চীন ও ভারতের মধ্যকার সকল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আলোচনায় বাংলাদেশ রণকৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে খুব সামান্য মর্যাদাই দাবি করতে পারে। সম্প্রতি এক টুইট বার্তায় ভারতের বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধী অভিযোগ করেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
গত কয়েক দশক ধরে তৈরি করা সম্পর্ক যা কংগ্রেস সযত্নে লালন করে এসেছিল, তা ধ্বংস করে দিয়েছেন। এরপর কংগ্রেস নেতা যদিও যথেষ্ট অস্পষ্টতার সঙ্গে উল্লেখ করেন যে , এমন প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারত বসবাস করে, যার কোন ভয়ঙ্কর বন্ধু নেই। তিনি তার দাবির স্বপক্ষে ইকোনমিস্ট নিবন্ধের একটি স্ক্রিনশট জুড়ে দেন । সেই নিবন্ধে বলা হয়েছে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক দুর্বল হচ্ছে আর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক হচ্ছে শক্তিশালী।
বোঝাই যায়, রাহুল গান্ধী তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার একটা ভালো সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। তিনি সতর্ক ছিলেন। ওই একই নিবন্ধ থেকে উপ শিরোনামটি তিনি বেছে নেননি। যাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার দুই এশীয় জায়ান্টের সঙ্গেই একসাথে পা ফেলতে চায় । সেটা ছিল আসলেই বাংলাদেশ যে ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়ে চলছে তারই একটা স্বীকৃতি ।
এবং দি ইকোনমিস্ট প্রকাশিত নিবন্ধের সেটাই ছিল মূল থিম । কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে এই বিষয়টি রাহুলের টুইটে হারিয়ে গিয়েছে।
তিনি যেটা তার টুইটের সঙ্গে স্ক্রিনশট হিসেবে জুড়ে দিয়েছেন , তাতেই পড়েছে ৪০ হাজার লাইক । এবং তিনি যে হুঁশিয়ার করে যে বার্তা দিয়েছেন , সেখানে রি-টুইট এসেছে ১১ হাজারের বেশি।
অবশ্য বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকছে, এরকম বার্তা দেয়ার ক্ষেত্রে গান্ধী একা নন । ‘ভারত বাংলাদেশে চীনের কাছে পিছিয়ে পড়ছে’।‘ বাংলাদেশ চীনের দিকে তার সিগন্যাল শিফট করে নিয়েছে’ কিংবা ‘দিল্লি-ঢাকা সম্পর্কের অবনতির কারণে চীন বাংলাদেশকে লুফে নিচ্ছে ‘ এই তিনটি সংবাদ শিরোনাম থেকে বোঝা যায়, খবরগুলো ওই একই বার্তা বহন করতে চাইছে।
তবে এই যে দাবি করা হচ্ছে তার পুরোটারই যে কোন যথার্থতা নেই তা কিন্তু নয় । ২০১৬ সালে চীন এবং বাংলাদেশ ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমঝোতা স্মারক সই করেছিল । চীন ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ এবং অবকাঠামোগত প্রকল্পে বাংলাদেশে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে । এবং বাংলাদেশে চীন হচ্ছে বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারী দেশ এবং দি ইকোনমিস্ট তার নিবন্ধের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছে যে, বাংলাদেশে চীন হচ্ছে এখন নাম্বার ওয়ান প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগকারী উৎস ।
যারা এই তত্ত্বের সমর্থক, তারা দেখাতে চাইছেন যে বাংলাদেশ-চীনের দিকে ঝুকে যাচ্ছে সেই সমর্থকদের তত্ত্বের একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক হচ্ছে, তারা বলতে চাইছেন বাংলাদেশ সাম্প্রতিককালে তিস্তা নদীর ব্যবস্থাপনার জন্য চীনের কাছ থেকে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার চেয়েছে।
তিস্তা ভারতের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত হচ্ছে । তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়টি বহু বছর ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার একটি কণ্টকিত বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে ।
যখন এইসব পয়েন্টগুলো গুরুত্বপূর্ণ , তখন ওই ধরনের বিশ্লেষণের সমস্যা হচ্ছে, যেটা সম্প্রতি উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা আসলে এই বিষয়টিকে খাটো করে দেখেছেন যে, বাংলাদেশে আসলে সত্যিই তার নিজের স্বার্থে পরিচালিত হতে সক্ষম। হয়তো সত্যি যে, ভারত এবং চীনের তুলনায় বাংলাদেশ দুর্বল । কিন্তু বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় বৃহত্তম শক্তিশালী রাষ্ট্র’ । এবং দেশটি এই সম্ভাবনা দেখাচ্ছে যে করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে তারা দ্রুততার সঙ্গে নিজেদেরকে রিকোভার করতে পারবে এবং দেশটি একটি স্মার্ট সরকার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এমনকি একটি কারচুপিপূর্ণ নির্বাচন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনে তাদের দুর্বল রেকর্ড এবং বিরোধী দলের ওপর তারা দমনপীড়ন চালাচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখতে পেরেছে বাংলাদেশ।
এখানে যে বিষয়টি উল্লেখ করার মতো সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং একই সঙ্গে চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ককে খাটো করে দেখাতে চায় না । বাংলাদেশ এতটাও অর্বাচীন নয় যে তারা চীনকে কদর করতে জানে না।
এই সম্পর্কের সমীকরণ এবং এই ত্রিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে যেটি শক্তিশালী সেটি হচ্ছে, ভৌগোলিক এবং ভূ রাজনৈতিক অবস্থান।
ভারত এবং বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম স্থল সীমান্ত শেয়ার করে থাকে। বাংলাদেশ বাস্তবেই ভারত দ্বারা চারদিক বেষ্টিত। আবার একই সঙ্গে ভারতের দিক থেকে বলা যায়, উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে তার যোগাযোগের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সেখানে পৌঁছাতে হয়। ভারতের জন্য বাংলাদেশ এমন এক দেশ , তার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে হবে শত্রুতা নয় এবং একই কথা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু এই রকমের একই যুক্তি চীনের সঙ্গে খাটে না।
চীনের দৃষ্টিকোণ থেকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে এমন একটা ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে রয়েছে, যা একটি কৌশলগত অবস্থান থেকে চীনের জন্য সে সামান্যই অফার করতে পারে । বর্তমান বাংলাদেশে ভারতকে স্থানচ্যুত করতে চীন যদি অনেক অর্থ খরচ করে, তাহলে তার বিনিময়ে ভারতকে অসন্তুষ্ট করা ছাড়া তার পক্ষে অর্জন করার ঝুলিতে জমা পড়বে সামান্যই।
চীন ইতিমধ্যেই মিয়ানমারের বন্ধু এবং তার অর্থ হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে গ্যাসফিল্ডের দিকে চীন সহজেই যেতে পারবে এবং সম্ভবত একটি বেল্ট এবং রোড কানেকশন দিয়েই সে চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় অংশকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করতে পারবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পুরো ভূখণ্ডকে পরিহার করতে সক্ষম ।
ইতিমধ্যেই চীনের একটি সামুদ্রিক বন্দর রয়েছে শ্রীলঙ্কায় এবং সে পাকিস্তানে অনেক বেশি বিনিয়োগ করছে।
এবং জাতিসংঘের কোনো ভোটাভুটি প্রশ্নে বেইজিংকে যদি ভোট কিনতে হয়, তাহলে সে খুব সহজে মাইক্রোনেশিয়া কিংবা ক্যারিবীয়দের দিকে তাকাতে পারে এবং সেটা তার জন্য খুব সস্তা এবং সেটা বর্তমানে সে করেও চলছে।
চীনের কাছে পাকিস্তান অধিকতর ইন্টারেস্টিং বিষয় । হরমুজ থেকে ঘনিষ্ঠ আরব সমুদ্রে তার অবস্থান এবং পাকিস্তানের সীমান্ত রয়েছে ইরান ,আফগানিস্তান ও ভারতের সঙ্গে । এমনকি চীনের সঙ্গেও তার রয়েছে সীমান্ত ।এবং পাকিস্তান জিহাদী জঙ্গিবাদের এক কঠিন উৎস এবং শিনজিয়াং প্রদেশে তার ছিটেফোটা আসছে কিনা, সেটা সে পাকিস্তানের কাছ থেকেই নজর রাখতে পারছে । পাকিস্তান এমনকি আরব এবং মুসলিম রাজনীতির জন্য এক বড় খেলোয়াড় এবং সর্বোপরি তাঁর রয়েছে একটি পারমাণবিক বোমা।
অথচ বাংলাদেশের এসব কিছুই নেই। সুতরাং এই গ্রেট পাওয়ার গেমের মধ্যে চীনের পক্ষ অবলম্বন করলে বাংলাদেশের অনেক কিছুই হারানোর বিষয় থাকবে । এই অবস্থান নিলে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত , অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানকে অসন্তুষ্ট করবে। এমনকি এই চারটি দেশ মিলে সম্প্রতি যে কোয়াড পুনর্গঠন করেছে, এখন যদি বাংলাদেশ চীনের পক্ষ অবলম্বন করে তাহলে তা তাকে অর্থনৈতিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে আহত করবে । কারণ মনে রাখতে হবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের বিলিয়ন ডলারের গার্মেন্টস শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ । অন্যদিকে জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের অবকাঠামো এবং সামাজিক উন্নয়নে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে একই সঙ্গে বাংলাদেশ অবশ্যই চীনকে অসন্তুষ্ট করতে চাইবে না।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম দি ইন্টারপ্রেটার ৯ই অক্টোবর এভাবেই পুরো বিষয়টির পর্যালোচনা করেছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশের জন্য তাই শ্রেষ্ঠ বিকল্প হচ্ছে, এই সবগুলো বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ একটি খেলার মধ্যে নিজেকে নির্দিষ্ট রাখা ।
এদিকে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সংকট নিয়ে দেশটির প্রকৃতই উদ্বেগ রয়েছে । ১০ লাখ শক্তিশালী রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ স্থিতি এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য একটি মারাত্মক হুমকি । এভিডেন্স এটাই ইঙ্গিত করছে এইসব পরাশক্তির মধ্যে কয়েকটি শক্তি বাংলাদেশকে চাপে রাখতে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সংকটকে ব্যবহার করছে এবং তারা একই সঙ্গে মিয়ানমারকে যুক্ত রাখছে । ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের বৃহৎ শক্তি বন্ধুদের কাছে মিয়ানমার তার থেকে আরো অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং বিষয়।
আমাদের কূটনৈতিক সম্পাদক সর্বশেষ পরিস্থিতি অবশ্য ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করছেন। তার মতে, বাংলাদেশ নিয়ে ভারত-চীনের লড়াইয়ের মধ্যে আচমকা ঢুকে পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা ঘনিষ্ঠ হতে চলেছে। এ নিয়ে একাধিক বৈঠকের খবরও পাওয়া যায়। করোনার মধ্যেই আগামী ১৩ই অক্টোবর ঢাকা আসছেন মার্কিন ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বাইগান। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা তার সফরের দিকে গভীর মনোযোগ রাখছেন। তারা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কি কোন বড় ধরনের পরিবর্তন হতে চলেছে? ভারতই বা এটাকে কিভাবে দেখছে? যাইহোক, পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে ভারসাম্য, নাকি চীন ঠেকানোর নীতি গ্রহণ করছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে সামনের দিনগুলো যে ঝুঁকিপূর্ণ হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।