বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি :পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ঘোষণা

ক্রাইমবাতা রিপোট: সুন্দরবন প্রতিনিধি:   চলমান মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে প্রায় সাত মাস বন্ধ থাকার পর আবার খুলছে সুন্দরবন। আসছে নভেম্বর মাসের শুরু থেকেই আবারও সুন্দরবনে যেতে পারবেন ভ্রমণপিপাসুরা।জানা গেছে, দু’এক দিনের মধ্যেই সুন্দরবনে পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ঘোষণা দেবে বন বিভাগ।

তবে এবার সুন্দরবন ভ্রমণে মানতে হবে বেশকিছু স্বাস্থ্যবিধি ও নিয়ম। সম্প্রতি বন ও পরিবেশবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় সুন্দরবনকে পর্যটকদের জন্য খুলে দেয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। রেঞ্জ ও বিভাগীয় পর্যায়ে শিগগির অধিদপ্তর থেকে নির্দেশনা দেয়া হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বন ও পরিবেশ উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার গণমাধ্যমকে বলেছেন, শিগগির সুন্দরবনে পর্যটক প্রবেশের অনুমতি-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে বন বিভাগ। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতির বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। একটি জাহাজে ৫০ জনের বেশি যাওয়া যাবে না। সব স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে ট্যুর অপরারেটর ও পর্যটকদের।

বন বিভাগ জানায়, করোনার সংক্রমণ রোধে ১৯ মার্চ পুরো সুন্দরবনে পর্যটকদের যাতায়াত ও নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার নির্দেশনা ছিল। দু-একদিনের মধ্যেই সুন্দরবন খুলে দেয়ার নির্দেশনা আসতে পারে। বন অধিদপ্তরের নির্দেশনা পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে

 

বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি। নিজস্ব সৌন্দর্য্য নিয়ে গড়ে ওঠা অপরূপ সুন্দরবন পর্যটকদের আকৃষ্ট করে চলেছে বছরের পর বছর ধরে। সুন্দরবনের সৌন্দর্য্য দেখে অভিভূত হচ্ছেন দেশি-বিদেশি পর্যটকরা।

সারা বছর জুড়ে সুন্দরবনে পর্যটকদের আসা-যাওয়া থাকলেও বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের অববাহিকায় গড়ে ওঠা এলাকায় এই মুহুর্তে চলছে পর্যটকদের ভরা মৌসুম।

বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। এ বনে রয়েছে বাঘ মামা খ্যাত দেশের ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগারের’ বাসস্থান।

দিনেদিনে বাড়তে থাকা পর্যটকদের চাপ সামলাতে সুন্দরবনে নতুন করে আরো চারটি ট্যুরিজম সেন্টার করার উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবন কি পরিমাণ পর্যটক ধারণ করতে পারে তা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা হওয়া দরকার।

অন্যান্য দর্শনীয়স্থানগুলোর চেয়ে সুন্দরবন ভ্রমন একটু আলাদা। পর্যটকরা সাধারণত লঞ্চ, স্পীডবোট, ট্রলার ও দেশি নৌকায় করে সুন্দরবন ভ্রমন করে থাকেন। বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা এবং সাতক্ষীরা জেলার নলিয়ান হয়ে নৌ পথে সুন্দরবন ভ্রমণে যান পর্যটকেরা। সুন্দরবনের ভেতরে প্রবেশ করতে হলে দেশি-বিদেশি সব ধরণের পর্যটকদের বন বিভাগ থেকে সরকারের রাজস্ব খাতে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে অনুমতি নিতে হয়।

সুন্দরবনের ইতিহাস: সুন্দরবনের মোট আয়তন ৬০১৭বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে স্থল ভাগের পরিমান চার হাজার ১৪৩ বর্গ কিলোমিটার এবং জল ভাগের পরিমান এক হাজার ৮৭৩ বর্গ কিলোমিটার। অষ্টাদশ শতব্দীতে সুন্দরবনের আয়তন ছিল বর্তমানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন। ১৮৭৮ সালেই সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসাবে ঘোষণা করা হয়। জাতিসংঘের ইউনেস্কো কমিশন ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনের তিনটি অভয়ারণ্যকে বিশ্বঐতিহ্যের অঞ্চল হিসাবে ঘোষণা করে। ২০১৭ সালে সরকার সুন্দরবনের অভয়ারণ্য এলাকা সম্প্রসারণ করেছে। অভয়ারণ্য এলাকা সম্প্রসারণের কারণে সুন্দরবনের মোট আয়াতনের অর্ধেকেরও বেশি এলাকা এখন অভয়ারণ্যভুক্ত। বর্তমানে সুন্দরবনের তিন লাখ ১৭ হাজার ৯৫০ দশমিক ০৮ হেক্টর অভয়ারণ্য এলাকা। সুন্দরবন জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি ইকোসিস্টেম। সুন্দরবনের পুরো এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মনোরম দৃশ্য। অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর উত্তম আবাসস্থল হলো এ বন।

প্রাকৃতিক দূর্যোগের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক দেয়াল হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর দেশের তিন দশমিক ১৪ মিলিয়ন লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। ২০০১ সালে সুন্দরবনের প্রশাসনিক এলাকাকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। পূর্ব বন বিভাগের কার্যালয় বাগেরহাটে ও পশ্চিম বিভাগের কার্যালয় খুলনায় অবস্থিত।

সুন্দরবনের নামকরণ: সুন্দরবনের প্রধান উদ্ভিদ প্রজাতি ‘সুন্দরী গাছ’। কারো কারো মতে সুন্দরী গাছের নাম অনুসারে প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে ওঠা বনের নাম হয়েছে সুন্দরবন। আবার সমুদ্রের কাছে অবস্থান হওয়ায় ‘সমুন্দর’ শব্দ হয়ে প্রথমে ‘সমুন্দরবন’ ও পরে ‘সুন্দরবন’ নামকরণ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

জীববৈচিত্র্য: জীববৈচিত্র্যে ভরপুর সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড রয়েছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।

বনজদ্রব্য: সুন্দরবনের প্রধান বনজদ্রব্য হচ্ছে- সুন্দরী, পশুর, গেওয়া, ধুন্দুল ও কাকড়া গাছ। এছাড়াও সুন্দরবনে গোলপাতা, হেতাল, ছন, মাছ, মধু ইত্যাদি রয়েছে।

বণ্যপ্রাণী: বাংলাদেশের মধ্যে বণ্যপ্রাণির বৃহত্তম আবাসস্থল হল সুন্দরবন। সুন্দরবনে ৩৭৫ প্রজাতির অধিক বণ্যপ্রাণি রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ প্রজাতির সরিসৃপ, ৩১৫ প্রজাতির পাখি ও ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। সুন্দরবনের প্রধান প্রধান বণ্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, বণ্যশুকর, বানর, কুমির, ডলফিন, কচ্ছপ, উদবিড়াল, মেছোবিড়াল ও বন বিড়াল ইত্যাদি। সর্বশেষ জরিপ অনুসারে, বর্তমানে সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ১১৪টি।

নদী-খাল: সুন্দরবন জুড়ে ৪৫০টি ছোট বড় নদী-খাল জালের মতো জড়িয়ে আছে। বনের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা নদীগুলো হল- পশুর, শিবসা, আড়পাঙ্গাসিয়া, শেলা, মরজাত, ভদ্রা, যমুনা, রায়মঙ্গল ও ভোলা।

পর্যটন স্থান: গোটা সুন্দরবন জুড়েই পর্যটকরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য অবলোকন করতে পারেন। তবে, এরমধ্যে করমজল, কটকা, কচিখালী, দুবলারচর, হিরণপয়েন্ট, কলাগাছিয়া, মানিকখালী, আন্দারমানিক ও দোবেকী এলাকায় পর্যাটকরা বেশি ভ্রমণ করে থাকেন।

সুন্দরবনে পর্যটকদের থাকা ও খাওয়ার তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। পর্যটকদের সুন্দরবনে রাত্রিযাপন করতে চাইলে তাদের বহনকারী নৌযানেই ব্যবস্থা করতে হয়। সুন্দরবনের ভেতরে তিন-চারটি বিশ্রামাগার রয়েছে তা মোটেও পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র।

সুন্দরবন ভ্রমণে খরচ: ট্যুর কোম্পানির মাধ্যমে দশ থেকে ১৫ হাজার টাকায় তিনদিন-দুইরাত সুন্দরবন ভ্রমণ করা যায়। ট্যুর কোম্পানির মাধ্যমে যে সব পর্যটকরা সুন্দবন ভ্রমণ করতে চান তারা সাধারণত বাগেরহাট অথবা খুলনায় আসার পর পর্যটক বহরে যুক্ত হন। ভ্রমণকারীদের অনেকে আবার ট্যুর কোম্পানি ছাড়া নিজেরা নৌযান ভাড়া নিয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ করেন।

 

জীববৈচিত্র্যে যাতে ক্ষতি না হয় এজন্য সুন্দরবনের ধারণ ক্ষমতা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা থাকা উচিত জানিয়ে এ অধ্যাপক জানান, গত ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে তার নেতৃত্বে সুন্দরবনের ক্যারিং ক্যাপাসিটি নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে বনের সাতটি স্থানে গবেষণা করা হয়। গবেষণার ওই প্রতিবেদন তারা সুন্দরবন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করেছেন।

 

 

Check Also

সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ডের উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ড (রাজারবাগান ও সরকারপাড়া ইউনিট) এর উদ্যোগে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।