দুর্নীতি আড়াল করতে সম্পত্তি হস্তান্তরে একের পর এক হেবামূলে দানের দলিল তৈরি করেছেন তথাকথিত হোমিও ডাক্তার শাহনাজ সিদ্দিকা। তার হোমিও ডাক্তারি পেশাটাও সাজানো। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী স্বামীর দুর্নীতির টাকায় নিজের নামে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদ করেছেন। এই পেশার নামে তিনি যে পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন, তা বিস্ময়কর। দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্রে এই খবর জানা গেছে।
স্বামী আরিফুর রহমানের দুর্নীতির অর্থে নিকটাত্মীয়দের নামে সম্পদ অর্জন করে পরে তা হেবামূলে দানসূত্রে নিজেদের নামে স্থানান্তর করেছেন। বাড়ি, জমি, রাজধানী সুপারমার্কেটের দোকানসহ নানা সম্পদ অর্জনে হেবা নাটক সাজিয়েছেন এই দম্পতি। দুদকের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীনের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে তাদের দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর তথ্য। অনুসন্ধানে ওইসব সম্পদের বৈধ উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি।
দুদকের অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, শাহনাজ সিদ্দিকা বর্তমানে কানাডাপ্রবাসী। তার স্বামী আরিফুর রহমান বর্তমানে সেই হোমিও দোকানে বসে সময় কাটান। আরিফুর ও শাহনাজের ফকিরাপুলের বাড়ির নিচতলায় হোমিওপ্যাথিক ওষুধের দোকানটি। আলমারি ভরা শিশি, বোতল, চেয়ার-টেবিলসংবলিত চেম্বারসহ সবই আছে। বাস্তবে এটি একটি প্রদর্শনী ছাড়া আর কিছুই নয়। দোকানটিতে নানা রকম শিশি-বোতলে ওষুধ নেই। রোগীর বালাই নেই। এখানে বসেই স্ত্রীর নামে অর্জিত সম্পদ দেখাশোনা করেন আরিফুর।
শাহনাজ সিদ্দিকার আয়কর নথিতে নিজেকে গৃহিণী উল্লেখ করা হলেও কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। সরকারি চাকরিকালে স্বামীর দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সব সম্পদ অত্যন্ত সুকৌশলে স্ত্রীর নামে রাখা হয়েছে। নিজেকে ঝামেলামুক্ত রাখতেই স্বামী আরিফুর রহমান এই পথ বেছে নিয়েছিলেন। অবশেষে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে থলের বিড়াল। দুর্নীতির টাকায় বাড়ি, শপিং কমপ্লেক্সে দোকানসহ বিভিন্ন সম্পদের মালিক হয়েছেন আরিফুর ও শাহনাজ। এই দম্পতির দুর্নীতির সব তথ্য-প্রমাণ দুদকের হাতে।
দুদক সূত্র জানায়, শাহনাজ সিদ্দিকা ছেলেমেয়েসহ কানাডায় বসবাস করলেও তার পক্ষে নিয়মিত আয়কর রিটার্ন দাখিল করা হচ্ছে। তার হোমিও ব্যবসার আয় দেখানো হচ্ছে। স্বামী আরিফুর রহমান দুদককে বলেছেন, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে বিদেশ থাকে বিধায় তাদের সম্পদ তিনি দেখাশোনা করছেন।
ঢাকার পীর ইয়ামেনী মার্কেটে দোকান :অনুসন্ধানে দেখা যায়, শাহনাজ সিদ্দিকা ঢাকার গুলিস্তান এলাকায় পীর ইয়ামেনী মার্কেটে ১৯৯৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর জি-২১নং দোকানটি বরাদ্দ পাওয়ার জন্য ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিন লাখ টাকা মার্কেটের সমিতির ব্যাংক হিসাবে জমা দেন। পরে ওই টাকায় তিনি দুটি দোকান বরাদ্দ পান। বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন ক্রয় বাবদ ২৫ হাজার টাকা দেন। এই হিসাব অনুযায়ী শাহনাজ মোট তিন লাখ ২৫ হাজার টাকা দেন। স্বামী আরিফুর রহমান স্ত্রীকে দিয়েছেন এই টাকা। অনুসন্ধানে এই টাকার বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি।
খদ্দর বাজার শপিং কমপ্লেক্সে দোকান :শাহনাজ গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর খদ্দর বাজার শপিং কমপ্লেক্সে তিন লাখ টাকায় ১৬৯নং দোকান ক্রয় করেন। মার্কেটের সদস্য পদের জন্য দিয়েছেন ২৫ হাজার টাকা। এই টাকারও বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি।
ব্যাংকের নথিতে গৃহিণী :আরিফুর রহমান দুদকের কাছে তার স্ত্রী শাহনাজকে একজন হোমিও ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। এদিকে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এনসিসি ব্যাংকের ঢাকার মতিঝিলে ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখায় স্ত্রীর একটি হিসাবের নথিতে পেশার ঘরে গৃহিণী লেখা হয়েছে।
লাকসামে জমি :কুমিল্লার লাকসাম সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী শাহনাজ ১২টি দলিলে জমি ক্রয় করেন। এর মধ্যে ১১টি দলিলে এক লাখ ২২ হাজার টাকা ও ১২নং দলিলে ৫৫ হাজার টাকা মূল্যের জমি ক্রয় করেন। এই টাকারও বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি।
জালিয়াতি করে হেবা দলিলে জমি :নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার সূত্রাপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে খোঁজ নিয়ে শাহনাজের ছয়টি হেবা দলিলে ৪৫ লাখ ৯২ হাজার টাকা মূল্যের জমির মালিক হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে দুদক। দলিলপত্রে দেখা গেছে, এই ক্ষেত্রে যারা হেবা বা দান করেছেন, তাদের আর্থিক অবস্থা নাজুক। এই টাকারও বৈধ উৎস নেই।
ঢাকার ফকিরাপুলে দানসূত্রে পাওয়া বাড়ি :ঢাকার ফকিরাপুলে ৯১.৫ অযুতাংশ জমিতে সাততলা ১৫৫/৩নং বাড়িটির মালিক আরিফুর রহমান ও তার স্ত্রী শাহনাজ। বাড়িটির দলিল যাচাই করে দেখা গেছে, শাহনাজের মা মৃত নূরজাহান বেগম, ভাই গিয়াস উদ্দিন ও বোন ফেরদৌস আরা সিদ্দিকা বাড়িটি তাদের হেবামূলে দান করেছেন। অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, আরিফুর রহমান চাকরিকালে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকায় বাড়িটি নির্মাণ করেছেন। শাহনাজের মা, ভাইবোনদের কাছ থেকে দানসূত্রে পাওয়া- এটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। গণপূর্ত বিভাগের হিসাব অনুযায়ী বাড়িটি নির্মাণে খরচ হয়েছে ২৬ লাখ ৩৯ হাজার ৩৪ টাকা। এর মধ্যে ১৭ লাখ টাকার ব্যাংক ঋণ রয়েছে। ব্যাংক ঋণ বাদে তার খরচ ৯ লাখ ৩৯ হাজার ৩৪ টাকা। এই টাকারও বৈধ উৎস মেলেনি।
দুদকের অনুসন্ধান থেকে আরও জানা যায়, শাহনাজের ভাই গিয়াস উদ্দিনের সাত ছেলেমেয়ে। ভাই তার ছেলেমেয়েকে বাদ দিয়ে একমাত্র বোন আর ভগ্নিপতি আরিফুর রহমানকে সব দান করে দেবেন- এটি অবিশ্বাস্য। দান করা ওই সব সম্পদ অর্জনের সামর্থ্য শাহনাজ সিদ্দিকা নিজের, তার বাবা, মা, ভাইবোনের কারোরই ছিল না।
দুদক সূত্র জানায়, আরিফুর রহমান নিজেকে ঝামেলামুক্ত রাখতে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ শাহনাজের বাবাকে দিয়েছেন। যিনি তার শ্বশুর। পরে ওই অর্থে শাহনাজের বাবা, ভাইবোনের নামে সম্পদ অর্জন করা হয়। কথা অনুযায়ী পরে এসব সম্পদই আরিফুর রহমান ও তার স্ত্রী শাহনাজকে হেবামূলে দান করা হয়। এই দম্পতির নামে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। যার পুরোটাই অবৈধ।