ছাত্রলীগ নেতার দাপটে অস্থির কুষ্টিয়াবাসী চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অভিযোগ

কুষ্টিয়ায় ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতার দাপটে সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছেন। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের নাম ভাঙিয়ে চলছে তার চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্ম। আমিনুর রহিম পল্লব নামে ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতার ক্যাডার বাহিনীও রয়েছে।
শহরের পৌর বাজার নিয়ন্ত্রণ, বাজারের জায়গা দখল, লোকজনকে মিথ্যা ঘটনায় হয়রানি করে অর্থ আদায়, টেন্ডারবাজি, জায়গা দখল- এমনকি চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িতরাও পল্লবের অপকর্মে ক্ষুব্ধ। আর সাধারণ মানুষ তার ভয়ে মুখ খুলছে না।
স্থানীয়রা জানায়, কুষ্টিয়ার থানাপাড়া এলাকায় পুরোনো পৌর বাজারসহ সরকারি-বেসরকারি নানা অফিস রয়েছে। এ ছাড়া শহরের একমাত্র বড় মার্কেটটিও ওই এলাকায়। এক সময় সেখানকার ক্রিসেন্ট ক্লাবকেন্দ্রিক চাঁদাবাজির বিষয়টি ছিল প্রকাশ্যে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থানাপাড়া এলাকার বাসিন্দা সাজ্জাদ হোসেন সবুজের উত্থান হয় রাজনীতিতে। তিনি প্রথমে শহর, পরে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পান। এরপর শহরে তার রাজত্ব ও অপকর্ম বাড়তে থাকে। টেন্ডার, বালুঘাট ও বাজার ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। ২০১৫ সালে ১৫ আগস্ট শহরে এক হত্যাকাণ্ডের পর সবুজ নিখোঁজ হন। এরপর তার কোনো খোঁজ মেলেনি। বছর না ঘুরতেই এলাকা দখল নেন আমিনুর রহিম পল্লব। পল্লব এক সময় জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। সবুজ নিখোঁজ হওয়ার পর সিভিল সার্জন অফিসের টেন্ডার তার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, এমনকি হাসপাতালে খাদ্য সরবরাহের কাজটিও তিনি দখলে নেন। একে একে বাজার, ঘাটসহ পুরো এলাকার কর্তৃত্ব নেন তিনি।
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় পল্লবের নানা অপকর্মের কথা। তার ভয়ে নিজের দোকানের দখল পাচ্ছেন না মহব্বত আলী নামে এক ব্যবসায়ী। পৌর বাজারের দক্ষিণে রেলের ধারে ওই ব্যবসায়ীর মার্কেট রয়েছে। সেই মার্কেটের ছয়টি দোকান নিয়ে বরফের ব্যবসা করেন মাছ ব্যবসায়ী বেলাল ও হোসেন। ২০১৬ সালে তাদের দোকানের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। এরপর গত চার বছর নতুন করে চুক্তিও করেননি আর গত আড়াই বছর ধরে ভাড়াও পরিশোধ করছেন না। মার্কেটটি সংস্কারের জন্য দোকান ছেড়ে দিতে বলেন মহব্বত। এরপর দোকান না ছেড়ে উল্টো পল্লবের কথা বলে মহব্বতকে ভয় দেখান। পল্লবও একাধিক দিন মহব্বতকে ফোন দিয়ে বিষয়টি ঠিক করে দেওয়ার কথা বলেন। এখন পুরো মার্কেটটি পল্লব দখলে রেখেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পৌর বাজারের খাসির মাংসের ব্যবসা করতেন কয়েক ব্যবসায়ী। মাংসের দোকান দখল করে সেখানে ভাইয়ের নামে মাছের আড়ত খুলেছেন পল্লব। ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। নাটোর থেকে যেসব মাছের গাড়ি আসে, তা পল্লবের আড়তে বিক্রি করা বাধ্যতামূলক। না হলে ব্যবসায়ীদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়। এ ছাড়া পৌর বাজারের ফলসহ অন্য আড়তদারদের কাছ থেকে টোলের নামে চাঁদা আদায় করা হয়।
মহব্বত জানান, আড়াই বছর ধরে ভাড়া পান না। পল্লবের কথা বলে বেলাল দোকান দখলে রেখেছেন। আদালতের আদেশ থাকার পরও দোকান বুঝে পাচ্ছি না।
সিভিল সার্জন অফিসের একটি সূত্র জানান, বর্তমানে পল্লব এখানকার সব টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন। গত কয়েক বছরে যেসব টেন্ডার হয়েছে তার সব তিনি একাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। গত মাসে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে গাছ বিক্রির টেন্ডার দেওয়া হয়। সেই টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন পল্লব। সেখানে শিডিউল কিনতে গেলে পল্লবের ক্যাডার হিরো সবাইকে বাধা দেয়।
পৌর বাজারের একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, পুরো বাজার পল্লবের একক নিয়ন্ত্রণে। এখান থেকে নিয়মিত টাকা আদায় করেন তিনি। বাইরে থেকে যেসব গাড়ি আসে, তাদের কাছ থেকেও টাকা নেওয়া হয়। তার ক্যাডার ফরিদ, তপন, গাড়া জনি, টুটুলসহ অন্যরা তার হয়ে কাজ করে। এ ছাড়া পল্লবের অন্যতম প্রধান সহযোগী মুরাদের শ্বশুর ডাক বাবু এলাকায় মাদক বিক্রি করে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া সাইকেল চুরির মামলায় পল্লব জেল পর্যন্ত খেটেছেন।
পৌর বাজারের সামনেই পরিমল থিয়েটার নামে নাট্যকর্মীদের একটি অফিস ছিল। পরে সেখানে সিনেমা হল করা হয়। সবুজের সময় ওই জায়গার দখল নিয়ে বহুতল মার্কেট করার জন্য ভেঙে ফেলা হয়। সেখানে এখন ১০ তলা বহুতল ভবন। সবুজের নেতৃত্বে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়। এখন এ ভবনটি পল্লবের দখলে। সেখানে তার ব্যক্তিগত অফিস রয়েছে। এই অফিসে প্রায়ই সালিশ বসানো হয়। সালিশের নামে লোকজনকে ধরে এনে নির্যাতন করা হয়। হুমকি দিয়ে আদায় করা হয় টাকা। টাকা না দিলে চলে অত্যাচার।
২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজি মোখলেছুর আলম বাবু বলেন, ‘পরিমল থিয়েটারটি আগে প্রকৃত নাট্যকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এরপর সবুজ সেটি দখলে নেয়। এখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে পল্লব। অথচ আমাদের মতো নাট্যকর্মীদের সেখানে অবহেলা করা হয়েছে। পুরো সম্পদটি দখল করে তারা লুটেপুটে খাচ্ছে। এর একটা সমাধান হওয়া প্রয়োজন।

থানাপাড়া এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত এক ব্যাংক কর্মকর্তার জমি কেনেন পল্লব। ১৩ লাখ দাম করে জমি নিলেও ৫ লাখ টাকা পরিশোধের পর আর কোনো টাকা দেওয়া হয়নি। উল্টো ওই ব্যাংকারের মেয়েকে হয়রানি করা হচ্ছে। জমি জালিয়াতির ঘটনায় তাকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে নিয়মিত।
শহরের তমিজ উদ্দিন মার্কেটে একটি মোবাইল পার্টসের দোকানে চাকরি করতেন সাজ্জাদুর রহিম মুন্না নামে এক যুবক। সেই দোকানের মালিক ছিলেন ছমির হোসেন। এরপর ওই যুবক স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র যোগদান করার পর দোকান মালিক ৪০ লাখ টাকা পাওনা আছে এমন অভিযোগ আনে তার বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে দোকান মালিক পল্লবের কাছে অভিযোগ করে। এরপর পরিমল থিয়েটারে পল্লবের অফিসে কয়েক দফা মিটিং করা হয়। নানাভাবে চাপ দিয়ে তার কাছ থেকে এক লাখ টাকা আদায় করে পল্লব ও তার লোকজন। পল্লবের ভয়ে তিনি অন্য কোথাও চাকরিও করতে পারছেন না।
সাজ্জাদুর রহিম মুন্না বলেন, মিথ্যা অভিযোগ এনে আমাকে হয়রানি করা হচ্ছে। নানা অজুহাতে তারা অর্থ নিচ্ছে। প্রতিকার পেতে আমি আদালতে যাব।
নানা অভিযোগের বিষয়ে আমিনুর রহিম পল্লব বলেন, কোনো দখলের সঙ্গে আমি জড়িত নই। এ ছাড়া বিচার-সালিশের নামে অর্থ আদায়ের অভিযোগও ভিত্তিহীন। এ ছাড়া টেন্ডারবাজিসহ যেসব অভিযোগের কথা হচ্ছে, তাও মিথ্যা।
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাত সমকালকে বলেন, ‘দখল, চাঁদাবাজ ও মাদক কারবারিদের জেলায় কোনো জায়গা নেই। অভিযোগ পেলে পল্লবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো অন্যায়কারীকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।