চৌগাছায় ফেয়ার প্রাইসের  চাল উদ্ধার, দোকান সিলগালা

চৌগাছা (যশোর) প্রতিনিধিঃযশোরের চৌগাছায় অবৈধভাবে বিক্রিকৃত ২ হাজার কেজি ফেয়ার প্রাইসের (১০টাকা কেজি) চাল উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় উপজেলার স্বরূপদাহ ইউপির ফেয়ারপ্রাইস ডিলার ও খড়িঞ্চা ওয়ার্ড অওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূর ইসলামের নিকট থেকে চাল বিতরণের মাস্টাররোল জব্দ এবং অবৈধভাবে এই চাল বিক্রিকারী ওই ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুল মান্নানের ছোট ভাই বিল্লাল হোসেনের দুটি দোকান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রকৌশলী এম. এনামুল হক এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) নারায়ণ চন্দ্র পাল এই চাল উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেন।
জানা গেছে স্বরূপদাহ ইউনিয়নের ফেয়ার প্রাইস (১০টাকা কেজি) ডিলার নূর ইসলামের নিজের কোন গুদাম বা দোকান নেই। তিনি খড়িঞ্চা ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বার আব্দুল মান্নানের আপন ছোট ভাই বিল্লাল হোসেনের মুদি ও সারের দোকানে রেখে ফেয়ার প্রাইসের চাল বিক্রি করেন। ওই দোকান থেকে সরকারি বস্তার চাল বস্তা পরিবর্তন করে প্লাষ্টিক বস্তায় করে ৪০ বস্তা চাল ইউনিয়নের কমলাপুর মোড়ে (খড়িঞ্চা) ওই ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুল মান্নানের চাতালে নিয়ে রাখা হয়েছে সংবাদের ভিত্তিতে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সেখানে অভিযান চালান উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রকৌশলী এম. এনামুল হক ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) নারায়ণ চন্দ্র পাল।
সরেজমিনে অভিযানের সময় দেখা যায় অভিযানের খবর টের পেয়ে অভিযানের আগেই সেই চাল পাশ^বর্তী মহেশপুর উপজেলার শ্যামনগরে অবস্থিত একটি রাইস প্রসেসিং মিলে নিয়ে রাখেন ওই চাল ক্রয়কারী চাল ব্যবসায়ী মোজাহের হোসেন।
অভিযানের সময় মেম্বার আব্দুল মান্নান চাতালে হাজির হয়ে জানান তার ভাইয়ের দোকানে রেখে ফেয়ারপ্রাইস ডিলার নূর ইসলাম চাল বিক্রি করেন। সেখান থেকে কার্ডধারীদের কাছ থেকে চাল ক্রয় করেন তার আপন ছোটভাই বিল্লাল হোসেন। সেই চাল বিল্লাল তারই (মেম্বার মান্নানের) চাতালের লিজ ব্যবসায়ী মোজাহের হোসেন ক্রয় করেছেন। তবে মেম্বার মান্নান তখন জানান চাল এই চাতালে আনা হয় নি। চাতালে চাল নেই। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ব্যবসায়ী মোজাহের হোসেনকে চাতালে ডাকতে বলেন মেম্বার আব্দুল মান্নানকে। মেম্বার মোজাহেরকে মোবাইলে কল দেয়ার সময় আড়ালে চলে গিয়ে আস্তে করে কিছু শিখিয়ে দেয়া দেখে ফেলেন ইউএনওর নিরাপত্তার দায়িত্বপালনকারী দু’জন আনছার সদস্য। এতে সন্দেহ বেড়ে যায়। এরপর ব্যবসায়ী মোজাহের চাতালে এসে বিল্লালের কাছ থেকে চাল কেনার কথা স্বীকার করলেও তিনি বলেন অল্প কিছু চাল কিনেছি। সেটা আমি চটে বিক্রিকারীদের (খুচরা বিক্রেতা) কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। বারবার জিজ্ঞাসা করলেও তারা একই কথা বলতে থাকেন। একপর্যায়ে চাল প্রসেসিং করতে চাতালের অল্প কিছু দুরে মহেশপুর উপজেলার শ্যামনগরে একটি রাইস প্রসেসিং মিলে চাল রেখেছেন বলে জানান ব্যবসায়ী মোজাহের হোসেন। তবে তিনি তখনও বলেন ২০ বস্তা (১০০০ কেজি) চাল কিনেছেন। এরপর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নির্দেশে ওই প্রসেসিং মিলে গেলে দেখা যায় সেখানে তিনি শুক্রবার সকালে ৮৮ বস্তা চাল প্রসেসিংয়ের জন্য দিয়েছেন। সব চালই সরকারী ফেয়ারপ্রাইসের কিনা জানতে চাইলে ব্যবসায়ী মোজাহের হোসেন বলেন তিনি ইউপি মেম্বার মান্নানের ছোট ভাই বিল্লালের কাছ থেকে ২০ কুইন্টাল (২০০০ কেজি) অর্থাৎ ৪০ বস্তা চাল কিনেছেন ৩৭ টাকা কেজি দরে। যা প্রসেসিংয়ের জন্য ওই মিলে রেখেছেন। এতক্ষণ মিথ্যা বলছিলেন কেন প্রশ্নে ব্যবসায়ী মোজাহের কোন জবাব দিতে পারেন নি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রশ্ন করেন অবৈধ জেনেও সরকারি চাল কিনেছেন কেন প্রশ্নেও তিনি লা জবাব থাকেন। পরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাকে এই ৪০ বস্তা চাল নিয়ে তার লিজ চাতালে (মান্নান মেম্বারের চাতাল) রাখার নির্দেশ দেন।
এরপর খড়িঞ্চা বাজারে যে দোকানে (মেম্বার মান্নানের ভাই বিল্লালের) ফেয়ার প্রাইসের চাল বিক্রি করা হয় সেখানে যান উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও এসিল্যান্ড। সেখানে উপজেলা নির্বাহী অফিসার পৌছানোর আগেই বিল্লাল এন্টার প্রাইজের মালিক বিল্লাল হোসেন দোকান খোলা রেখে মোবাইল ফোন বন্ধ রেখে পালিয়ে যান। ফোন বন্ধ করে রাখেন ডিলার ও খড়িঞ্চা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূর ইসলামও। সেখানে দেখা যায় দোকানের মধ্যে ২৬ বস্তা চাল রয়েছে (৫০ কেজি বস্তা)। এসময় ইউপি মেম্বার আব্দুল মান্নান জানান গত তিনদিনে বিক্রির সময় এ কয়জন কার্ডধারী চাল নেননি। এরপর মেম্বার আব্দুল মান্নানকে পাঠিয়ে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে আসা হয় ডিলার নূর ইসলামকে। তিনি এসে বলেন ২৪ জন চাল নেননি। কিন্তু মাস্টাররোল পরীক্ষা করে দেখা যায় ২০ জন চাল নেননি। এরপর ডিলার নূর ইসলাম স্বীকার করেন আগের বারের চার বস্তা চাল এখনো কার্ডধারীরা না নেয়ায় রয়ে গেছে। এসময় উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাস্টাররোল ঘেটে চাল নিয়েছেন এমন কয়েকজনের নাম ধরে তাদের ডেকে আনতে বললেও মেম্বার বা ডিলার তাদের আনতে পারেননি। এসময় বিল্লালের দোকানে একটি বস্তায় বিক্রির জন্য রাখা চালও ফেয়ার প্রাইসের বলে প্রতীয়মান হয়।
মেম্বার আব্দুল মান্নান এসময় বলেন এই ডিলারের অধীনে তিনটি ওয়ার্ডের চাল বিক্রি করা হয়। আমার ওয়ার্ডে (খড়িঞ্চা) কোন অনিয়ম নেই। বহিলাপোতা ওয়ার্ডে এবং আন্দারকোটা-টেঙ্গুরপুর ওয়ার্ডে চরম অনিয়ম রয়েছে। সেখানে অনেক অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তি যাদের ৮/১০ বিঘা করে জমি রয়েছে তারাও এই কার্ড পেয়েছেন। এরাই চাল নিয়ে বেশি দামে বিক্রি করে দিয়ে যায়। আর সেই চাল আমার ছোটভাই কিনেছে। তিনি এ সময় আরো বলেন আমার ছোটভাই বিল্লাল হোসেন ভয় পেয়ে মোবাইল বন্ধ করে পালিয়ে গেছে।
চালের ডিলার ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সম্পাদক নূর ইসলাম বলেন চাল আমি বিক্রি করিনি। বহিলাপোতা ও আন্দারকোটা-টেঙ্গরপুর ওয়ার্ডের অবস্থাসম্পন্ন কার্ডধারীরা বিক্রি করেছে। তিনিও বলেন এই দুটি ওয়ার্ডের বেশিরভাগ কার্ডধারীই (কয়েকজনের নামও বলেন) অবস্থাসম্পন্ন। তারা চাল তুলে বিক্রি করে দেন। বিল্লাল এই চাল প্রায়ই কিনে থাকেন। তিনিই সেই চাল কিনে আজও বিক্রি করেছেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রকৌশলী এম এনামুল হক বলেন, ৪০ বস্তা (২ হাজার কেজি) চাল উদ্ধার করে ব্যবসায়ী মোজাহেরের (যিনি চাল কিনেছেন) হেফাজতে রাখা হয়েছে। চাল বিক্রিকারী বিল্লাল হোসেনের দুটি দোকান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চাল বিক্রির মাস্টাররোল জব্দ করা হয়েছে। তদন্ত করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কার্ডধারীদের মধ্যে অবস্থাসম্পন্নদের পাওয়া গেলে তাদের কার্ড বাতিল করা হবে।

Check Also

১৫ বছরে আওয়ামী লীগ ২৬ লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে; ডা. শফিকুর রহমান

জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ ২৬ লাখ কোটি টাকা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।