বাংলাদেশ কেন সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করলো? এ নিয়ে নানা প্রশ্ন। কেউ কেউ বলছেন, ভারত-চীনের লড়াইয়ের মাঝখানে বাংলাদেশ বিকল্প পথ বেছে নিয়েছে। সোনাদিয়া বাতিল হলেও পঁচিশ কিলোমিটার দূরে মাতারবাড়িতে বন্দর ঠিকই হচ্ছে। তবে সেটা অর্থায়ন করবে জাপান। এসব বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়েছেন ভারতীয় সাংবাদিক সুধা রমাচন্দ্রন। দ্যা ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত নিবন্ধে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার সরকারিভাবে সোনাদিয়ায় প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ পরিকল্পনা থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলে এটি নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল।
এটি ছিল বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের এমন একটা হাইপ্রোফাইল প্রকল্প, যা ভারত মহাসাগরে চীনের অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত উচ্চাভিলাষকে ত্বরান্বিত করত। আর এখন সেটি বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে সমাহিত করল।
তবে প্রতীয়মান হয় যে, পরিবেশগত উদ্বেগ বিবেচনায় নিয়েই বাংলাদেশ সরকার এই প্রকল্প বাতিল করেছে।
সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হলে তা ওই অঞ্চলের জীববৈচিত্র বিপন্ন করত, সাংবাদিকদের কাছে এই মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের কেবিনেট সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
এখন সোনাদিয়ার পরিবর্তে একটি গভীর সমুদ্র নির্মাণ করা হবে মাতারবাড়িতে। এলাকাটি সোনাদিয়া থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে। তবে পরিবেশগত বিষয়গুলো এই প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে কাজ করলেও এই সম্ভাবনাও রয়েছে যে, বিষয়টির নেপথ্যে আছে ভূ-রাজনৈতিক কার্যকরণ। সেটিই ওই প্রকল্প বাতিলের ভাগ্য নিশ্চিত করে দিয়েছে ।
কারণ সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে ভারত এবং চীনের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। তারা উভয়ে বাংলাদেশের উপর প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিল । সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ পরিকল্পনার সূচনা ঘটেছে ২০০৬ সালে। এর বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থায়নে সম্মত হয়েছিল চীন।
২০১৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইজিং সফর করেন। ওই সফরকালে বাংলাদেশ ও চীনের সরকারের মধ্যে এই বিষয়ে একটি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা ঘটেনি ।
ওই প্রকল্পের বিষয়ে চীনের অব্যাহত ইন্টারেস্ট থাকা সত্বেও ঢাকায় ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরকালে তা আলোচনার এজেন্ডাভুক্ত হয়নি । গত ছয় বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশি কর্মকর্তারা এটাই বলে আসছেন যে, ওই প্রকল্পের পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে । কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়নি ।
এখন একটা পরিবর্তন সূচিত হলো । আগস্ট মাসের শেষে একটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে শেখ হাসিনা সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে সোনাদিয়া ডিপ সি পোর্ট অথরিটি অ্যাক্ট, ২০১২ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন এবং এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করলেন যে, প্রকল্পটি বাতিল করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সোনাদিয়ায় একটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণে খুবই আগ্রহী ছিল। কারণ চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দরের বিদ্যমান সমুদ্র বন্দর জাহাজ জট লেগেই আছে। এমনকি বন্দর দুটি তার সংলগ্ন সাগরের নাব্যতা হারিয়েছে। এসব বন্দর সেকারণে এখন খুব বেশি ভারী ওজনের মাল বোঝাই জাহাজ নোঙ্গর করতে পারে না ।
আর অবস্থা এমনই হয়েছে যে, বাংলাদেশ অভিমুখী কার্গোগুলোকে এখন শ্রীলঙ্কা ও সিঙ্গাপুরে মালামাল খালাস করতে হয় এবং সেখান থেকে ছোট জাহাজে করে নিয়ে আসা হয় বাংলাদেশে।
এর ফলে মালামাল পরিবহনে বিলম্ব এবং বাণিজ্য ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে । আশা করা হয়েছিল যে, একটি সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করা হলে তা খরচ কমাবে, ভোগান্তি কমাবে । ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন।
সোনাদিয়া সমুদ্র বন্দর নির্মাণের সঙ্গে আরও পরিকল্পনা ছিল চীনের ইউনান প্রদেশ, উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল এবং ভুটানের মত ভূবেষ্টিত অঞ্চলগুলোর জন্য এটি একটি আঞ্চলিক ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
২০০৬ সালে জাপানের পরিচালিত একটি সমীক্ষায় ইঙ্গিত করা হয়েছিল যে, একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য সোনাদিয়াই সবথেকে ভালো অবস্থানে রয়েছে ।
তাই প্রশ্ন হল, বাংলাদেশ কেন এই প্রকল্প বাতিল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল ? নয়াদিল্লি অব্যাহতভাবে সোনাদিয়া প্রকল্পে চীনের সম্পৃক্ততার বিরোধিতা করেছিল। কারণ তারা দেখেছে, ওই সমুদ্র বন্দরটি বঙ্গোপসাগর এবং ভৌগোলিকভাবে ভারতের নিকটবর্তী।
ভারতের অবশ্য এরকমের আশঙ্কাও রয়েছে যে, শ্রীলংকার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। চীন হয়তো ঋণ পরিশোধ করতে না পারার কারণে অদূর ভবিষ্যতে তার এই ধরনের স্ট্র্যাটেজিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা কৌশলগত অবকাঠামো চীনের কাছে হস্তান্তর করার জন্য চাপ দিতে পারে । এ ধরনের সম্ভাব্য দৃশ্যপটে নয়াদিল্লি ভীত হল এবং ভাবল, ভারতীয় নিরাপত্তা বলয়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
অবশ্য এটাও ঠিক যে বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত তার অবকাঠামো উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণে সর্তকতা অবলম্বন করে চলছে । এ ধরনের প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে সে কোনো একটি দেশের উপর নির্ভরশীল না থেকে অনেকগুলো দেশের কাছ থেকে কারিগরি সহায়তা ও আর্থিক সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ যদিও চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার । একই সঙ্গে আবার চীনের প্রতি উদ্বিগ্ন কিছু দেশের সঙ্গেও তার রয়েছে অংশীদারিত্ব । এর মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান , ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া। এরা সবাই বেইজিংয়ের প্রভাব সীমিত দেখতে আগ্রহী।
বাংলাদেশে এখন মাতারবাড়িতে যে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে তাতে জাপানি সহায়তা রয়েছে। সোনাদিয়ার মতোই মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দরটিও অবশ্য বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত এবং সেটা ভারতের নিকটবর্তী । তবে ভারত-জাপান শক্তিশালী সম্পর্কের আলোকে ভারত এক্ষেত্রে আপত্তি নাও তুলতে পারে । এই প্রকল্পের কাজ অবশ্য ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ তাই আশা করছে, ২০২৫ সালের মধ্যে সে তার প্রথম গভীর গভীর সমুদ্র বন্দরটি দেখতে পাবে । কিন্তু এর অর্থায়ন এবং নির্মাণ কাজ যারা করছে, সেই দেশটির নাম জাপান। চীন নয় ।