শোয়েব: বড় উৎসবকে টার্গেট করে কয়েক বছর ধরে জাল নোটের কারবার করছে সংঘবদ্ধ চক্র। আবাসিক এলাকার ফ্ল্যাট, দোকান ও গোপন স্থানে কারখানা স্থাপন করে তৈরি করছে জাল টাকা, রুপি ও ডলার। ঈদ, দুর্গাপূজার মতো উৎসবকে সামনে রেখে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাদের সহযোগীদের মাধ্যমে জাল টাকা সরবরাহ এবং বিক্রয় করত তারা। তবে বারবার গ্রেফতার হলেও বেরিয়ে একই পেশায় জড়িয়েছে চক্রের সদস্যরা। তাই জাল টাকা তৈরি, কারবার বন্ধ এবং চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে এবার বিশেষ আইনে মামলার কথা জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সারা দেশে জালনোট তৈরির অন্তত অর্ধশতাধিক চক্র রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে এসব চক্রের সদস্যরা প্রায়ই গ্রেফতার হয়। কিন্তু জামিনে বের হয়ে তারা ফের এসব কাজে জড়িয়ে পড়ে। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ‘উৎসব আসলে টাকার ছড়াছড়ি থাকে। ওই সময়টাই তারা সক্রিয় হয়ে যায়। তারা যেন মাথাচাড়া না দিতে পারে এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়। এ রকম আরো অনেক জাল টাকা কারবারি আছে। তাদের কাউকেই আমরা ছাড়বো না’।
সম্প্রতি ৬০ লাখ জাল টাকা, ১১৩টি জাল ডলার ও জাল টাকা তৈরির সরঞ্জামসহ চক্রের মাস্টারমাইন্ড কাজি মাসুদ পারভেজসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। গতকাল শনিবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিক সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার এ তথ্য জানান। অভিযানে তাদের কাছ থেকে জাল নোট তৈরির সরঞ্জাম হিসেবে একটি ল্যাপটপ, দুটি স্ক্যানার, একটি লেমিনেটর, দুটি প্রিন্টার, ১২টি ট্রেসিং প্লেট, ৫ রিম জাল টাকা ছাপানোর কাগজ জব্দ করা হয়।
এর আগে ঢাকার মগবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে জাল টাকার কারখানার সন্ধান পায় র্যাব-২। এ সময় র্যাব সেখান থেকে কোটি টাকার জালনোটসহ দুইজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা হলো- রিফাত ও পলাশ। অভিযানিক দলের নেতা র্যাব-২ কোম্পানি কমান্ডার মেজর এইচ এম পারভেজ আরেফিন জানিয়েছিলেন, চক্রের সদস্যরা তখন কুরবানির ঈদকে সামনে রেখে পশুর হাটে জালনোট ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। ইতিমধ্যে তারা এক লাখ টাকার বান্ডিল ১৮-২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছে। জালনোট চক্রের সদস্যদের মাঠ পর্যায়ে খুচরা ক্রেতা রয়েছে। তারা খুব সহজেই বাজারে জালনোট ছড়িয়ে দিতে পারে। তারা ৭০ লাখ টাকার সমপরিমাণ জালনোট বাজারে ছেড়েছে। তখন তারা বেশি বেশি করে জালনোট প্রিন্ট করছিল। এর আগে ১৮ই জুলাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগের একটি টিম ঢাকার বংশাল ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৩৫ লাখ টাকার জালনোট, জাল টাকা তৈরির সরঞ্জাম ল্যাপটপ ল্যামেনেটিং, ২টি কালার প্রিন্টারসহ চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার চক্রের সদস্যরা হলো- মো. আলম হোসেন (২৮), মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে লামু (৩২) ও মো. রুবেল (২৮)। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানায়, পশুর হাট, শপিংমল ও অন্যান্য আর্থিক লেনদেনের সময় তারা কৌশলে জাল টাকা ছেড়ে দেয়। পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ১ লাখ টাকার নোট তারা সাত হাজার টাকায় বিক্রি করে। ওই তিনজন ছাড়া চক্রে হাবিব মোল্লা, মুজিবর, জীবন ও রানা নামের আরো চারজন রয়েছে। গোয়েন্দারা এর আগে চারজনকে গ্রেফতার করে কোর্টে পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু তারা জামিনে বের হয়ে ফের এই ব্যবসায় নেমেছে। এছাড়া ৩০ জুন মিরপুর ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার দুটি বাসা থেকে চার কোটি টাকার জাল নোটসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করেছিল র্যাব । এছাড়া ৩০ কোটি টাকার জালনোট তৈরির সরঞ্জাম ও আরো ৪০ লাখ টাকার রুপি উদ্ধার করে। অভিযানের পর র্যাব জানিয়েছিল, এই চক্রটি বিভিন্ন পদ্ধতিতে জাল টাকা তৈরি করে বাজারে ছাড়ছিল। বিশেষ করে ১০০ টাকার নোটকে সেদ্ধ করে তার ওপর ৫০০ টাকার ছাপ বসায়। এই কাজে তারা বিশেষ রং, কাগজ ও প্রিন্টার ব্যবহার করে। তাদের তৈরি ১ হাজার টাকার নোট দেখে সেটি আসল না নকল বোঝা অসম্ভব। র্যাবের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, বড় উৎসবকে সামনে রেখে বাজারে জালনোট ছড়িয়ে যাতে কেউ মানুষকে ঠকাতে না পারে সেজন্য র্যাবের তৎপরতা বাড়ানো হয়। পর পর দুটি বড় অভিযানে ভারতীয় জাল রুপিসহ আমরা দেশি জাল টাকা উদ্ধার করেছি। নজরদারি অব্যাহত আছে।
গতকাল শনিবার ডিবি প্রধান হাফিজ আক্তার সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, চলতি মাসে আমরা তিনটি জাল টাকা তৈরির চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান করেছি। তাদের দেয়া তথ্যমতে গত ২৩ অক্টোবর রাজধানীর কোতোয়ালী, আদাবর থানাসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে ৫৮ লাখ ৭০ হাজার জাল টাকা, ১১৩টি জাল ডলার ও জাল নোট তৈরির সরঞ্জামাদিসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি বলেন, এই পুরো চক্রের মাস্টারমাইন্ড কাজি মাসুদ পারভেজ। মাসুদ পারভেজ ছাড়াও এ চক্রের মোহাম্মদ মামুন, শিমু, রুহুল আলম, সোহেল রানা, নাজমুল হককে গ্রেফতার করা হয়।
তিনি বলেন, এই চক্রের মাস্টারমাইন্ড কাজী মাসুদ পারভেজের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। সে এর আগেও গ্রেফতার হয়েছে। বারবার গ্রেফতার হয়ে বের হয়ে এসেছে। তাই এবার আমরা তার বিরুদ্ধে স্পেশাল অ্যাক্টে মামলা করব। যেন সে সহজে বের হয়ে না আসতে পারে। হাফিজ আক্তার আরও বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা জানায়, তারা ৫-৬ বছর ধরে পরস্পর যোগসাজশে জাল নোট প্রস্তুত করে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করছে। তারা বড় কোনো উৎসব দুর্গাপূজা ইত্যাদি অনুষ্ঠানকে টার্গেট করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাদের সহযোগিতার মাধ্যমে জাল টাকা সরবরাহ করে এবং বিক্রি করে। এক লাখ টাকার জাল নোট তারা ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করে বলে জানান ডিবি কর্মকর্তা হাফিজ আক্তার।
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …