সাতক্ষীরার কলারোয়ায় একই পরিবারের ৪ সদস্য খুনের রহশ্য উন্মোচন: হত্যায় ব্যবহৃত চাপাতি উদ্ধার: ভাই ভাবী ভাইপো ও ভাইজিকে একাই খুন করে ছোটভাই রায়হানুর

সাতক্ষীরার কলারোয়ায় লোমহর্ষক ৪ মাডার হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত চাপাতি উদ্ধার: মাকে খুজছে বেঁচে যাওয়া ৫ মাসের শিশু মারিয়া: বিচার নিয়ে সংশয়: কলারোয়ায় সংঘটিত হত্যাকান্ডের একটিরও বিচার পায়নি স্বজনরা

আবু সাইদ বিশ্বাস:  ক্রাইমবাতা রিপোট: সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার কলারোয়া একই পরিবারের ৪ জনকে নৃশংস ভাবে জবাই করে হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ছোটভাইয়ের মাদক ব্যবসায় বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে রোমহর্ষক এই হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। এ ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক নিহতের ছোট ভাই রায়হানুর রিমান্ডে থাকা অবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। তার দেয়া স্বীকারোক্তি মূলক জবান বন্ধি অনুযায়ী সিআইডি পুলিশ ঘটনাস্থলের পাশ্ববর্তী পুকুর থেকে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত চাপাতি উদ্ধার করেছে।

পারিবারিক দ্বন্দ্বে তরল পানীয়র সাথে ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে ভাই ভাবী ভাইপো ও ভাইজিকে একাই খুন করে ছোটভাই রায়হানুর। প্রেস ব্রিফিংয়ে সিআইডির এডিশনাল ডিআইজি এই তথ্য দিয়েছেন। আজ বিকাল ৫টার দিকে সাতক্ষীরা সিআইডি অফিসে উক্ত প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়

এরআগে মঙ্গলবার রাতে সিআইডি পুলিশের বিশেষ পুলিশ সুপার আনিচুর রহমান জানান, হত্যা মামলায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে প্রতিবেশি আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল মালেক ও ধানঘরা গ্রামের বাসিন্দা ও শাহিনুরের ঘের কর্মচারি আসাদুলকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত আব্দুল মালেকের ৭দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়েছে সিআইডি। হত্যার দিনই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয় নিহতের ছোটভাই রায়হানুলকে। পরের দিন রায়হানুলকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। বর্তমানে রায়হানুল ৫ দিনের পুলিশ রিমান্ডে রয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ১৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রাতে কলারোয়া উপজেলার খলসি গ্রামের একই পরিবারের চার সদস্যকে গলা কেটে হত্যার ঘটনার পর শিশু মারিয়াকে ঘাতকরা নিহত মা ও ভাইবোনের পাশে রেখে চলে যায়। শাহাজান আলীর ছেলে হ্যাচারি মালিক নিহত শাহিনুর রহমান ও তার স্ত্রী সাবিনা খাতুন, ছেলে সিয়াম হোসেন মাহি ও মেয়ে তাসনিমকে কলারোয়ার ব্্রজবাকসা গ্রামে নানার বাড়িতে দাফন করা হয়। রাতে শাহিনুরের শাশুড়ি ময়না খাতুন বাদী হয়ে কলারোয়া থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে হত্যা মামলা (নম্বর-১৪) দায়ের করেন। মামলায় তাৎক্ষনিক কলারোয়া থানা পুলিশ কুল কিনারা করতে না পারায় এই মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সাতক্ষীরা সিআইডি পুলিশকে। এরপর নিহত শাহিনুরের ছোট ভাই রায়হানুল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে সাতক্ষীরা সিআইডি পুলিশ। মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম ১৮ অক্টোবর রবিবার গ্রেফতার নিহতের ভাই রায়হানুল ইসলামকে ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে রবিবার ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত।

কলারোয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মফিজুল জানান, নিজেদের ঘরের মধ্যে গ্রহ প্রধান শাহিনুর রহমানসহ ৪ জনকে জবাই করে হত্যার ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করা হয়েছে। বেশিরভাগ হত্যাকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের রিমান্ডে নিলে হত্যার সব রহস্য উন্মোচন হবে।

এ লোমহর্ষক এ হত্যাকান্ডের ব্যাপারে সাতক্ষীরা সিআইডি পুলিশের বিশেষ পুলিশ সুপার আনিচুর রহমান জানান, হত্যাকান্ডট দীর্ঘদিনের পরিকল্পিত। অধিকতর তদন্ত চলছে। মামলার ক্লু বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে । হত্যা কান্ডের সাথে জড়িত বেশিরভাগ খুনিদের গ্রেফতার করা হয়েছে।

এদিকে চাঞ্চল্যকর ফোর মার্ডারের সময় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া ৫ মাসের ফুট ফুটে কন্যা শিশু মারিয়াকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা। প্রতি দিন শিশুটিকে দেখতে আসছে দূরদূরান্ত থেকে। গত ১৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার ভোরে কলারোয়া উপজেলার হেলাতলা ইউনিয়নের খলিসা গ্রামের নিজ বাড়ীতে নিহত ৯ বছরের ভাই সিয়াম হোসেন মাহি, ৬ বছরের বোন তাসনিম ও মা সাবিনা খাতুনের গলা কাটা নিথর রক্তাক্ত দেহের পাশে রক্তের উপর শুয়ে দুধের তৃষ্ণায় কান্নায় ছটফট করতে থাকা শিশু মারিয়াকে উদ্ধার করেন প্রতিবেশি আনিছুর রহমান। এসময় পাশের পরে দুপুরে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল ঘটনাস্থলে এসে শিশু মারিয়াকে প্রতিতবেশিদের নিকট থেকে তুলে নিয়ে তার দায়িত্বভার গ্রহণ করে হেলাতলা ইউনিয়নের সংরক্ষিত আসনের ইউপি সদস্য নাসিমা খাতুনের কাছে তুলে দেন। এরপর থেকে ইউপি মেম্বার মায়ের মমতা ও আদর দিয়ে লালন-পালন করছেন শিশুটিকে।

গত৭ দিন যাবত শিশুটি এখন ইউপি সদস্য নাসিমা খাতুনের কাছে রয়েছে। তিনি এখন শিশুটির দেখভাল করছেন। বাড়ীতে কোন শাড়ি পরিহিত মহিলা দেখলেই শিশু মারিয়া তার গর্ভধারিনী মায়ের মুখের খোঁজে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছে। কখনো কখনো হাসছে আবার কখনো হঠাৎ করে আতঁকে কেঁদে উঠে। তখন কোন ভাবেই তাঁর সে কান্না থামানো যায় না। আবর কখনো কান পেতে অন্যদের কথা শুনছে। কিন্তু মায়ের কোল হারা শিশুটি এখনও সে সুস্থ আছে বলে জানালেন ইউপি সদস্য নাছিমা খাতুন। মারিয়ার কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, মারিয়াচাঞ্চল্যকর ফোর মার্ডার; আঁতকে কেঁদে উঠছে বেঁচে যাওয়া সেই ৪ মাসের শিশুর শেষ ঠিকানা কোথায় হবে জানিনা। আমার দুই ছেলে, কোনও মেয়ে সন্তান নেই। এখন থেকে মারিয়াই আমার কন্যা সন্তান। নিজ খরচে বাবা-মায়ের স্নেহ-ভালবাসা আর আদর সোহাগ দিয়ে আমি ওকে বড় করতে চাই। এজন্য প্রশাসনের সহযোগিতা দরকার। জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল মহদয় আইনগত ভাবে যদি শিশুটিকে লালন-পালন করার দ্বায়িত্ব দেন তাহলে আমি তার প্রতি এবং সরকারের প্রতি চির কৃতজ্ঞ থাকবো। আমার বড় ছেলের ৮ মাসের একটি বাচ্চা আছে। শিশু মারিয়াকে পরিবারে আনায় পরিবারের সবাই দারুন খুশি।

কলারোয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মৌসুমী জেরিন কান্তা বলেন, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে শিশুটিকে ইউপি সদস্যের হেফাজতে রেখে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিচ্ছি ও দেখভাল করছি। তার জন্য খাদ্য ও পোশাক কিনে দিয়েছি। তার স্বাস্থ্যসেবার খোঁজ নিয়েছি।
জেলা প্রশাসক এস.এম মোস্তফা কামাল সাংবাদিকদের জানান, বাবা-মা, ভাই-বোনসহ একই পরিবারের ৪ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করায় এই মুহূর্তে শিশু মারিয়ার কোনও অভিভাবক নেই। যাতে কন্যা শিশু মারিয়া ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে, আমি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি।

এদিকে কলারোয়ায় সংঘটিত কয়েকটি নৃশংস হত্যাকান্ডর একটিরও বিচার  না পাওয়া নিয়ে  স্বজনদের নানা অভিযোগ  রয়েছে। সর্বশেষ গত ১৪ অক্টোবর গভীর রাতে একই বাড়ির ৪ খুনের ঘটনার বিচার হবে কি হবে না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে ওই এলাকার সাধারণ মানুষের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০০ সালের ২ মার্চ তারিখে কলারোয়ার এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রের কলেজ ভেন্যুতে ৪টি তরতাজা প্রাণ ঝরে যায়। তদন্তে এ ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলা হলেও পরিকল্পিতভাবে এ হত্যার ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে সে সময়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন কলারোয়ার হঠাৎগঞ্জ হাইস্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী কেড়াগাছি গ্রামের শামসুন্নাহার লিপি, যুগিখালী হাইস্কুলের শিক্ষিকা ফজিলাতুন্নেসা এবং সাবেক কলেজছাত্র হাবিবুর রহমান ও মামুনুর রশীদ। শেষোক্ত দুইজন তাদের স্বজন পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা হলে পৌছে দিতে এসেছিলেন।
পরীক্ষা চলাকালে কলেজ ক্যাম্পাসের চারপাশে ১৪৪ ধারা জারির কোন নির্দেশ না থাকায় বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থী কেন্দ্রের কলেজ ভেন্যুতে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। এসময় হইহট্টগোলের সৃষ্টি হলে রেলিং বেয়ে ছাদে উঠে পুলিশ হুইসেল দেয়। এরই মধ্যে কে বা কারা নিচের কলাপসিবল গেট আটকে দেয়। এসময় প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে শিক্ষিকা ও পরীক্ষার্থীর ছাত্রীরা অপমানজনক অবস্থার শিকার হন। ভীড়ের চাপে ৪ জন পদদলিত হয়ে প্রাণ হারান। এ ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত এ মামলা খারিজ হয়ে যায়। তার আগে পুনঃতদন্তে সিআইডি ১৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করে আদালতে।

এদিকে ২০১৫ সালের ১৫ জুলাই রাতে কলারোয়ার সোনালী ব্যাংকে দুই নৈশ্যপ্রহরীকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। দুই নৈশ প্রহরীরা হলেন উপজেলার ঝাঁপাঘাট গ্রামের আব্দুল কাইয়ুমের ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন (৩০) ও সদর উপজেলার হরিসপুর গ্রামের আনারুল ইসলামের ছেলে আসাদুজ্জামান রিপন (৩২)। সে দিনের এ হত্যার ঘটনায় তৎকালীন ব্যাংক ম্যানেজার মনতোস সরকার বাদী হয়ে কলারোয়া থানায় অজ্ঞত ব্যক্তিদের নামে একটি হত্যা মামলা নং (১৮) ১৫/৭/২০১৫ দায়ের করেন। এই জোড়াখুন মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয় সিআইডির ওপর। সেটি এখনও শেষ নামেনি।

অন্যদিকে ১৯৬৫ সালে কলারোয়ার বোয়ালিয়া গ্রামে একই পরিবারের গৃহকর্তা মোসলেম উদ্দিন, তার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে সহ ৫ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ নিহতের বাবা মোহাম্মদ আলী ও মাকে গ্রেফতার করে। পরে তারা ছাড়া পেয়ে যান। এই ৫ খুনেরও বিচার হয়নি এখনও।

আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা: ২১/১০/২০২০

Check Also

সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ডের উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ড (রাজারবাগান ও সরকারপাড়া ইউনিট) এর উদ্যোগে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।