ভারতীয় পত্রিকার প্রতিবেদন : ‘উইপোকা’ বাংলাদেশ অর্থনীতিতে টপকাচ্ছে ‘হস্তি’ ভারতকে!

বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা, যেখানে উঠে এসেছে বাংলাদেশের ভারতকে টপকিয়ে যাওয়ার বিষয়টি। সেখানে বাংলাদেশকে ‘উইপোকা’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে আর ভারতকে দেখানো হয়েছে ‘হস্তি’ হিসেবে। প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞ মতামত হিসেবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের এ অগ্রগতি ক্ষণস্থায়ী।

মঙ্গলবার প্রকাশিত সমর বিশ্বাসের প্রতিবেদনটি এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো :

১৯৮৩ এবং ১৯৯৬ ক্রিকেট বিশ্বকাপের মধ্যে এক অদ্ভুত মিল। এমন দু’টি দেশ (ভারত আর শ্রীলঙ্কা) ওই দু’বছরে বিশ্বকাপ জিতেছিল, যারা বিশ্বকাপ জিতবে বলে অতি কল্পনাপ্রবণ ক্রিকেটভক্ত বা ক্রিকেট বিশারদরাও ভাবেননি।

কপিলদেব, অর্জুন রণতুঙ্গা বা তাঁদের সতীর্থরাও কি ভেবেছিলেন? নাহ্।

সম্প্রতি প্রায় তেমনই ঘটনা ঘটেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের ভবিষ্যদ্বাণী, চলতি আর্থিক বছরে পার ক্যাপিটা জিডিপি বা মাথাপিছু উৎপাদনে ভারতকে ছাপিয়ে যাবে বাংলাদেশ! সেই বাংলাদেশ, যাকে ১৯৭১ সালে পাক-শাসনমুক্ত করে স্বাধীনতা উপহার দিয়েছিল ভারত। সেই বাংলাদেশ, যার আয়তন পশ্চিমবঙ্গের দেড়গুণের মতো, রাজস্থানের অর্ধেকেরও কম। যে দেশে শিল্প বলতে পোশাক, পুঁজি বলতে কমদামী শ্রমিক।

এমন ‘উইপোকা’ই কি না টপকে যাবে ভারত নামক ‘হস্তি’কে? ৫৬ ইঞ্চির ছাতিকে হারিয়ে দিতে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা? চাণক্যের পরাজয় হতে চলেছে ‘লেডি অব ঢাকা’র কাছে?

তেমন সম্ভাবনা জেগে উঠতেই মোদী সরকারের দিকে ধেয়ে আসছে বিরোধীদের ব্যঙ্গবিদ্রুপ। রাহুল গাঁধী যেমন বলেছেন, গত ৬ বছরে মোদী সরকারের থেকে এটাই বড় পাওনা যে, মাথাপিছু জিডিপি-তে বাংলাদেশও ভারতকে ছাপিয়ে যাচ্ছে! অসমে এনআরসি প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর অমিত শাহ বাংলাদেশিদের উইপোকার সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, ‘‘উইপোকার মতো বাংলাদেশিরা ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে এবং দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করেছে।’’ যা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ জানিয়েছিল ঢাকা।

আইএমএফের পূর্বাভাসের পর শাহের সেই ‘উইপোকা’ তত্ত্ব নতুন করে সামনে এসেছে। অনেকেই বলছেন, সেই ‘উইপোকা’ই এ বার হাতিকে টপকে যাচ্ছে।

অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অনেকটা নীতিকথার সেই কচ্ছপ আর খরগোশের গল্পের মতো— ‘স্লো বাট স্টেডি…’। ধীরগতি হলেও জিডিপি বৃদ্ধিতে ভারতের চেয়ে অনেক বেশি স্থিতাবস্থা রয়েছে বাংলাদেশে। ২০১৬ সাল থেকে শেখ হাসিনার সরকার জিডিপি বৃদ্ধির হার টানা ৭ শতাংশের উপরে ধরে রেখেছে। আইএমএফের পূর্বাভাস, চলতি অর্থবর্ষে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি-র ঋণাত্মক বৃদ্ধি হবে বা সঙ্কোচন হবে প্রায় ১০ শতাংশ। মাথাপিছু উৎপাদন কমে দাঁড়াবে ১ হাজার ৮৭৭ আমেরিকান ডলার। কিন্তু কোভিড সংক্রমণের মধ্যেও বাংলাদেশের পার ক্যাপিটা জিডিপি ৪ শতাংশ বাড়বে। তারা পৌঁছে যাবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলারে। ভারতের চেয়ে ১১ ডলার বেশি। অথচ মাত্র পাঁচ বছর আগেও ভারতীয়দের মাথাপিছু আয় ছিল বাংলাদেশিদের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি!

বাংলাদেশের এই অগ্রগতি অবশ্যই প্রশ‌ংসনীয়। কিন্তু ভারতকে টপকে যাওয়ার পূর্বাভাসকে এখনই খুব গুরুত্ব দিতে নারাজ অর্থনীতিবিদদের একাংশ। তাঁদের মতে, আপাতদৃষ্টিতে পরিসংখ্যানের দিক থেকে এই দাবি সত্যি হলেও তার মধ্যে অনেকগুলি ‘ফ্যাক্টর’ কাজ করে। অর্থনীতিবিদ দীপঙ্কর দাশগুপ্তের কথায়, ‘‘দু’দেশের মধ্যে কোনও তুলনাই হয় না। দ্রব্যমূল্যের মান, মূল্যসূচক, অর্থনীতির আয়তন— এ সব অনেক ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে পার ক্যাপিটা জিডিপি। মাথাপিছু উৎপাদন বেশি হলেও জীবনধারণের সামগ্রিক ব্যয়, ডলারের সাপেক্ষে মুদ্রার দাম ইত্যাদির সঙ্গে তুলনা করে তবেই প্রকৃত উন্নয়নের বিষয়ে বলা যায়। আবার ‘পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি’ বা ক্রয়ক্ষমতা, সঞ্চয়ের হার— এ সব মাপকাঠিও আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিচার্য।’’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘১০০ টাকায় ৪০ টাকা বৃদ্ধি আর ১০০০ টাকায় ৪০০ টাকা বৃদ্ধি শতকরা হিসেবে এক হলেও মোট বৃদ্ধির ফারাকটা কিন্তু ৪০ টাকা আর ৪০০ টাকা। সেটা মাথায় রাখতে হবে।’’ তবে বাংলাদেশ যে পোশাক শিল্প, পরিকাঠামো এবং স্বাস্থ্যের মতো ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি করেছে, তা খোলাখুলিই জানিয়েছেন তিনি। জানিয়েছেন, প্রতিবেশী দেশের এই উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধিতে তিনি খুশি।

খুশির বাতাবরণ বাংলাদেশের শিল্পমহলে। শেখ হাসিনার দেশের অর্থনীতির ভিত ক্রমশ মজবুত হওয়ার পিছনে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের বড় অংশ অনেকগুলি যুক্তি দিচ্ছেন। প্রথমত, দেশে অফুরন্ত শ্রমিকের ভাণ্ডার। যাঁদের গড় মজুরি ভারতের চেয়ে অনেক কম। আমেরিকা যে কারণে ভারত থেকে কর্মী নিয়োগ করে, সেই একই কারণে শিল্পপতিদের বিনিয়োগের অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। ঢাকার এক অর্থনীতি বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বলেন, ‘‘কম মজুরিতে কাজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কখনও কেউ হারাতে পারবে না। সস্তায় শ্রমিক রফতানিতে সারা বিশ্বে প্রথম আমরাই। যে কাজই হোক, বাংলাদেশিরা সেটা ভারতীয় শ্রমিকদের চেয়ে কম মজুরিতে করে দেবে।’’

অর্থনীতিবিদ সুমন মুখোপাধ্যায় আবার ভারত-বাংলাদেশের এই তুলাতেই যেতে রাজি নন। তাঁর কথায়, ‘‘নোবেলজয়ী আমেরিকান অর্থনীতিবিদ সাইমন কুজনেৎস জিপিকে অর্থনীতির বৃদ্ধি পরিমাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর কথা ধরে নিয়েও বলা যায়, সামগ্রিক আর্থিক বৃদ্ধির হিসেব করতে গেলে পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি) বা ক্রয়ক্ষমতা, হ্যাপিনেস ইনডেক্স, মূল্যসূচক, বিভিন্ন ক্ষেত্রের বৃদ্ধি, আমদানি-রফতানির মতো অনেকগুলি বিষয় হিসেবে রাখতে হয়। সে সব দিক দিয়ে দেখতে গেলে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে ঠিকই। ওদের হ্যাপিনেস ইনডেক্স ভারতের ৩০ শতাংশ উপরে। সাক্ষরতার হার বেড়েছে। মহিলাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা ভারতের চেয়ে অনেক বেশি। হিউম্যান ডেভলপমেন্ট ইনডেক্স বা মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে কয়েক বছর আগে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে মাত্র ২ ধাপ উপরে ছিল। এখন হয়তো সেই ব্যবধন আরও কমেছে।’’

কোনও দেশের মোট জিডিপি বৃদ্ধিকে সেই দেশের জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যায় পার ক্যাপিটা জিডিপি বা মাথাপিছু উৎপাদন। সুমনের মতে, ‘‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। আবার গত ৫ বছর তারা জিডিপি বৃদ্ধিও ৬ থেকে ৮ শতাংশের মতো স্থিতিশীল জায়গায় ধরে রাখতে পেরেছে। স্বাভাবিক ভাবেই পার ক্যাপিটা জিডিপি বেড়েছে। তা ছাড়া, বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক বেশি রফতানিমুখী। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি স্বনির্ভরতাকেন্দ্রিক।’’

বড় শিল্প বা বিদেশি বিনিয়োগের অন্যতম শর্ত ‘রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা’। ২০০৮ সাল থেকে ১২ বছরেরও বেশি সময় টানা প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে হাসিনা। বিরোধীরা প্রায় ছন্নছাড়া। মৌলবাদী দলগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়েও ঘুরে দাঁড়াতে কার্যত ব্যর্থই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। অন্য দিকে, বহু জনমুখী প্রকল্প, পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক বরাদ্দ, গরিবদের জন্য নানা আয়মুখী প্রকল্প, মহিলাদের স্বনির্ভর করতে আর্থিক সাহায্য ইত্যাদির হাত ধরে উত্তরোত্তর জনভিত্তি বাড়িয়ে শক্তিশালী হয়েছে হাসিনার সরকার এবং তাঁর দল আওয়ামী লিগ।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে রেডিমেড পোশাক শিল্প থেকে। হাসিনার জমানায় সেই শিল্পকে ধরে রাখা এবং নানা সুযোগসুবিধা দিয়ে তার বৃদ্ধির পথ আরও প্রশস্ত করা হয়েছে। তার সঙ্গেই বেড়েছে অন্যান্য শিল্পও। শিল্পের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে গড়া হয়েছে শিল্পতালুক। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় চট্টগ্রামের অদূরের মিরসরাই। সরকারি ভাবে যার নাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরী’। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে পণ্য রফতানির সুবিধা, শিল্পদ্যোগীদের নানা সুবিধা, কম দামে পর্যাপ্ত শ্রমিকের জোগান, জল, বিদ্যুৎ, কয়লার মতো কাঁচামালের সহজলভ্যতা, উন্নত যোগাযোগের মতো শিল্পের সহায়ক পরিবেশ থাকায় ভারত, চিন, জাপানের মতো দেশের শিল্পপতিদের অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠেছে হাজার একর জমিতে গড়ে-ওঠা মিরসরাই শিল্পনগরী। সেখানে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে কারখানা তৈরি করছে এশিয়ান পেন্টস। দ্বিতীয় কারখানা তৈরি করছে বার্জার পেন্টস। শুধু ভারতীয় শিল্পের কারখানার জন্যই সেখানে ১ হাজার একর জমি নির্দিষ্ট করে ‘ইন্ডিয়া স্পেশাল ইকনমিক জোন’ তৈরির কাজ করছে আদানি পোর্ট। সাপুরজি পালনজি, রিলায্যান্স অনিল অম্বানী গ্রুপ বাংলাদেশে তৈরি করছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর সঙ্গে চিন, জাপান, কোরিয়ার মতো দেশের বিনিয়োগ তো রয়েছেই। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ জুড়ে আরও ১০০টি শিল্পতালুক তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে হাসিনা সরকার।

উল্টোদিকে, ভারতের আর্থিক বৃদ্ধিতে ‘অস্থিরতা’ বেশি। অনেকের মতে, তার অন্যতম কারণ দেশের অর্থনীতি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রসারিত। বিশ্বের কোনও প্রান্তে অস্থিরতা তৈরি হলে তার প্রভাব পড়ে ভারতের আমদানি বাণিজ্যেও। করোনাভাইরাসের কারণে রফতানি এবং আমেরিকার অভ্যন্তরীণ শিল্প-সঙ্ঘাত যেমন ফেলেছে। আবার ভারতের অর্থনীতিতে অস্থিরতার জন্যও সামগ্রিক ভাবে ক্ষতি হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের একাংশ মনে করেন, মোদী সরকারের নোটবন্দি এবং জিএসটচি চালু করার সিদ্ধান্তে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে। ঢাকার একটি আর্থিক নীতিনির্ধারণ এবং গবেষণা সংক্রান্ত সংস্থার কর্ণধার আহসান এইচ মনসুরের কথায়, ‘‘আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ভাল। ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র অর্থনীতির ক্ষেত্র স্থিতিশীল। ভারত সেক্ষেত্রে অনেক ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। মোদী সরকারের নোট বাতিল এবং জিএসটির দুই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদরাও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন।’’

সারা বিশ্বে বিদেশি বিনিয়োগে অগ্রগণ্য চিন। অথচ, নয়াদিল্লি-বেজিং সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। গালওয়ান-পরবর্তী অধ্যায়ে তা আরও তিক্ত হয়েছে। থমকে গিয়েছে পাইপলাইনে-থাকা বহু চিনা বিনিয়োগ। আর চিরবৈরিতার কারণে গালওয়ানের মতো পরিস্থিতি হোক বা না হোক, চিনা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতকে সব সময়ই অনেক মেপে পা ফেলতে হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সে সব ছুঁৎমার্গ বা বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে বাংলাদেশে ঢালাও বিনিয়োগ করছেন চিনা শিল্পপতিরা। জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ডের বিনিয়োগকারীরা তো রয়েছেনই। এ ছাড়া, ভারতের মতো জমি আন্দোলন বাংলাদেশে জোরালো না হওয়ায় জমির দাম তথা ক্ষতিপূরণও আকাশছোঁয়া নয়। দালাল বা ফড়েদের তেমন দাপট নেই। ভারতের তুলনায় পেট্রল, ডিজেল ও অন্যান্য জ্বালানির দামও কম। নদীমাতৃক বাংলাদেশে জলের অভাব নেই। পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত আইনও ভারতের মতো এতটা কড়া নয়।

সাম্প্রতিক করোনাকালের পরিস্থিতিও ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে ভাল। কোভিড সংক্রমণ অতটা তীব্র নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গত জুন মাসেই বাংলাদেশ সংক্রমণের শিখর পেরিয়ে গিয়েছে। সেখানে ভারত অক্টোবরের মাঝামাঝি সর্বোচ্চ সিখর বেরিয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একসঙ্গে এই দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি পরিস্থিতিগুলি এক হওয়ার ফলেই পার ক্যাপিটা জিডিপিতে অন্তত চলতি আর্থিক বছরে বাংলাদেশের ভারতের চেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সম্ভাবনা।

কিন্তু পরিস্থিতি কি সত্যিই ভারতের জন্য এতটা দুশ্চিন্তার বা বাংলাদেশের জন্য বিরাট অগ্রগতির ইঙ্গিত?

বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদদের একাংশ একে বিশেষ গুরুত্ব দিতে রাজি নন। বিশ্বব্যাঙ্কের অন্যতম প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হুসেনের বক্তব্য, ‘‘আমি লোকজনকে বলেছি যে, এত উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করবেন না। ভারত আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সঙ্গে প্রসারিত হওয়ায় কোভিডের ধাক্কা বেশি হয়েছে বটে। কিন্তু মনে রাখবেন, বাংলাদেশের মোট রফতানির ৮৪ শতাংশই কিন্তু আসে একটা শিল্প থেকে— রেডিমেড পোশাক। যা অর্থনীতির দিক থেকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এই শিল্পে কিছু সমস্যা হলেই কিন্তু গোটা দেশের অর্থনীতি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে।’’ তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, শিক্ষায় বাংলাদেশ এখনও ভারতের চেয়ে বহু যোজন পিছিয়ে। স্কুল-কলেজ শিক্ষায় বিপুল রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। উচ্চশিক্ষায় আইআইটি বা আইআইএমের মতো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই বাংলাদেশে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। যে কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ভারতে, বিশেষত কলকাতায় চিকিৎসা করাতে যান লক্ষ লক্ষ মানুষ।

বাংলাদেশের অগ্রগতিকে স্বীকৃতি দিয়েও আইএমএএফের পূর্বাভাসকে গুরুত্ব দিতে চান না সুমন মুখোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আইএমএফ আর্থিক বৃদ্ধি হিসেব করে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারের পরিসংখ্যানের উপর। বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক বেশি রফতানিমুখী। কিন্তু আমাদের দেশের অর্থনীতি স্বনির্ভরকেন্দ্রিক। তাই সুবিধা হয়েছে বাংলাদেশের। তা ছাড়া, আইএমফ নিজে কোনও সমীক্ষা করে না। সরকার যে তথ্য দেয়, সেটাই বিশ্লেষণ করে পূর্বাভাস দেয়। মুশকিল হল, ভারতীয় অর্থনীতির ভিত অনেকটা মজবুত করেছে অসংগঠিত ক্ষেত্র। সেই বিরাট অংশের অবদানের হিসেব কিন্তু সরকারের কাছে নেই। সেই অংশ জুড়লে কিন্তু বোঝা যাবে, ভারতের অর্থনীতি অনেক মজবুত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে। তা ছাড়া পরিকাঠামো খাতে বিপুল বিনিয়োগ ও উন্নয়ন হয়েছে ভারতে। তার সুফল মিলতে দু’-তিন বছর সময় লাগবে। বিশ্বব্যাঙ্ক এই পরিকাঠামো উন্নয়নের পরিসংখ্যান থেকে জিডিপি বৃদ্ধির হার নির্ধারণ করে। তাই অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। সেই বিশ্বব্যাঙ্ক কিন্তু মনে করছে, ২০২১ অর্থবর্ষে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি ১০ শতাংশেরও বেশি হতে পারে।’’

বাংলাদেশের অগ্রগতিকে কোনও ভাবেই খাটো করতে রাজি নন সুমন। তবে কোভিড পরিস্থিতি কেটে গেলে দ্রুত পট পরিবর্তন হবে বলে মনে করেন তিনি। আবার জাহিদ হুসেনের মতো বাংলাদেশের অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, কোভিডের জন্য একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বটে। কিন্তু সেটা দীর্ঘস্থায়ী নয়। পার ক্যাপিটা জিডিপি-র এই ছবি পাল্টাতে খুব বেশি সময় লাগবে না। অর্থাৎ, হাতি এবং উইপোকা থাকবে তাদের নিজের নিজের জায়গাতেই।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।