সাজেদুল হক ও শাহনেওয়াজ বাবলু:
এইতো ক’দিন আগের ঘটনা। বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। দেশের ইতিহাসে এক আলোচিত-সমালোচিত রাজনীতিবিদ। সরব হলেন স্বয়ং দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। এমনকি দলীয় প্রধানকে রাজনীতিবিদ হিসেবেও মানতে নারাজ তিনি।
৩০শে ডিসেম্বরের আলোচিত নির্বাচন বিএনপি প্রত্যাখ্যান করে দ্রুতই। দলটির নেতাদের সাফ কথা, জালিয়াতির নির্বাচন অবৈধ, সংসদও অবৈধ। সুতরাং সংসদে যোগ দেয়ার প্রশ্নই আসে না। পরে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে।
বিএনপি’র পাঁচ এমপি শপথ নেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবশ্য সে পথে হাঁটেননি। কে জানে কেন? কৌশল, সমঝোতা নানা নাম দেয়া হয়। কিন্তু দৃশ্যপটে পরিষ্কার চাপে পড়েই বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্ব এমপিদের শপথ মেনে নেয়। গোড়ার কথা, রাতেই যেখানে ভোটের কাজ শেষ হয়ে যায় সেখানে দলটির এক শীর্ষ নেতা সকাল দশটায় বলেন, ভোট ঠিকমতই চলছে। সেও এক অজানা রহস্য।
সংসদ বা স্থানীয় সব নির্বাচনেই একই দৃশ্য। বিএনপি অংশ নেবেই। সংসদীয় আসনের নির্বাচন হলে তো কথাই নেই। পল্টন অথবা গুলশানে রীতিমতো শোডাউন। মারামারিতে জড়াবেন নেতাকর্মীরা। এমনকি দলীয় মহাসচিবের বাসায় ইট-পাটকেল নিক্ষেপের মতো ঘটনাও ঘটে। ঢাকা-৫ আসনের নির্বাচনের মনোনয়ন নিয়ে কি লড়াইটাই না হয়ে গেলো সালাহউদ্দিন আহমেদ ও নবীউল্লাহ নবীর মধ্যে। ভোটের ফলাফলে অবশ্য দু’হাজারের খানিক বেশি ভোট পেয়ে ‘চমক’ দেখান সালাহউদ্দিন। উল্লেখিত আসনের বাসিন্দা না হয়েও সালাহউদ্দিনকে কেন মনোনয়ন দেয়া হলো তা নিয়ে মুখরোচক অনেক গল্পই চালু রয়েছে।
ইতিহাসে দৃষ্টি ফেরানো যাক। জিয়াউর রহমানের আকস্মিক হত্যাকাণ্ড শুরুতেই এ দলের সমাপ্তির প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে। রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের। বিএনপিতে তখন দলাদলি, বিভক্তি আর দলত্যাগের হিড়িক। দলেরই একাংশের আগ্রহে রাজনীতিতে আসেন খালেদা জিয়া। অনেকটা বাধ্য হয়েই। মাঠে নামতে অবশ্য সময় নেননি তিনি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা রাজনীতিতে তার অবস্থান নিশ্চিত করে দেয়। বিএনপিকেও তিনি নিয়ে যান জনগণের দরবারে। দল পরিচালনায় অবশ্য ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। এরশাদের পতনের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি’র বিজয় ছিল বিস্ময়কর। কিন্তু খালেদা জিয়ার প্রথম সরকার দেশ পরিচালনায় সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিল বলে মনে করেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সে সংসদও ছিল বেশ প্রাণবন্ত ও কার্যকর। মাগুরা উপনির্বাচনের কলঙ্ক অবশ্য বিএনপির গায়ে লেগেছিল। একপর্যায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বিরোধী শিবিরে ঐক্য গড়ে ওঠে। ১৫ই ফেব্রুয়ারির গায়েবী ভোট বিএনপি’র পতন ঠেকাতে পারেনি। সহসাই শেরে বাংলানগরে অপারেশন হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আসার পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও বিএনপি তার সাফল্যের ধারা ধরে রাখে। ক্ষমতায় টিকতে না পারলেও একশ’র অধিক আসনে জয়ী হয় দলটি। এবং পুরোটাই বিএনপির একক শক্তি বলে। কারণ জাতীয় পার্টি, জামায়াতের সঙ্গে তখন বিএনপির কোনো ঐক্য ছিল না। একপর্যায়ে রাজনীতির অন্দরমহলে সে পুরনো তত্ত্ব হাজির করেন বিএনপি ও জামায়াত সমর্থক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীরা। বলেন, আওয়ামী লীগ বিরোধী সব ভোট এক বাক্সে নেয়া গেলে আওয়ামী লীগের পক্ষে কিছুতেই জয়লাভ করা সম্ভব হবে না। এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে চারদলীয় জোট। মাঝে অবশ্য ভাঙন দেখা দেয়। এরশাদ এই জোট ত্যাগ করেন। কিন্তু তার দলের একটি অংশ থেকে যায় জোটে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জোট ভূমিধস বিজয় লাভ করে। তখন আন্তর্জাতিক শক্তিরও সমর্থন ছিল এই জোটের প্রতি। কিন্তু ধীরে ধীরে দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। দুর্নীতির অভিযোগ বাড়তে থাকে। তালগোল পাকিয়ে ফেলে সরকার। রাজপথে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলে আওয়ামী লীগ। নানা নাটকীয়তা। পশ্চিমা কূটনীতিক আর তাদের এ অঞ্চলের সমর্থকরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ওয়ান ইলেভেন সব হিসাব পাল্টে দেয়।
অনেক ঘটনাই ঘটে। তবে ওয়ান ইলেভেনের বিপর্যয় থেকে বিএনপি বের হতে পারেনি আর। এরপর অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনের দু’টিতে অংশ নেয় বিএনপি। এর মধ্যে শেষ দু’টি নির্বাচন কেমন ছিল তা সবার কাছেই পরিষ্কার। অংশ নেয়া দু’টি নির্বাচনেই বিএনপি অভাবনীয় পরাজয় বরণ করে। বিশেষ করে ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফল ছিল অকল্পনীয়। তবে এর আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার দণ্ড ও তার কারাভোগই বিএনপি’র নিয়তি পুরোমাত্রায় নির্ধারণ করে দেয়। সরকারি নির্বাহী আদেশে মুক্ত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর এখন সময় কাটছে ফিরোজায়। রাজনীতি থেকে একেবারেই দূরে তিনি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিলাতে থেকে। দলের স্থায়ী কমিটির নেতাদের সঙ্গে প্রায়শই স্কাইপে বৈঠক করেন তিনি।
১৩ সদস্যের এই স্থায়ী কমিটিতে ১০ জনের বয়সই ৭০ এর উর্ধে। দু’জনের বয়স ৮০ পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। তারেক রহমানসহ বাকি তিনজনের বয়স ৭০ এর নিচে। এই স্থায়ী কমিটি বিএনপি’র রাজনীতিতে কি অবদান রাখছে তা নিয়ে অপার রহস্য। ডিজিটাল রাজনীতির কোনো সুবিধাই পাচ্ছে না দলটি।
বিএনপি’র আজকের এ পরিণতি কেন? দলটির ভেতরে-বাইরে নানা বিশ্লেষণ। রাজনীতিতো শেষ পর্যন্ত শক্তির লড়াই-ই। সে লড়াইয়ে বিএনপি ছিটকে পড়েছে এটাই এখন বাস্তব। দলটির হাজার হাজার নেতাকর্মী নানা নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন। গুম-খুনের শিকার হয়েছেন অনেকে। এই সত্য অস্বীকারের জো নেই। পেট্রোলবোমার রাজনীতির দায়ও নিতে হয়েছে দলটিকে। বারবার ভুলের খপ্পরে পড়েছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। ক্ষমতাসীন দলের অলআউট রাজনীতির কোনো কাউন্টার দিতে পারেনি বিএনপি। বিএনপি কখনোই সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগের মতো শক্তিশালী দল ছিল না। আন্দোলনে দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতা পরিষ্কার হয়েছে বারবার। অতীতে রাজপথে জামায়াত-শিবির কর্মীরা কখনো কখনো বিএনপিকে শক্তি জুগিয়েছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের ইস্যু জামায়াতের রাজনীতিকে কার্যত শেষ করে দেয়। আর পরিবর্তিত দুনিয়ায় জামায়াতকে সঙ্গে রাখায় বারবার সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে বিএনপিকে।
মাঠের রাজনীতির বাইরে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো সব সময়ই বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কংগ্রেস জামানায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেছিল বিএনপি। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ না করা সম্পর্কের অগ্রগতিতে হোঁচট খাওয়ার কারণ বলে কেউ কেউ দায়ী করেন। এ ঘটনায় ভারতের প্রয়াত এই রাষ্ট্রপতি বিব্রতবোধ করেছিলেন। কিন্তু ভারতের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশীদের জীবনীগ্রন্থ সাক্ষ্য দিচ্ছে, এর আগেই ভারত তার নীতি ঠিক করে ফেলে। শাহবাগ আন্দোলন কথাটি তিনি ব্যবহার করেননি। তবে বোঝা যায় তিনি সে সময় শাহবাগে মানবতা বিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার কথাই বুঝিয়েছেন। আর সেই প্রেক্ষাপটে ভারত আওয়ামী লীগের প্রতিই সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয়। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বিএনপিতে এক ধরনের উল্লাস দেখা দেয়। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা ভেবেছিলেন, ভারত তার নীতি পরিবর্তন করবে। দলটির কয়েকজন নেতা দফায় দফায় ভারত সফর করেছিলেন। কিন্তু আদতে কোনো লাভই হয়নি। এক সময় আরব বিশ্বের সঙ্গে বিএনপি’র ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্বে আরব দেশগুলোর সঙ্গে বিএনপি এবং বিএনপি জোটের শরিক দলগুলোর সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হয়েছে। পশ্চিমা কূটনীতিকরা আগে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা বলতেন। ইদানীং তারা সে ইস্যু মোটামুটি ত্যাগ করেছেন।
এইতো সেদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ঢাকা সফর করে গেলেন। কিন্তু বিএনপি’র কারও সঙ্গে দেখা হলো না। গত ১২ বছরে এটা ছিল নজিরবিহীন। জনশ্রুতি আছে, একজন অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতা নাকি ই-মেইলে দু’জনের নাম পাঠিয়েছিলেন। সেখানে দলটির মহাসচিবের নাম ছিল না। ভূ-রাজনৈতিক কারণে বিএনপি যে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় বন্ধু হারিয়ে ফেলেছে সেটা বোধকরি নেতারা মূল্যায়নই করতে পারেননি।
আরেক প্রভাবশালী রাষ্ট্র চীনের কাছে গণতন্ত্র কখনো কোনো ইস্যু নয়। দেশীয় ক্ষমতার ভরকেন্দ্রগুলোও এই দীর্ঘ সময়ে বিএনপির প্রতি নমনীয় ভাব প্রকাশ করেনি।
বিএনপি তাহলে এখন কী করবে? ৩০ লাখ মামলা মাথায় নিয়ে ভুলের মূল্যায়ন করবে? দলের সংস্কার আনবে নাকি অন্যের পরাজয়ের দিকে তাকিয়ে নিজের জয় খুঁজবে?
হয়তো পজেটিভ পরিবর্তন আসবে: অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এসএমএ ফায়েজ বলেন, দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা একটা অদ্ভুত পরিস্থিতিতে রয়েছে। অনেক কিছু মিলে এই অবস্থা হয়েছে। কারচুপির ঘটনা ঘটছে এটা সত্য তবে এটা অনেক কিছুকে ঘিরে হয়েছে। এই ভোট যে জনগণের প্রতিফলন এটা বলা যাবে না।
বিএনপি’র রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে আমরা যারা সিনিয়র সিটিজেন আছি সবাইতো গৃহবন্দি। এই করোনাভাইরাস সবকিছুই ওলোট পালট করে দিয়েছে। যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তখন হয়তো রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুতেই পজেটিভ কোনো পরিবর্তন আসবে।
বিএনপিকে তার রাজনীতি স্পষ্ট করতে হবে: ড. মাহবুব উল্লাহ
অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর ড. মাহবুব উল্লাহ অবশ্য বিএনপি’র রাজনীতির বিষয়টিকে দু’টি দিক থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগ প্রায় তিন বছর সময়কাল খুবই বিপর্যকর সময় কাটায়। সে সময় তাদের প্রায় সব নেতাকেই কারাগারে নেয়া হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, এখন বিএনপি’র সমস্যা হচ্ছে- বিএনপি জনগণের কাছে যেতে পারছে না। সভা-সমাবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে না। যে কারণে দলটিকে সেভাবে অ্যাকটিভ মনে হয় না। তারপর বিএনপি’র রাজনীতি নিয়ে নানা রকম বিভ্রান্তিকর প্রচারণা রয়েছে। কখনো বলা হয়, দলটির কোনো কোনো নেতা সমঝেতা করছেন, কখনো প্রচার করা হয় মহাসচিব পদে পরিবর্তন আসবে। এসব প্রচারণার কারণে দলটির তৃণমূলে এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়। তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে বিএনপিকে তাদের রাজনীতি স্পষ্ট করতে হবে ও জনগণের কাছে যাওয়ার যে গণতান্ত্রিক অধিকার তা যেকোন মূল্যে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ দু’টো কাজ করতে না পারলে বিএনপি টিকবে কি না তা বলা মুশকিল। কারণ রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে শূন্যতা থাকে না।
আমি বুঝি না বিএনপি কেন নির্বাচনে যাচ্ছে: অধ্যাপক আসিফ নজরুল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমি বুঝি না এতোকিছুর পরেও বিএনপি কেন নির্বাচনে যাচ্ছে। আর এতে তাদের কি লাভ হচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনেইতো প্রমাণ হয়ে গেছে এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন কখনোই সম্ভব না। বিএনপি নির্বাচনে খুব শোরগোল করে অংশ নেয়। তারপর দুই একদিন ক্যাম্পেইন করে পুলিশের ভয়ে ঘরে ঢুকে যায়। পরে অভিযোগ করে, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। বিএনপি’র নির্বাচনে যাওয়াটা অত্যন্ত কাপুরুষচিত এবং অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত বলে আমার কাছে মনে হয়।
বিএনপি’র নেতৃত্বে সাংঘাতিক দুর্বলতা রয়েছে: প্রফেসর দিলারা চৌধুরী
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া বলতে একটা বিষয় আছে সেটা অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখানে বিএনপি বা বিরোধীদলগুলো কতো ভোট পেল সেটাতো কোনো ম্যাটার করে না। এই দেশেতো কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। সত্যি কথা বলতে কি বাংলাদেশের নির্বাচনের ওপর আমার কোনো বিশ্বাস নেই। আর বিএনপি নির্বাচনে গিয়ে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছে সেটা আমার বোধগম্য নয়।
বিএনপির নেতৃত্বে সাংঘাতিক দুর্বলতা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিএনপি যারা চালাচ্ছে তাদের সম্মিলিত কোনো সিদ্ধান্ত নেই। বেগম জিয়া রাজনীতিতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। ওনার ছেলে লন্ডন থেকে স্কাইপে ডিরেকশন দিচ্ছেন। রাজনীতি এমন একটা বিষয় যে, ঘণ্টায় ঘণ্টায় সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন হয়। তাই এখানে তো একজন একটিভ লিডার থাকার প্রয়োজন রয়েছে। দলটার ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে এটা নিয়ে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। যে দল জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় না, সে দল কি রাজনীতি করবে। আজকে সারা দেশের মানুষের ওপর যে নির্যাতন নিপীড়ন হচ্ছে এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি তো সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। বিএনপি’র ভবিষ্যৎ আমি খুব একটা ভালো দেখছি না।
জনপ্রিয়তা কমেনি, কাঠামোগত দিক থেকে দুর্বল: আবদুল লতিফ মাসুম
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক, বিএনপির রাজনীতি ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তিনটি বিষয় জড়িত। ১. নেতৃত্ব ২. আদর্শ ৩. জনসমর্থন। এটা সত্য জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাবস্থায় বিএনপির জন্ম। পরে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দলটি জনসমর্থন পায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির নেতৃত্বে এক ধরনের দোদুল্যমানতা, শূন্যতা রয়েছে। কিন্তু তারেক রহমান প্রটেনশিয়াল নেতৃত্ব। দুর্বলতা, সবলতা, সমালোচনার বাইরেও তার বড় পরিচয় তিনি জিয়াউর রহমানের সন্তান। এই শক্তিই তার রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে পারে। আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, অসুস্থতাজনিত এবং জেল কোডের কারণে বেগম জিয়া রাজনীতি থেকে দূরে রয়েছেন। বর্তমানে বিএনপি কালেক্টিভ নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। এটি কোনো সংকট নয়। সংকটের দিকটি হচ্ছে সরকার শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সবকিছু পরিচালনা করছে। অন্যদিকে, বিএনপি কাঠামোগত বা সাংগঠনিক দিক থেকে দুর্বল। আদর্শের ক্ষেত্রে বিএনপি সুবিধানজনক অবস্থানে রয়েছে। কট্টর ডান এবং কট্টর বামের মাঝখানে বিএনপি’র অবস্থান। এই মধ্যপন্থী রাজনীতি বিএনপিকে বিপুল সুবিধা দিয়েছে। বিএনপির জনসমর্থনও কমেনি। বরং সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রধান শক্তি হিসেবে মানুষ এখনো বিএনপিকেই বিবেচনা করে। এই পরিস্থিতিতে বলা যায়, বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিঃশেষ হয়ে যাবে না। বিএনপি’র ভারত নীতি প্রসঙ্গে এই অধ্যাপক বলেন, বিএনপি মনে করেছিল নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসলে তাদের সুবিধা হবে। ভারতের সঙ্গে একধরনের সম্পর্ক তৈরিরও চেষ্টা করেছে দলটি। কিন্তু এক্ষেত্রে বিএনপি কৌশলী ছিল না। যে কারণে কখনো কখনো তাদের সুবিধাবাদী মনে হয়েছে।
শেষ কথা: আপাত দৃষ্টিতে বিএনপিতে এক ধরণের ঐক্য রয়েছে। কিন্তু এটা একেবারেই স্পষ্ট এ ঐক্যের অনেকটাই কসমেটিকস। রাজনীতিতে আগামীকাল কি হবে তা অনেক সময় হলফ করে বলা যায় না। কিন্তু ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট গতিপথ আছে। আপাত সে গতিপথ বিএনপি’র জন্য সুখকর নয়। দলটি কি ঘুরে দাঁড়াবে? নাকি এই বিপর্যয় আর কাটিয়ে উঠতে পারবে না। সুনির্দিষ্টভাবে এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারে কেবল সময়ই।https://mzamin.com/