আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা: দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল সাতক্ষীরা-যশোর-খুলনা জেলার ৬০ লাখ মানুষ জলাবদ্ধতার কবলে। অপরিকল্পিত চিংড়ী চাষ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ভ্রান্তনীতি, দুর্নীতি লুটপাট ও ভারতের একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণের কারণে জলাবদ্ধতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে এসব অঞ্চলের মানুষ মহাবিপর্যয়ের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। জলাবদ্ধতা মানুষের নিত্যসঙ্গী। এই জনপদকে কেন্দ্র করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঠিকাদারসহ একটি স্বার্থবাদী চক্রের অবৈধ অর্থ উপার্জনের লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। ক্রুগ মিশনের পরামর্শে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পাকিস্তানী আমলের পানি নীতি বাংলাদেশ আমলেও অব্যাহত রাখা হয়েছে। যে নীতি এ অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ঠ, নদী পানি ব্যবস্থাপনা, জীব বৈচিত্র ও জীবন যাত্রা প্রনালী বিপর্যস্ত করে স্থায়ী সংকট সৃষ্টি করে।
সাতক্ষীরার বেতনা ও মরিচ্চাপ নদী এবং যশোরের ভবদহ অঞ্চলে জলাবদ্ধতা দিনদিন প্রকট হচ্ছে। বছরের ৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে সাতক্ষীরা জেলার বেশিরভাগ এলাকা পানি নীচে থাকে। বেতনা নদী কোনরকমে টিকে রয়েছে। অপরদিকে মরিচ্চাপ নদী মৃত্যুর প্রহর গুনছে। এছাড়া গোয়ালঘেশিয়া নদীর অকাল মৃত্যুু ঘটেছে এবং খোলপেটুয়া নদীও পড়েছে মৃত্যুর মুখে। এরই মধ্যে বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীর মৃত্যু এবং জনদুর্ভোগ কমাতে সরকার ৪ বছর মেয়াদি ৪৭৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা ও যশোরের ভবদহ নদী খননে ৮শ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সাতক্ষীরা সদর, কলারোয়া, দেবহাটা, আশাশুনি ও তালা উপজেলার ১৫ লাখ মানুষ জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে বলে প্রত্যাশা করা হলেও প্রকল্প গ্রহণে আইডব্লিউএম’র সুপারিশ উপেক্ষা করে টিআরএম বাদ দেওয়া হয়েছে। এতে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও জলাবদ্ধতা তেমন হ্রাস পাবে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট- টিআরএম) পদ্ধতি সংযুক্ত করে বেতনা-মরিচ্চাপসহ সকল সংযোগ খাল পূণঃখনন ও দক্ষিণ-পশ্চিম উপকুলীয় অঞ্চলের স্থায়ী জলাবদ্ধতা নিরসনের দাবিতে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন ও প্রধানমন্ত্রি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। রোববার বেলা ১১টায় সাতক্ষীরা কালেক্টরেট চত্বরে উক্ত মানববন্ধন কর্মসুচি পালিত হয়। সাতক্ষীরা-১ আসনের সংসদ সদস্য এড. মোস্তফা লুৎফুল্লাহ উক্ত মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন। মানববন্ধনে বক্তারা সরকার গ্রহীত প্রকল্পে জলাবদ্ধতা নিসরনে টিআরএম অন্তর্ভুক্ত করা ও ইছামতি নদীর সঙ্গে লাবণ্যবর্তী ও সাপমারা নদীর পুনঃসংযোগ প্রদানের দাবী জানান।
পরে তারা সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামালের মাধ্যমে ৭ দফা দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও পানি সম্পদ মন্ত্রী বরবার পৃথক দু’টি স্মারকলিপি পেশ করেন। স্মারকলিপিতে দাবী জানানো হয়, বেতনা মরিচ্চাপ অববাহিকায় নদীবাহিত অবক্ষেপনের জন্য বিল চিহ্নিত করে টিআরএম পদ্ধতি অন্তর্ভূক্তিকরা। নদী ও খালের সকল ইজারা বাতিল, অবৈধ দখল ও স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। পানি নিস্কাশনের উপযোগী করে নদীসহ সকল সংযোগ খাল পুন:খনন ও স্লুইস গেইট সংস্কার করতে হবে। উপকূলীয় এলাকা বিশেষ করে শ্যামনগর, আশাশুনি ও দেবহাটা উপজেলা স্থায়ী এবং টেকসই বেঁড়ীবাধ নির্মাণ করতে হবে। নদী, খাল খনন ও জলাবদ্ধতা নিরসনে জনগনের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আবদ্ধ শালিখা নদী উন্মুক্ত করে বেতনার সাথে সংযোগ, পাকুড়িয়া নদীকে কপোতাক্ষ ও বেতনার সাথে সংযোগ, আমতলী নদীর সাথে শালতা নদীর সাথে সংযোগ প্রদান করতে হবে। কোমরপুর শাখরা স্লুইসগেটের পাশে উকূলীয় বাঁধ কেটে লাবণ্যবতী এবং ভাতশাল স্লুইসগেটের পাশ দিয়ে সাপমারা নদীর সাথে ইছামতি নদীর সরাসরি সংযোগ প্রদান করা হলে মরিচ্চাপ, শালখালি, হাবড়া, গুতিয়াখালী প্রভৃতি নদী সজীব হয়ে উঠবে এবং খোলপেটুয়া নদীর নাব্যতার কোন সংকট হবে না। অবিলম্বে তিস্তাা নদী মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন চাই ও আন্ত:নদী সংযোগ স্থাপনের দাবী জানানো হয়।
এদিকে যশোরের ভবদহ অঞ্চলের স্থায়ী জলাবদ্ধতা নিরসনে টিআরএম পদ্ধতি বাস্তবায়ন না করে লাখ লাখ মানুষকে জিম্মি করে এবং তাদের দুর্দশাকে পূঁজি করে লুটপাট চালাতে ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। যে প্রকল্পে বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় জনমতকে উপেক্ষা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড লুটেরাদের দুর্গে পরিণত হয়েছে। তারা নদী কেটে খাল বানায়, খাল কেটে নালা বানায়। ইতোপূর্বে তারা সাতক্ষীরার বেতনা ও মরিচ্চাপ নদী খনন করে খাল তৈরি করেছে। একইভাবে নতুন করে গৃহীত প্রকল্পে আইডব্লিউএম টিআরএম অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করলেও তা বাদ দেওয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিনামদর্শিতায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সরকারের প্রত্যাশা পূরণ হবে না। উল্টো পানিতে যাবে ৪৭৫ কোটি টাকা।
‘টিআরএম’ প্রকল্পের দাবি জানিয়ে সাতক্ষীরা ও যশোরর ভবদহবাসী প্রধান মন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। স্মারকলিপিতে দাবী জানানো হয়, ভারী বৃষ্টিপাত হলেই ভবদহ এলাকার প্রায় ২০০টি গ্রাম তলিয়ে যাবে। ক্ষতিগ্রস্থ হবে ১০ লাখ মানুষ। কেশবপুর, মণিরামপুর, অভয়নগর উপজেলা শুধু নয় সদর উপজেলা ও শহরের এক অংশ এবং সেনানিবাস পর্যন্ত জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। ইতিমধ্যে বিল বোকর, কেদারিয়া, কপালিয়াসহ অন্য বিলগুলোতে পানি থই থই করছে। ডুমুরতলা, সুজাতপুর, ডহর মশিয়াহাটি, হাটগাছা, নেবুগাতি,বেদভিটা, বলারাবাদসহ অনেক গ্রামের বাড়িতে পানি উঠেছে। এ সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। অপরদিকে নদী শুকিয়ে গেছে। ভবদহ স্লুইসগেট থেকে বারো আউড়িয়া মোহনা পর্যন্ত ৫০-৬০ কিলোমিটার বিপদজনকভাবে ভরাট হয়ে গেছে। সরকার, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বারবার অবহিত এবং বিক্ষোভ করেও কাজ হয়নি। স্মারকলিপিতে ৮০৮ কোটি টাকার গণস্বার্থ বিরোধী প্রকল্প বাতিল করে ২০১৭ সালের গৃহীত বিল কপালিয়াসহ অপরাপর বিলে টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়।
যশোর সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক রণজিৎ বাওয়ালী, মাঘী পূর্ণিমার আগেই বিল কপালিয়ায় টিআরএমের গৃহীত সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়ন, এলাকার সকল নদী-খাল পুনরুদ্ধার ও অবমুক্ত, জলাবদ্ধতা নিরসনে সংস্কার কাজে দুর্নীতির বিচার, ভবদহ স্লুইসগেটের ২১ ও ৯ ভেন্টের মাঝ দিয়ে সরাসরি নদী সংযোগ দেয়ার দাবী জানান সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে।