আবু সাইদ বিশ্ব:সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরায় মৎস্য ঘেরের ভেড়িতে সমন্বিত সবজি চাষে ভাগ্য খুলেছে হাজারো কৃষকের। সবজি বিক্রয় হচ্ছে খেতে। অল্প সময়ে স্বল্প জমিতে এ চাষে বিপ্লব দেখা দেয়ায় বেশির ভাগ কৃষকরাই মৎস্য ঘেরের ভেড়িতে সবজি চাষে ঝুঁকে পড়েছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় খালে-বিলে কৃষাণীর চালে মৎস্য ঘেরের ভেড়িতে শোভা পাচ্ছে লাউ, ভেন্টি, করলা, মিষ্টি কুমড়া, উচ্ছে, ঝিঙে, বরবটি, পলা, শিম, কুমড়া, পুইশাক, লাল শাক, পেঁপে, শসা, খিরাইসহ নানাবিধ সবজি। চলতি মৌসুমে জেলাতে কৃষি ও মৎস বিভাগের ১৬ লক্ষ ৩০ হাজার ৩৬৪ বিঘা জমির আইলে সবজি চাষের জন্য ভুমি প্রস্তুত করা হয়। এসব ভূমিতে ১৪ লক্ষ ৯৬ হাজার ৪১২ জন নারী ও পুরুষ সবজি চাষের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরক্ষ ভাবে জড়িত। সব মিলে ঘেরের আইলে সবজি চাষে এক মহা কর্মযোগ্য চলছে।
দেখতেও নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর এক প্রকৃতি। জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃৃষকরা দীর্ঘদিন খাদ্য সংকটে ভুগে এখন নিজেরাই নিজেদের পুষ্টি ও খাদ্য তৈরি করছে। বিশেষত তালা উপজেলার মিঠাবাড়ী পাচপাড়া, সরুলিয়া, ধানদিয়া, নগরঘাটা, তৈলকুপি, যুগিপুকুরিয়া, মাগুরা, মাদরা, কৈ খালি, শুকতিয়া,খলিষখালি,দুধলাই,পাকশিয়া,মঙ্গলানন্দকাটী, টিকারামপুর, বাগমারা, বালিয়াদাহ, খেশরা, হরিহরনগর, গাছা, মুড়াগাছাসহ একাধিক এলাকার পতিত জমিতে এখন সবজি আর মাছের বিপ্লব। কৃষকরা এক ফসলি জমিতে এখন বহু ফসলি জমিতে রূপান্তরিত করেছে। আরও জানা যায়, বর্তমান দেশে ও বিদেশে সবজির ব্যাপক চাহিদা হওয়ায় কৃষকরা দামও যেমন বেশি পাচ্ছে তেমনি কর্মসংস্থানের উৎস সৃষ্টি হচ্ছে।
গতকয়েক বছরে এ জেলায় মাচায় সবজি চাষে বৈপ্লিবিক পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে মাছের ঘেরে মাচা পদ্ধতিতে সবুজ সবজির চাষ কৃষিতে নবদিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছে। মাছা পদ্ধতিতে সবজি চাষে বদলে গেছে জেলার বহু কৃষকের ভাগ্য। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বাজার মনিটরিং এর দাবী সংশ্লিষ্টদের।
জেলা কৃষি বিভাগের হিসাব মতে জেলাতে চলতি মৌসুমে অনাবাদি,এক ফসলি ও জলাশয় এর ধারে এক লক্ষ ৪২ হাজার ১৫ হেক্টর ও মৎস্য বিভাগের ৭৬ হাজার ২৪৯ হেক্টর ঘেরের বেড়িতে সবজি চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ৪৬০২৬ হেক্টর অনাবাদি,৬২৪৯৪ হেক্টর জলাশয় ও ৩৩৪৯৫ হেক্টর এক ফসলি জমি রয়েছে।এছাড়া মৎস্য বিভাগে ৭৬ হাজার ২৪০ হেক্টর জমিতে গলদা,বাগদা ও সাদা মাছের ঘের রয়েছে। কৃষিতে মোট ৩৫৮৫৫০ টি পরিবারের ১৪ লক্ষ ৩৪ হাজার ২শজন সদস্য ও মৎস্য বিভাগে কর্মরত ৬২ হাজার ২১২ জন চাষী মৎস্য ঘেরের আইলে সবজি চাষ করে থাকেন। তবে লোনা পানির মৎস্য ঘেরের আইলে তেমন সবজি ভাল হয় না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ৭ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে সবজির চাষ হয়েছে। সদরে আবাদ হয়েছে ২২৫০ হেক্টর, কলারোয়াতে ৯৫০ হেক্টর,তালায় ১৬শ হেক্টর, দেবহাটায় ২৩০ হেক্টর, কালিগঞ্জে ১৪শ হেক্টর, আশাশুনিতে ৫৫০ হেক্টর ও শ্যামনগরে ৫২০ হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ হয়েছে।এর মধ্যে লাউ ২০৭ হেক্টর, লালশাক ২৩০ হেক্টর, পুইশাক ৬৪০ হেক্টর, ঢেড়শ ৫৯৫ হেক্টর, ডাটা ৩১০হেক্টর, বরবটি ২৪৯ হেক্টর, চালকুমড়া ১৬৫ হেক্টর, উ্েচ্ছ ৫০ হেক্টর, পটল ৪৯৫ হেক্টও জমিতে আবাদ হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, একজন মানুষের দৈনিক ২২৫ গ্রাম সবজি খাওয়া উচিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যন ব্যুরো বলছে সবজি উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান তৃতীয়। যার উল্লেখ্য যোগ সবজি ইদানিং সাতক্ষীরা জেলাতে উৎপাদিত হচ্ছে।
সূত্রমতে প্রতি বছর ৫০টি দেশে ৭শ কোটি টাকার সবজি রফতানি হচ্ছে। এতে বদলে যাচ্ছে কৃষকের ভাগ্য। সবজি চাষে এগিয়ে আসছেন জেলার শিক্ষিত তরুণরাও।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসেবে, গত চল্লিশ বছরে বাংলাদেশে সবজি উতৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। বেড়েছে সবজি জমির পরিমাণও। গত এক দশকে দেশে সবজির আবাদি জমির পরিমাণ বেড়েছে ৫ শতাংশ হারে। সেখানে জেলাতে সবজির আবাদ বেড়েছে ৬ শতাংশ হারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবছর উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে উৎপাদিত সবজির ৪০ ভাগ নষ্ট হচ্ছে। অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি পর্যাপ্ত সবজি সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা হলে এত সবজি নষ্ট হতো না। বর্তমানে দেশে ৬০ ধরনের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। এসব সবজির ৯০ শতাংশ বীজ দেশে উৎপাদিত হয়। দেশে চাষযোগ্য জমির মাত্র ১.৮ শতাংশ জমিতে শাকসবজি চাষ হয়। আর সাতক্ষীরা জেলাতে বর্তমানে ২ শতাংশ জমিতে সবজির চাষ হচ্ছে বলে সূত্র জানায়।
তালার নগরঘাটা ইউনিয়নের কাবাস ডাঙ্গা গামের কার্তিক মন্ডল এবছর ৮ বিঘা জমিতে মাচা পদ্ধতিতে সবজির চাষ করেছে। তার স্ত্রী জোনাকি মন্ডল প্রতিদিন সবজি তুলে বিক্রি করেন। দুজন মিলে প্রতি দিন সকালে তাদের উৎপাদিত সবজি সাতক্ষীরা খুলনা মহাসড়কে পাইকারী ব্যাপারীদের কাছে বিক্রি করেন। এতে তাপদের সংসার চলেও কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থাকেন। সেই টাকা দিয়ে ঘেরে মাছের খাবার কেনেন। এ বছর বৃষ্টির কারণে তার ঘেরে সবজির উৎপাদন অনেক কমেস গেছে। তবে দাম বিগত বছরের তুলনায় এবছর বেশি বলে জানান তিনি।একই এলাকার শানতলা গ্রামের হাফিজুর রহমান নগরঘাটা দক্ষিণ বিলে ২২ বিঘা জমিতে মাচা পদ্ধতিতে সবজি চাষ করেছেন। তার ঘেরে উৎপাদিত সবজি বিভিন্ন বাজারে বিক্রয় করেন । উৎপাদন কম কিন্তু দাম পেয়ে তিনি খুশি। মিঠাবাড়ীর সবজি ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান ও আমজাদ হোসেন পাইকারী ব্যবসায়ী জানান, পাটকেলঘাটার ভৈরবনগর মোড় থেকে প্রতিদন ৪০-৫০ জন চাষীর কাছ থেকে দেড়-দু’শ ক্যারেট সবজি ক্রয় করি। এসব সবজি পটুয়খালী, ময়মনসিংহ, বরিশাল, ও চট্টগ্রামে বাজারজাত করা হয়।
এ প্রসঙ্গে সাতক্ষীরা জেলা কৃষি খামার বাড়ির উপপরিচালক কৃষিবিদ নুরুল ইসলাম জানান, সাতক্ষীরায় যে পরিমাণ সবজি উৎপাদন হয়, তার ৩০ শতাংশ আসে ঘেরের আইলে অথবা ঘেরের মাচা থেকে। যা জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্যান্য জেলায় চলে যায়। এছাড়া লাভজনক হওয়ায় মাচা পদ্ধতিতে চাষাবাদ দিন দিন বাড়ছে। জেলাতে সবজি চাষে চাষীদের আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে। সবজি চাষে বিভিন্ন করণীয় সম্পর্কে তাদের সচেতন করা হচ্ছে। এতে কৃষিতে সবজি চাষে সবুজ বিপ্লব সৃষ্টি হতে চলেছে।
আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: ২৪/০৯/২০২০