ইতিহাস বাইডেনের ট্রাম্পকে হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত

টানটান উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন জো বাইডেন। ভোট গ্রহণের চার দিন পর গতকাল শনিবার পেনসিলভানিয়ার ২০ ইলেক্টোরাল ভোট পাওয়ায় জয় নিশ্চিত হলো তার।

জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ২৭০ ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের চেয়ে ২০ ভোট বেশি পেয়েছেন বাইডেন। ৫৩৮ ইলেক্টোরাল ভোটের মধ্যে তিনি পেয়েছেন ২৯০ ভোট। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছেন ২১৪ ভোট। এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের জয়ের আশা ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল। একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল নিয়ে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির অবসান হলো। এখনও দুটি রাজ্যের ফল ঘোষণা করা হয়নি। অবশ্য জয়-পরাজয় নির্ধারণে তা কোনো ভূমিকা রাখবে না।

বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সী প্রেসিডেন্ট হিসেবে আগামী ২০ জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করবেন। এর মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে পরাক্রমশালী দেশটির সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার জন্য তার প্রায় অর্ধশতাব্দীর লড়াইয়ের সফল সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। এ জয়ের ফলে ১৯৯২ সালের পর এই প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প এক মেয়াদ শেষেই হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নিচ্ছেন।

এরই মধ্যে বাইডেন শিবির ক্ষমতা গ্রহণের প্রস্তুতি শুরু করেছে। গণমাধ্যমে জয়ের খবর প্রকাশের পর পর এক টুইট বার্তায় বাইডেন জনগণের উদ্দেশে বলেছেন, ‘এই মহান দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমাকে নির্বাচিত করায় সম্মানিত বোধ করছি। আমাদের সামনের কাজ কঠিন হবে। কিন্তু আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি আমেরিকার সবার প্রেসিডেন্ট হবো, আমাকে আপনি ভোট দিয়েছেন কি দেননি, সেটা বিষয় নয়।’ তিনি দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ সময় রোববার সকালে বাইডেনের বিজয় ভাষণ দেওয়ার কথা। জয়ের খবরে বিশ্ব নেতারা তাকে স্বাগত জানাতে শুরু করেছেন। বাইডেনের বিজয়ের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিস। বিজয়ের খবর প্রচারের পর তিনি বাইডেনকে ফোন করে বলেন, ‘আমরা পেরেছি, জো।’

৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের বিজয়ের খবর জানাজানি হওয়ার পর রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির বিএলএম প্লাজায় উল্লসিত লোকজনকে ‘ঈশ্বরকে প্রশংসা, ডোনাল্ড ট্রাম্প বিদায় নিয়েছেন’ বলে গান গাইতে দেখা যায়। অনেকে এ সময় আনন্দে কেঁদে ফেলেন। বিপরীতে স্বাভাবিকভাবে হতাশা নেমে আসে ট্রাম্প শিবিরে।

সিএনএন জানায়, বাইডেনের বিজয়ের খবর প্রচারের কয়েক মুহূর্ত পরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘বাইডেন মিথ্যে জয়ের ভাব ধরার জন্য তাড়াহুড়ো করছেন এবং ভোটযুদ্ধ এখনও শেষ হওয়ার অনেক বাকি।’ ওই বিবৃতিতে বলা হয়, তাদের আইনি যুদ্ধ সোমবার থেকে শুরু হবে। ট্রাম্প তার বিবৃতিতে বলেন, ভোট গণনার ফলগুলো এখনও নির্বাচনী কর্মকর্তারা প্রত্যয়ন করেননি এবং এগুলো আসলে সংবাদমাধ্যমের পূর্বাভাস মাত্র।

ট্রাম্প পরাজয় স্বীকার করে বাইডেনকে অভিনন্দন জানাবেন না বলে হোয়াইট হাউস সূত্র সিএনএনকে জানিয়েছে। নির্বাচনের জালিয়াতির অভিযোগ এনে ট্রাম্প শিবির ইতোমধ্যেই আইনি লড়াই শুরু করেছে।

তবে ট্রাম্প হার স্বীকার না করলেও রিপাবলিকান শীর্ষ নেতাকর্মীরা ট্রাম্পের পরাজয় মেনে নিতে শুরু করেছেন। আগে থেকেই ট্রাম্পের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই বলেছিলেন, নির্বাচনে কোনো জালিয়াতি হয়নি।

এই জয়ে সবচেয়ে বেশি বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ইতিহাস গড়লেন ৭৭ বছর বয়সী বাইডেন। এর আগেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পপুলার ভোট পাওয়ার ইতিহাসও সৃষ্টি করেন এই ডেমোক্র্যাট নেতা।

বাইডেনের জয়ের জন্য সবার চোখ ছিল পেনসিলভানিয়া ও নেভাদার দিকে। এর যে কোনো একটিতে জয় পেলেই তিনি বিজয়ী হতেন। পেনসিলভানিয়ায় জন্ম হয় তার। সিএনএনের খবরে বলা হয়, পেনসিলভানিয়ায় বাইডেন পেয়েছেন ৩৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭২৪ ভোট। আর ট্রাম্প পেয়েছেন ৩৩ লাখ ১১ হাজার ৩১০ ভোট। ব্যবধান ৩৪ হাজার ৪১৪ ভোট। আর দেশজুড়ে পপুলার ভোটের হিসাব বলছে, এ পর্যন্ত গণনা করা ভোটের মধ্যে বাইডেন পেয়েছেন সাত কোটি ৪৪ লাখ ৭৮ হাজার ৫৩৩ ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্ব্বী ট্রাম্প পেয়েছেন সাত কোটি তিন লাখ ৩০ হাজার ২১০ ভোট।

১৯০০ সালের পর এবারের নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে। মোট ভোটে বাইডেন আগের সব রেকর্ভেঙেছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্পের চেয়ে তিনি প্রায় ৪১ লাখ বেশি ভোট পেয়েছেন।

বাইডেন এর আগে ২৬৪টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট পেয়ে এগিয়ে ছিলেন। গতকাল পেনসিলভানিয়ার পাশাপাশি নেভাদায়ও জয় পান তিনি। এর মাধ্যমে তিনি ২৯০টি ইলেক্টোরাল ভোট পান। জয়ের জন্য দরকার ২৭০ ভোট। এর মাধ্যমে ইতিহাসের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে জয়ী হলেন বাইডেন। তিনি ১৬ ইলেক্টোরাল কলেজের জর্জিয়ায়ও জয় পাবেন বলে দৃঢ়ভাবে আশা করা হচ্ছে। এটা হলে তার ইলেক্টোরাল ভোট হবে ৩০৬।

বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। সেই সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনেক বিতর্কিত নীতি বাতিল করে বিশ্ব ব্যবস্থায় ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার রয়েছে তার। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি, ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তিসহ ট্রাম্পের বাতিল করা অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তি তিনি পুনর্বহাল করবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন।

বাইডেনের রাজনৈতিক জীবন দীর্ঘ পাঁচ দশকের। ১৯৭০ সালে ডেলাওয়ারের নিউক্যাসল কাউন্টির কাউন্সিলম্যান নির্বাচিত হন জো বাইডেন। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৭২ সালের নভেম্বরে তৎকালীন জনপ্রিয় রিপাবলিকান সিনেটর স্যালেব বগসের বিপক্ষে ডেমোক্রেটিক দল থেকে প্রার্থী হন তিনি। তারপর নাম লেখান ইতিহাসে। মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী পঞ্চম সিনেটর নির্বাচিত হন। ‘৭৩ থেকে টানা ২০০৯ সাল পর্যন্ত সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

১৯৮৭ সালে একবার ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রেসিডেনশিয়াল প্রাইমারিতে লড়ার ঘোষণা দেন বাইডেন। তবে অসুস্থতার কারণে ১৯৮৮ সালে প্রাইমারির শুরুতে ক্ষান্ত দেন তিনি। ২০০৭ সালে আবার প্রেসিডেন্ট পদে দলীয় প্রাইমারিতে নামেন। সেই যাত্রায় তিনি বারাক ওবামা আর হিলারি ক্লিনটনের বিপক্ষে তেমন সুবিধা করতে পারেননি। পরে ২০০৮ সালে ওবামা তাকে রানিংমেট হিসেবে বেছে নেন। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

এর আগে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী, ইলেক্টোরাল কলেজ ও পপুলার ভোটে সুস্পষ্ট ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন বাইডেন। তার পরিস্কার বার্তা ছিল, ‘জনগণ আমাদের অ্যাকশনে যাওয়ার ক্ষমতা (ম্যান্ডেট) দিয়েছেন।’ তিনি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছেন।

গতকাল পর্যন্ত সবার নজর ছিল ফল ঝুলে থাকা পাঁচটি রাজ্যের দিকে। এর মধ্যে জর্জিয়া, পেনসিলভানিয়া ও নেভাদায় নিরাপদ ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন বাইডেন। ট্রাম্প এগিয়ে ছিলেন নর্থ ক্যারোলাইনা ও আলাস্কায়। এর মধ্যে নর্থ ক্যারোলাইনায় তার জয় কার্যত নিশ্চিত ছিল। বাইডেন যে কোনো একটিতে জয়ী হলেই হতো। অবশেষে পেনসিলভানিয়া ও নেভাদায় জয় পেয়েছেন তিনি।

ফল ঘোষণা বিলম্বিত হওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছিল। বাইডেনের পাশাপাশি তার সমর্থক, যুক্তরাষ্ট্রের বহু নাগরিক এবং সারাবিশ্ব অধীর অপেক্ষায় ছিল ফল ঘোষণার। তবে ভোটের হিসাব-নিকাশে বাইডেনের পিছিয়ে পড়ার কোনো আশঙ্কাই ছিল না। যদিও আদালতে মামলা করে মুখ রক্ষার টার্গেট নিয়ে এগোচ্ছিলেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের শেষ ভরসা এখন সুপ্রিম কোর্টে রিপাবলিকান সমর্থক বিচারপতিদের সংখ্যাধিক্য। গুরুত্বপূর্ণ পেনসিলভানিয়ায় ভোট গণনা স্থগিত রাখার চেষ্টা করেছিলেন তিনি।

বিশ্বনেতাদের শুভেচ্ছা : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় জো বাইডেনকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিশ্বনেতারা। বাংলাদেশ সময় গতকাল রাতে বাইডেনের জয় নিশ্চিত হওয়ার পরপরই বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা তাকে অভিনন্দন জানানো শুরু করেন। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল বাইডেনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে এক টুইট বার্তায় বলেন, ট্রান্স আটলান্টিক সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাইডেন ও কমলাকে ‘পথপ্রদর্শনকারী নির্বাচনে’ জয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন।

বাইডেনকে আরও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোন, ইইউর দুই শীর্ষ নেতা মাইকেল ও ফন দেয়ার লায়েন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শুভেচ্ছা জানিয়ে বাইডেনকে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আমার গর্বের শেষ নেই।’ গত নির্বাচনে পপুলার ভোট বেশি পেয়েও ট্রাম্পের কাছে হেরে গিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। গতকাল এক টুইটে তিনি বলেছেন, বাইডেনের জয় সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।