খাদ্য সংকটে সাতক্ষীরার ১১ লক্ষ মানুষ: আশ্বিন-কার্তিকের আকালে নাকাল জেলা বাসি: ৩০ টাকার ওএমএসের চাল কিনতে দীর্ঘ লাইন

আবু সাইদ বিশ্বাস:  ক্রাইমবাতা রিপোট:  সাতক্ষীরা: আশ্বিন-কার্তিকের আকাল, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ও করোনায় সাতক্ষীরায় কৃষক পরিবারে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। আমন ধান এখনো মাঠে থাকায় হাতে কোনো কাজ নেই কৃষকদের। ফলে চরম আর্থিক সংকটে পড়েছেন জেলার নিন্ম আয়ের তিন লক্ষ পরিবারের প্রায় ১১ লক্ষ মানুষ। ৩০ টাকা কেজি প্রতি ওএমএসের চাল কিনতে দীর্ঘ লাইন। সংসার চালানো ও গোখাদ্য সংকটে অনেকে গরু ছাগল বিক্রি করে দিচ্ছে কম দামে। যেখানে জেলার প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষ কৃষি ও মাছ চাষের উপর নির্ভরশীল। সেখানে এক শ্রেণীর মানুষ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হলেও কৃষি শ্রমজীবী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভাগ্যের তেমন কোন পরিবর্তন হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেকার হয়ে পড়া এসব লাক্ষ জনগোষ্ঠীর এখন দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে। খাবার জোগাতে অনেকে আগাম শ্রম বিক্রি করে দিচ্ছেন। ধান রোপণ, ধানকাটা-মাড়াই অথবা ইটভাটায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। কিন্তু বছরের তিনটি মাস (ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক) কোনো কাজ থাকে না। তখন চরম আর্থিক দৈন্যদশার মধ্যে দিনাতিপাত করেন তারা। এ চিত্র প্রতি বছরেরই। সাধারণ কৃষিক পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যেসব ভৃমিহীন কৃষক সারা বছর অন্যের ক্ষেতখামারে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো এখন কিন্তু ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক মাসে কাজ না থাকায় কঠিন অর্থ সংকটে পড়েন তারা।
কৃষি পরিসংখ্যান বলছে কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। এ দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ শতাংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। জিডিপির প্রায় ১৫.৩৩ শতাংশ অর্জিত হয় কৃষি খাত থেকে। কৃষি খাতে চলমান প্রবৃৃদ্ধির হার ৩.৩৫ । দেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান আসে কৃষি খাত থেকে। এ ছাড়াও প্রতি বছর প্রায় দুই মিলিয়ন নতুন মুখের জন্য ৩ লাখ টন অতিরিক্ত খাদ্যের জোগান দিতে হয় এ খাতকে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে ৩৮১৭.৩০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বিশিষ্ট জেলায় ২৩ লক্ষের বেশি মানুষের বসবাস। জেলাতে মোট ৩ লক্ষ ৫৮ হাজার ৫৫০টি কৃষক পরিবার রয়েছে। যাদের ৫ শতাংশের নীতে জমি আছে এমন ভুমিহীন পরিবারের সংখ্যা ৬৭ হাজার ২৩০টি। পান্তিক চাষি পারিবারের সংখ্যা এক লক্ষ ৩১ হাজার ৩৭টি। ক্ষুদ্র চাষী পরিবার রয়েছে এক লক্ষ ৯৫৭টি। এতে ২ লক্ষ ৯৯ হাজার ২২৪টি পারিবারের ১১ লক্ষ মানুষ কৃষির উপর জীবিকা নির্বাহ করে। বছরের বেশির ভাগ সময়ে যাদের ঘরে খাদ্য শস্য থাকে না। কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে খাদ্যের ভূমিকায় তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূণ অবদান রাখে। অথচ বছরের তিনটি মাস (ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক) মাসে তাদের সংসার চলে চরম অভাবে।
বিশ্লেষকরা বলেন রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো সব সময়ে সবার জন্য নিরবচ্ছিন্ন খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা। কিন্তু ক্রমাগত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্য উৎপাদন ও চাহিদার সমন্বয়হীনতার অভাবে ক্রমে প্রকট হয়ে উঠছে খাদ্য সংকট। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আবাদযোগ্য জমি কমার কারণে গত ১০ বছরে জমির পরিমাণ ও উৎপাদন ২০ থেকে ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। কৃষি খাতকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ১৫.১৮ মিলিয়ন (বিবিএস, কৃষি শুমারি ২০০৮) কৃষি পরিবারের (যাদের মধ্যে ৮৪.৩৮ শতাংশ পরিবারে জমির পরিমাণ সর্বোচ্চ ১ হেক্টর) জীবিকা অর্জনে কখনও কখনও অসম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
জেলাতে কর্মসংস্থানের জন্য বিপুলসংখ্যক গরিব ও ভূমিহীন পরিবারের কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে পরিস্থিতির জটিলতা আরও বেড়েছে। এ ছাড়াও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ যেমন- কৃষি জমির শিল্প দূষণ, কৃষি জমি অকৃষিতে রূপান্তওে কারণে টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ উন্নয়ন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ছে এবং জেলাতে অভিবাসন হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কৃষি পারিসখ্যান সূত্র মতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে বছরে প্রায় ৮২ হাজার হেক্টর আবাদি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে জনসংখ্যার ৪০% দরিদ্র। এর মধ্যে ২০% অতিদরিদ্র। উপকূল ও চরাঞ্চলে ৮৮% দরিদ্র্র এবং ৪৪% অতিদরিদ্র এবং ৫% জনগোষ্ঠীর অরক্ষিত বসতি রয়েছে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ করছে।
তালা উপজেলার খলিষখালি ইউনিয়নের মঙ্গলানন্দকাটি গ্রামের আব্দুস সামাদ বিশ্বাস, বলেন এ সময়টা তার হাতে কোনো কাজ নেই। ঘরে খাদ্য ও নেই। সবদিন ক্ষেতে পারছি না। এক মুঠো ভাতের জোগাড় হলেও তরি তরকারি জোগাড় করতে পারছি না। সরকার একটা চাউলের কার্ড দিয়ে ছিল। সেই চাউল তুলে কোন রকমে খাচ্ছি। সেই কাডের মেয়াদও শেষ পর্যায়ে। কার্ডে চাল দেয়া বন্ধ করে দিলে সংসারের ৪ জন কিভাবে চলবো বুঝতে পারছি না।
একই এলাকার ছখিনা ও জানান, বছরের অন্য সময় দিনমজুরি ২৫০-৩৫০ টাকা হলেও জীবন বাঁচাতে এ সময় ১০০-১৫০ টাকায় আগাম শ্রম বিক্রি করতে হচ্ছে। অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিকে ধান কাটা-মাড়াই শুরু হবে, ইটভাটার কাজও পাওয়া যাবে। তখন আর সমস্যা হবে না।
সাতক্ষীরা শহরের ইটাগাছা বিল অঞ্চলের আমিরন জানান, ঘরে খাবার নেই। কাজ কামও নেই। কি করবো। ঋধ দায়েক করে কোন রকমে চলছি। ৩০ টাকা দরে চাল কিনতে দীর্ঘ লাইন দিতে হচ্ছে। খুব ভোরে আসি আর ১১টার দিকে ৫ কেজি চাল নিয়ে বাড়ি যায়। সেই চাল রান্না বান্না করে ছেলে মেয়ে নিয়ে খাই। কাজ থাকলে এভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে চাল তুলতাম না।

সাতক্ষীরা জেলা কৃষি উপপরিচালক নূরুল ইসলণাম জানান, জেলাতে পর্যাপ্ত খাদ্য শস্য উৎপাদন হয়। যে সব জেলাতে ধান কম হয় সেইসব জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এখান থেকে ধান কিনে নিয়ে যায়। তবে কয়েক দিনের মধ্যে এ জেলাতে পুরাদমে আমন ধান কাটা শুরু হবে। তখন আর অভাব থাকবে না। এমনকি তখন শ্রমিক সংকটে জেলাতে ধান তুলা কঠিন হয়ে যাবে।

Check Also

সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ডের উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ড (রাজারবাগান ও সরকারপাড়া ইউনিট) এর উদ্যোগে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।