ফাঁড়িতেই নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যু ॥ কবর থেকে লাশ তোলার নির্দেশ

নাছির উদ্দিন শোয়েব, কবির আহমদ : সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতেই পুলিশের নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে রায়হান উদ্দিন আহমদের (৩৩)। ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষায় এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এদিকে রায়হানের লাশ কবর থেকে তুলে পুনরায় ময়নাতদন্ত করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। মামলার তদন্তে নেমেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবি আই)। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত হবে, দোষীকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করা হবে। ঘটনার মূল অভিযুক্ত ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়া পলাতক রয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করছে। তবে পুলিশ বলছে, অভিযুক্তরা তাদের হেফাজতেই আছেন। এর আগে গত সোমবার বিকেলে অভিযুক্ত এসআই আকবরসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত এবং তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
শনিবার (১০ অক্টোবর) রাতে রায়হান উদ্দিন আহমদকে ধরে নিয়ে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে পরদিন রোববার (১১ অক্টোবর) সকালে তাকে ওসমানী হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান। তিনি সিলেট নগরের আখালিয়া নেহারিপাড়া এলাকার বাসিন্দা। ঘটনার প্রথম দিকে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ছিনতাইকালে গণপিটুনিতে মারা গেছেন রায়হান। বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান উদ্দিনকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে নিহতের পরিবার। এ ঘটনায় রোববার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে এসএমপির কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতদের আসামী করে একটি হত্যা মামলা করেন নিহতের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি। মামলাটি মঙ্গলবার বিকেলে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটি তদন্তের জন্য পিবি আইতে স্থানান্তর করা হয়। পুলিশ বলছিল, গণপিটুনিতে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু যে জায়গার কথা পুলিশ বলছে, সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজ এবং স্থানীয়দের কথায় এমন ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি।
সিলেট সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের কলোনি নগরীর কাষ্টঘর এলাকা। পুলিশের দাবি অনুযায়ী গণপিটুনির ঘটনা জানার জন্য রাত ১২টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত এখানকার সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনা করেন স্থানীয় কাউন্সিলর। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে ওই এলাকার কোথাও কোনো গণপিটুনির দৃশ্য দেখা যায়নি। যদিও স্বজনরা জানান, ওই সময়ের মধ্যে এই এলাকায় গণপিটুনিতে রায়হানের মৃত্যু হয়। এ অবস্থায় এই ঘটনার সুষ্ঠ তদন্তের দাবি জানান স্থানীয় কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম মুনিম। তিনি বলেন, আসল যারা খুনি এমন ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত। তাদের শাস্তি কামনা করি।
কিন্তু এই মৃত্যুতে গঠিত তদন্ত কমিটি জানাচ্ছে, এলাকাবাসীর গণপিটুনি নয়, পুলিশের হেফাজতে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে গুরুতর আহত হন রায়হান। এরপর তাকে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
যা আছে ফুটেজে: রোববার রায়হানের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) উপকমিশনার (ডিসি-উত্তর) আজবাহার আলী শেখের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির একটি সূত্র জানায়, বন্দরবাজার ফাঁড়ির পাশঘেঁষা সিলেট পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা সেই সত্যতাই দিচ্ছে। ক্যামেরায় রায়হানকে পুলিশ ফাঁড়িতে আনা-নেয়ার ছবি ধরা পড়েছে। ওই ফুটেজে দেখা গেছে, গত শনিবার রাত ৩টা ৯ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে দুটি অটোরিকশা এসে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে থামে। সামনের অটোরিকশা থেকে তিন পুলিশের সঙ্গে রায়হানকে নামতে দেখা যায়। তিনি হেঁটে ফাঁড়িতে ঢোকেন। এর প্রায় তিন ঘণ্টা পর সকাল ৬টা ২২ মিনিটে একটি অটোরিকশা আসে বন্দরবাজার ফাঁড়ির সামনে। এর ঠিক দুই মিনিট পর ৬টা ২৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে দুই পুলিশের কাঁধে ভর করে রায়হানকে অটোরিকশায় তুলতে দেখা যায়। এরপর তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। এদিকে ফুটেজ ছাড়াও এ নির্যাতনের বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। নগরীর বন্দরবাজার ফাঁড়ি ইনচার্জ আকবর হোসেনের নেতৃত্বে এ নির্যাতন চালানো হয়। ইনচার্জসহ ৭ পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য মিলেছে।
লাশ তুলে পুনরায় ময়নাতদন্তের নির্দেশ: রায়হান উদ্দিন আহমদের লাশ তুলে পুনরায় ময়নাতদন্ত করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। নিহতের স্ত্রীর করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ নির্দেশ দিয়েছেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। পিবি আইয়ের কাছে মামলা হস্তান্তরের আগে পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল বাতেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর রায়হানের লাশ তুলে পুননায় ময়নাতদন্ত করার আবেদন করেন। পিবি আইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা মহিদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, সাবেক তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনে লাশ তোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে কখন তোলা হবে, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আদালতের আদেশ পাওয়ার পর লাশ তুলে পুনরায় ময়নাতদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এদিকে গতকাল বুধবার দুপুরে পিবি আইয়ের সদস্যরা ঘটনাস্থল বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়ি পরিদর্শনে যান। তারা ঘটনা সম্পর্কিত আলামত সংগ্রহ করেন।
হত্যা মামলার এজাহারে যা আছে: রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় গত রোববার রাত আড়াইটার দিকে তার স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় কোনো আসামীর নাম উল্লেখ না করে অজ্ঞাত রাখা হয়েছে। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, প্রতিদিনের মতো গত শনিবার বিকেল ৩টায় রায়হান উদ্দিন আহমদ কর্মস্থল নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেটে ডা. গোলাম কিবরিয়া ও ডা. শান্তা রানীর চেম্বারে যান। রাত ১০টার পর রায়হান বাসায় না ফেরায় তার মোবাইলে ফোন দেওয়া হয়। তখন তার ফোন বন্ধ পায় পরিবার। ভোর সোয়া ৪টার দিকে অন্য একটি নম্বর থেকে রায়হান তার মায়ের কাছে ফোন দেন। তখন রায়হান জানান, তিনি বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আছেন। তাকে বাঁচাতে দ্রুত টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে যেতে বলেন। রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে যান। তখন একজন পুলিশ সদস্য বলেন, রায়হান ঘুমিয়ে গেছে। আর যে পুলিশ সদস্য রায়হানকে ধরে নিয়ে এসেছেন, তিনিও বাসায় চলে গেছেন। ওই পুলিশ সদস্য রায়হানের চাচাকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফাঁড়িতে আসার কথা বলেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, ‘পুলিশের কথামতো হাবিবুল্লাহ আবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে ফাঁড়িতে যান। তখন দায়িত্বরত পুলিশ তাকে জানান, রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ওসমানী মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রায়হানের চাচা ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, রায়হানকে সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে তিনি মারা গেছেন। এ সময় হাবিবুল্লাহ পরিবারের অন্য সদস্য ও আত্মীয়স্বজনকে খবর দিলে তারা গিয়ে ওসমানী মেডিকেলের মর্গে রায়হানের ক্ষত-বিক্ষত লাশ দেখতে পান। এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ‘আমার স্বামীকে কে বা কারা বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে পুলিশি হেফাজতে রেখে হাত-পায়ে আঘাত করে এবং হাতের নখ উপড়ে ফেলে। পুলিশ ফাঁড়িতে রাতভর নির্যাতনের ফলে আমার স্বামী মারা গেছেন।’
থানাতেই রায়হানের মৃত্যু: সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) কোতোয়ালি থানাধীন বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে তিন ঘণ্টা ১০ মিনিট ৪০ সেকেন্ড অবস্থানকালেই পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যু হয় রায়হান উদ্দিন আহমদের। এসএমপি গঠিত তদন্ত কমিটির প্রথম দিনের তদন্তে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির প্রধান উপকমিশনার (ডিসি) আজবাহার আলী শেখ। শনিবার দিবাগত রাত ২টা ৩৮ মিনিটে নগরীর কাষ্টঘর এলাকা থেকে রায়হানকে বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা আটক করেন বলে জানান এসএমপির উপকমিশনার আজবাহার আলী শেখ। তিনি জানান, ওই এলাকারও সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ মিলেছে। সেখানে রায়হানকে গণপিটুনি দেওয়ার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। সিসিটিভির ফুটেজ, পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষী এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে এটা প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হয়েছে, বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে জখম হয়েছেন রায়হান। পরে তাঁকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।