেশের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর পরই আগের এলসি করা পেঁয়াজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসে।
দেশের আমদানিকারকরা জানিয়ে আসছিলেন, যেসব পেঁয়াজের ট্রাক আটকে আছে, সেগুলোর যথাযথ এলসির বিপরীতেই এসেছে। এগুলো বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রও রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের আমদানিকারকরা এসব পেঁয়াজের ন্যায্য দাবিদার। এরই মধ্যে প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের পেঁয়াজে পচন ধরার অবস্থা হয়েছে বলে খবর দেয় কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা। আমদানিকারকরা আরও জানান, ভারতের রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সীমান্তে আটকেপড়া পেঁয়াজের হিসাব নেয়।
পেঁয়াজ নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা :দিল্লির একাধিক সূত্র জানায়, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রায় দেড় হাজার ট্রাক পেঁয়াজ ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র নিয়ে ১৪ সেপ্টেম্বরের আগেই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের রানাঘাট, বনগাঁ, হিলি ও বেনাপোলে এসে পৌঁছে। সীমান্তে পৌঁছে যখন বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় ছিল, তখনই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত আসে। এতে বলা হয়, পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ থাকবে। ফলে ভারতীয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পেঁয়াজের এসব ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেয়নি। এরপর থেকেই পেঁয়াজভর্তি এসব ট্রাক সীমান্তে আটকা পড়ে ছিল।
সূত্র জানায়, পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরপরই দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তারা সাউথ ব্লকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং স্মরণ করিয়ে দেন, গত জানুয়ারি মাসে দুই দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত ছিল এরপর থেকে বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি বন্ধের কোনো ঘোষণা দেওয়ার আগে তা বাংলাদেশকে জানাতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে সাউথ ব্লককেও বিষয়টি জানায়নি। ফলে তারা আগেভাগে বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে কিছুই জানাতে পারেননি। এর পর গত ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে এ মুহূর্তে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের অনুরোধ করা হয়। গত বৃহস্পতিবার তুরস্ক থেকে দেশে ফিরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানান, তিনি শুনেছেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আগে থেকে জানত না এবং এ জন্য তারা অনুতপ্ত বলেও জানিয়েছে।
দিল্লির কূটনৈতিক সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশের অনুরোধ জানিয়ে পাঠানো চিঠিটি ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন হয়ে দিল্লিতে সাউথ ব্লকে পৌঁছেছে। এরপর গত বৃহস্পতিবারই সে সম্পর্কে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে অবহিত করেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। গতকালও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের বৈঠক হয়। বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অনুরোধ করেন, অন্তত বৈধ ছাড়পত্র নিয়ে যেসব ট্রাক এখন বাংলাদেশ সীমান্তে আটকে আছে সেগুলো বাংলাদেশে প্রবেশের ব্যবস্থা করা হোক। কারণ, এগুলোর এলসি হয়ে গেছে এবং আটকে থাকার কারণে পচন ধরতে শুরু করেছে। এগুলো বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারলে ভারতের রপ্তানিকারক এবং বাংলাদেশের আমদানিকারক উভয়পক্ষই বড় ক্ষতির মুখে পড়বে।
বৈধ ছাড়পত্র থাকার পরও কেন সীমান্তে পেঁয়াজের ট্রাক আটকে রাখা হয়েছিল- জানতে চাইলে সূত্র জানায়, আসলে এবারের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের আকস্মিক সিদ্ধান্ত আসার নেপথ্যের কারণ মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, দিল্লি ও বিহারে আসন্ন রাজ্যসভার নির্বাচন। এমনিতেই গত কয়েক দিনে ভারতজুড়ে ক্রমেই পেঁয়াজের দাম চড়ে যাচ্ছিল। ফলে বিজেপি নেতারা নির্বাচনে ভোটের সমীকরণ বিবেচনায় বাংলাদেশে সাময়িকভাবে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম কমানোর তাগিদ দেন। এর ফলে হুট করেই বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত আসে। এরপর ভারতের বাজারে গত কয়েক দিনে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে বলেও সূত্র জানায়।
আমদানিকারকরা যা বলছেন :ভারতে আটকেপড়া পেঁয়াজ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন দেশের ব্যবসায়ীরা। গত সোমবার ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। রাতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগেই ওইদিন সকাল থেকে দেশে কোনো পেঁয়াজ ঢুকতে পারেনি। ফলে দেশটির মহারাষ্ট্রের নাসিক, গুজরাটসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বন্দরে আসা পেঁয়াজবোঝাই ট্রাকের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়তে থাকে। এর ফলে বিপাকে পড়েন বাংলাদেশের আমদানিকারকরা। ভারতের ব্যবসায়ীরা আশ্বাস দেন- আজ বা আগামীকালের মধ্যে আমদানি প্রক্রিয়ায় থাকা পেঁয়াজ নেওয়ার অনুমতি দিতে পারে ভারত। গতকাল রাতে অবশ্য সেই সিদ্ধান্ত আসে।
আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির পরে ভারত থেকে আমদানি বাড়িয়েছেন তারা। দেশটি থেকে আমদানি করা নাসিকের পেঁয়াজ বেশি আসে। সেখানে হিলি, ভোমরা, সোনামসজিদ ও বেনাপোল বন্দরে ট্রাক আসতে গড়ে ছয় থেকে সাত দিন সময় লাগে। ভারত রপ্তানি বন্ধের দিনে বন্দরগুলোতে তিন শতাধিক ট্রাক ছিল। এ ছাড়া পেঁয়াজবোঝাই ট্রাক নাসিক থেকে বন্দরগুলোতে আসার জন্য রাস্তায় ছিল। গড়ে প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রাক পেঁয়াজ আমদানি পর্যায়ে ছিল। এ হিসাবে গত পাঁচ দিনে প্রায় দেড় হাজার ট্রাক পেঁয়াজ নিয়ে বন্দরগুলোতে আসে। প্রতিটি ট্রাকে ২৫ থেকে ৩০ টন পেঁয়াজ রয়েছে। বন্দরগুলোতে থাকা ট্রাকে এখন ৪০ হাজার টনের বেশি পেঁয়াজ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৬০০ ট্রাকে থাকা ১৫ হাজার টনের বেশি পেঁয়াজের রপ্তানির প্রমাণপত্র (বিল অব এক্সপোর্ট) দিয়েছে ভারত। এখন রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশে আনতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির জন্য আরও ৫০ হাজার টনের বেশি পেঁয়াজের এলসি খোলা আছে।
ভোমরা স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও পেঁয়াজ আমদানিকারক মোস্তাফিজুর রহমান নাসিম জানান, আমদানির সব প্রক্রিয়া শেষ করা আছে। পেঁয়াজভর্তি ট্রাক বন্দরের ওপার থেকে কেবল এপারে আসার পথে আটকে আছে। তিনি বলেন, ভোমরা স্থলবন্দরে আসার প্রক্রিয়ায় থাকা ৫০০ ট্রাক পেঁয়াজের মধ্যে কিছু কলকাতা গেছে। কিছু বিভিন্ন গোডাউনে নামানো হয়েছে। এর পরও ওপারে রপ্তানি প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা তিনশ’র বেশি ট্রাকে সাড়ে সাত হাজার টন পেঁয়াজ রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৫ ট্রাকে থাকা চার হাজার টন পেঁয়াজে বৃষ্টি ও অতি গরমের কারণে পচন ধরেছে। এই পেঁয়াজের ৫০ শতাংশ নষ্ট হতে পারে। আজ থেকে এসব পেয়াজ দেশে ঢুকতে পারে।
হিলি স্থলবন্দরের আমদানিকারক মোবারক হোসেন বলেন, বন্দরে আটকে থাকা পেঁয়াজ বাংলাদেশে এলে আগামী দেড় মাস বাজার স্বাভাবিক থাকবে।
ভোমরা স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান নাসিম রাতে বলেন, ভোমরা বন্দরে প্রায় ২০০ ট্রাকের রপ্তানি অনুমতি পত্র দেওয়া হয়েছে। ট্রাকগুলোয় থাকা পেঁয়াজের পরিমাণ পাঁচ হাজার টনের বেশি হবে। তবে এ পেঁয়াজের মধ্যে আগে ও পরের ট্রাকের ব্যবধান ভেদে গড়ে ৩০ শতাংশ নষ্ট হয়েছে। এরপরে আমদানি খরচ ও নষ্ট পেঁয়াজ বাদ দিয়ে প্রায় ৪০ টাকা কেজি পড়বে। তিনি বলেন, এলসি খোলার ও পাইপলাইনে থাকা পেঁয়াজ আসার সুযোগ দিলে দাম আরও কমবে।
রাজধানীর বড় আড়ত শ্যামবাজারের রাজবাড়ী ভান্ডারের ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক মো. মাজেদ বলেন, ভারত খুব বেশি পরিমাণ পেঁয়াজ ছাড়ের অনুমতি দেয়নি। তারপরও এই পেঁয়াজ দেশে এলে দাম কমবে। এ ক্ষেত্রে বন্দরে এই পেঁয়াজের যে দাম পড়বে, সে অনুযায়ী বাজারে বিক্রিতে সরকারের তদারকি জোরদার করতে হবে। তাহলে ক্রেতারা এই পেঁয়াজ ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় কেনার সুযোগ পাবেন। তিনি বলেন, এই পেঁয়াজ বাজারে বিক্রি হতে না হতেই বিকল্প দেশের পেঁয়াজও দেশে আসবে। অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আসা শুরু হলে দাম স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
এদিকে ভারত রপ্তানি বন্ধের পর থেকে দেশের বাজারে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় পেঁয়াজের দাম। এক দিনেই দ্বিগুণ হয়। এর পরে আবার কিছুটা কমেছে। গতকাল রাজধানীর বাজারে খুচরায় আগের দিনের মতো প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৯০ থেকে ১০০ ও আমদানি করা পেঁয়াজ ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়। পাইকারি বাজারেও আগের দিনের দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৯০, দেশি ক্রস ৭৫ এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। গতকাল পাবনার মোকামে প্রতি কেজি ৭৫ থেকে ৮০ এবং ফরিদপুরে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি হয়।