বাংলাদেশ রাষ্ট্র মানুষের ভীড়ে উপচে পড়া। জনাকীর্ণ। জনবহুল। বন্যায় বড় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। একাত্তরে প্রতিষ্ঠিত দেশটি ইন্টারনেট প্রযুক্তির চেয়ে খুব বেশি পুরানো নয়। এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ধনী দেশ। এই সপ্তাহের একটি তথ্যে পুরো অঞ্চল হতবাক। তোলপাড় চলছে।
পাঁচ বছর আগে ভারত ২৫ শতাংশের ব্যবধানে যেখানে নেতৃত্বে ছিল, সেখানে এই বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে।
করোনার মধ্যে এই ভারসাম্যটি বাংলাদেশের জন্য কতোটা ইতিবাচক বার্তা বয়ে এনেছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ভারত যখন ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে লড়াই করছে, বাংলাদেশের ডেটা-নেতৃত্বাধীন উদ্ভাবনী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং উন্নত ডিজিটাল অবকাঠামোর ফলে তার অর্থনীতি তখন দ্রুত সচল হতে পেরেছে। তবে বিশ্ব কি এটা লক্ষ্য করবে এবং বুঝতে পারবে যে প্রথাগত উন্নয়ন অংশীদারদের বাইরে দক্ষিণ এশিয়ার আরও নতুন (এবং আরও স্থিতিশীল) এক অংশীদারের উত্থান ঘটেছে? এক নতুন ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ কি বাণিজ্য চুক্তির জন্য রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে অগ্রাধিকার দেবে? এবং নয়া মার্কিন রাষ্ট্রপতি (তা সে কিনা ডোনাল্ড ট্রাম্প বা জো বাইডেন, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে যেই আসুন) বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় অগ্রাধিকার হিসাবে বিবেচনা করবে, নাকি আগের মতোই সে কেবল তার পরিচিত অংশীদারদের সাথে লেপ্টে থাকবে?
অবশ্যই এই সংবাদ আগের হিসাব-নিকাশ বদলে দেবে। যার দ্বারা একটি অর্থনীতি – এবং একটি রাষ্ট্রের শক্তি বিচার করা হয়। এখন একটি দেশের মুদ্রা, রপ্তানি এবং প্রশাসনের দিকে নজর দেয়াটা আরো বড় করে দেখা নয়। বরং এর পরিবর্তে এখন তার ‘বায়োসিকিউরিটি’ সক্ষমতা দেখা হবে। এখন একে জাতীয় সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে দেখা হবে । কারণ এটা এমন একটা নীতির সাফল্যের বিষয়, যা অন্য কিছু তৈরি করতে বা ভেঙে ফেলতে পারে।
এটা কেবল বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিষয় নয়। এটা বলা যাবে না যে, বাংলাদেশের বর্তমান বিকাশে শুধু জিডিপি অবদান রেখেছে। ভারত মহামারীটি মোকাবেলায় স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকেই মারাত্মক অব্যবস্থাপনার পরিচয় দিয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটটিও বিবেচনায় নিতে হবে।
দ্রুত ও কার্যকর মহামারী ব্যবস্থাপনা কীভাবে অব্যাহত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সমর্থন করতে পারে, চীন তার সর্বোত্তম উদাহরণ। সেখানে জনগণের ব্যয় করার সক্ষমতা ইতিমধ্যে মহামারীর পূর্ব আকারে ফিরে এসেছে এবং ত্রৈমাসিকের শেষ প্রান্তিকে জিডিপি পাঁচ শতাংশ বেড়েছে।
তবে চীন একটি বিরাট ব্যতিক্রম। বিশ্বজুড়ে অনেক বিজয়ী দেশের দেখা মিলবে। এবং অনিবার্যভাবে এমন কেউ না কেউ থাকবে , যারা এই বিজয়ীদের কাছ থেকে দুর্দান্ত কিছু শিখতে পারে এবং আরও ভুলত্রুটি করা থেকে নিজদের রক্ষা করতে পারে।
সামাজিক সূচকের উন্নতি এবং দ্রুত ডিজিটালাইজেশনের উন্নয়নের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার পরিবর্তিত অর্থনৈতিক অবস্থাটির দিকে তাকাবে। এর অর্থ এই হতে পারে যে, অনেক বৈশ্বিক শক্তি যারা ঢাকার দিকে আগের থেকে তাদের মনোযোগ আরো বাড়িয়ে দেবে।
ভারতের স্বাধীনতা থেকে এই পরিবর্তনটা প্রত্যাশিত ছিল। বোধগম্য কারণেই সাতচল্লিশের পর থেকে এই অঞ্চলটির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপই ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। এই অঞ্চলটিকে প্রায়ই ভারতীয় উপমহাদেশ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। সম্ভবত এটা ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক ভাবালুতা বা হ্যাংওভার। ব্রিটিশরা বংশ পরম্পরায় ভারতকেই এই অঞ্চলের একমাত্র উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করেছে। অথচ আধুনিককালের পাকিস্তান এবং বাংলাদেশই নয়, বর্মী ভূখন্ড ছিল ঔপনিবেশিক ভারতের অংশ।
তবে এখন পরিস্থিতি বদলেছে। বিশেষত বাংলাদেশে। উপজাতি বা সাম্প্রদায়িক বিভাজনগুলো যা পাকিস্তানকে জর্জরিত এবং ভারতকে ক্রমশ উদ্দীপিত রেখেছে, সেগুলো এড়িয়ে ঢাকা একটি স্থিতিশীল অর্থনীতি এবং সমাজ তৈরি করেছে। এবং এমন একটি কূটনৈতিক কৌশল বজায় রেখেছে, যা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বশক্তিগুলোর ক্রীয়শীলতার মধ্যেই তাকে কৌশলগত অংশীদারিত্ব বজায় রেখে চলার সামর্থ্য দিয়েছে।
অর্থনৈতিকভাবে, মহামারী সম্পর্কিত শূণ্যতার মধ্যে ভারতের মাথাপিছু জিডিপির পতনের মধ্যে বাংলাদেশের একটা আচমকা উত্থান ঘটেছে, এভাবে বর্ণনা করা অন্যায্য হবে। কারণ বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির দেশ। এবং সম্প্রতি সে মধ্যম আয়ের দেশগুলোর ক্লাবে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের বর্তমান লক্ষ্য হলো ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়া।
বাংলাদেশের সমাজ তার অর্থনীতির মতোই প্রায় দ্রুত উন্নতি লাভ করেছে। লিঙ্গগত সাম্য এবং মহিলাদের অধিকার ক্রমশ বিকাশমান। সম্প্রতি ধর্ষণকারীদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান কার্যকর করা হয়েছে। এটা এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, নারী-নেতৃত্বাধীন দেশটি নারীদের প্রতি সহিংসতা সহ্য করবে না, নারী বিরোধী যেমন পদ্ধতিগত সহিংসতা এই অঞ্চলের অন্যান্য বহু অংশে চলমান রয়েছে।
উল্লিখিত অগ্রগতির সবটাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি প্রযুক্তি ও ডিজিটাল রূপান্তর বিভাগ, এটুআইয়ের নেতৃত্বে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ডিজিটালাইজেশন কৌশল দ্বারা পরিচালিত। দেশজুড়ে ডিজিটাল অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি প্রবর্তিত হয়েছে। শপআপের মতো আরও প্রযুক্তিগত স্টার্টআপস আসছে, যা এই সপ্তাহেই শীর্ষস্থানীয় ভেনচার ক্যাপিটাল ফার্ম সিকুইয়া থেকে সাড়ে ২২ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে। নতুন ফ্রি ইকোনমিক অঞ্চল, যেমনটা গত মাসে জাপানের সরকারের সহায়তায় স্থাপন করা (দক্ষিণ এশিয়ায় টোকিওর বৃহত্তম বিনিয়োগ) হলো, তাতে ওই প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত হবে বলেই প্রত্যাশিত।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বাইরেও, দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে ক্ষমতার পুনবিন্যাসের ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সুযোগ তৈরি করেছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু এই অঞ্চলে তার ভূমিকাকে সক্রিয় করার চেষ্টা করছে, বাংলাদেশ তাতে সম্ভবত একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে পারে। বিশেষ করে বেইজিংয়ের সাথে ঢাকার কৌশলগত অংশীদারিত্বের কারণে, সেটা আরো তাৎপূর্ণ বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
একইভাবে মার্কিন যুক্তরাজ্যের জন্যও, লন্ডন সম্ভবত টোকিওর পদক্ষেপ অনুসরণ করবে এবং বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের বিষয়টিকে তারা অগ্রাধিকার দেবে। যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশের মধ্যে একটি নয়া বাণিজ্য চুক্তি ব্রিটেনের ইইউ-পরবর্তী কৌশলের শক্তিশালী সূচনা ঘটাবে। বাংলাদেশের পোশাক খাতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যুক্তরাজ্যের ভোক্তাদের উপর নির্ভরশীল।
রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে এটা দাবি করা রেওয়াজ হয়ে উঠেছে যে, তারা কোভিড–১৯-এর পরে ‘আরও ভাল করে গড়ে তুলব’, স্লোগানটিকে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় করা। এর মাধ্যমে তারা বহু লোকের আশাবাদকে ধরেও রেখেছে। তবে কথা হলো, আমরা যখন বিশ্বকে আরও ভালভাবে পুনর্গঠন করব, তখন আমাদের মনে রাখা উচিত যে, উন্নয়নের পরিকাঠামোগুলো মহামারীর আগে যেমন ছিল, তেমনটা আর সেগুলো অবশ্যই থাকবে না। এই সত্যটা দক্ষিণ এশিয়ার চেয়ে আর কোথাও এতটা বেশি নেই।
আশফাক জামান: ঢাকা ফোরামের পরিচালক এবং সিএনআই নিউজের সহ প্রতিষ্ঠাতা। ২৩ অক্টোবর, ২০২০ দি ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত নিবন্ধের অবিকল তরজমা।