আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা: দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ১০ লাখ মানুষ এখনও পানিবন্দি। জলাবদ্ধতার কারণে তাদের বসতভিটা, ফসলের জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সবকিছুই ভাসছে পানিতে। টিকতে না পেরে এলাকা ছাড়ছে বহু মানুষ। ভয়াবহ এই জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধানের পথ হিসেবে নদী খনন এবং নদীতে অবাধ জোয়ার-ভাটার ব্যবস্থা বা টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্টকে (টিআরএম) কার্যকর পন্থা হিসেবে উল্লেখ করেছেন জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, স্থানীয় বাসিন্দা ও বিশেষজ্ঞরা। নদী খননের পাশাপাশি টিআরএম প্রকল্প আবার চালু করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনে দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের দাবি করেছেন তারা।
রোববার ‘বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে জরুরি সহায়তা ও দীর্ঘস্থায়ী প্রচেষ্টা’ শীর্ষক এক অনলাইন আলোচনা সভায় এসব বিষয় উঠে আসে। বেসরকারি সংস্থা উত্তরণ, ও ডেইলি স্টার যৌথভাবে এ আলোচনার আয়োজন করে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে ও বাংলাদেশে জাতিসংঘের কনসালট্যান্ট তানজিম ফেরদৌসের সঞ্চালনায় এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ. কে. এম. এনামুল হক শামীম। স্বাগত বক্তব্য দেন সমকালের ভারপ্রাপপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি। সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ, উন্নয়নকর্মী, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দারাও এতে বক্তব্য দেন।
সমকালের ভারপ্রাসম্পাদক মুস্তাফিজ শফি তার স্বাগত বক্তব্যে বলেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের জলাবদ্ধতার সমস্যাটি নতুন নয়। এ কারণে মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আমরা জানি এ সমস্যা সমাধানে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আবার সামাজিক কিছু সমস্যার কারণে ‘টিআরএম’ নামক বিশেষ প্রকল্পটি বন্ধও হয়ে গেছে। জনবান্ধব এই উদ্যোগ আবার নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক সমস্যা সমাধানে সরকার, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতনিধি, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমকে একযোগে কাজ করতে হবে। সবাই ঐক্যবদ্ধ হলে বাঙালির কোনো উদ্যোগই ব্যর্থ হয় না, ইতিহাস আমাদের বারবার সেই শিক্ষা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রেও আমরা সফল হবো ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ. কে. এম. এনামুল হক শামীম বলেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জলাবদ্ধতার বিষয় একটু ভিন্ন। সমস্যা নিরসনে টিআরএমের গুরুত্বের কথা সবাই বলছেন। আমরা মূলত জনগণের জন্য কাজ করি। স্থানীয় মানুষের দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা নিয়েই কাজ করব। কারণ, তারা জোয়ার-ভাটা ও জলোচ্ছ্বাস-ঝড়সহ নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাছ থেকে দেখছেন।
জলাবদ্ধতা ও নদীভাঙন রোধে স্থায়ী সমাধানের আশ্বাস দিয়ে মন্ত্রী বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছে। দেশের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরিদর্শনে যাচ্ছি। এই মাসের মধ্যেই দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জলাবদ্ধ এলাকাগুলো পরিদর্শন করব। টেকনিক্যাল কমিটিসহ সবার পরামর্শ নিয়ে স্থায়ী সমাধানে যাব।
সভাপতির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানে টিআরএমের কোনো বিকল্প নেই। এখানে ৬২টি নদী খননের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুধু নদী খনন করে সমস্যার সমাধান হবে না। যেগুলো দরকার সেগুলো খনন করে বাকিগুলোকে টিআরএমের আওতায় আনা হোক। সচল আমডাঙ্গা খালটি আরও গভীর এবং চওড়া করে ভৈরবের সঙ্গে সংযুক্ত করা গেলে সমস্যার সমাধান হবে।
সাতক্ষীরা-১ আসনের সংসদ সদস্য মুস্তফা লুৎফুলল্গাহ বলেন, টিআরএমের কারণে গত আট বছর কপোতাক্ষের মানুষ জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত। অথচ সরকারের জলাবদ্ধতা দূর করার নতুন প্রকল্পে টিআরএম নেই। ভবদহের জলাবদ্ধতা দূর করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যে ৫৫০ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে, তার বড় অংশজুড়ে রয়েছে শুধু নদী খনন আর নানা অবকাঠামো নির্মাণ। সাতক্ষীরা সদর, আশাশুনি আর তালার জন্য নেওয়া প্রকল্পেও টিআরএম নেই। স্থানীয় জনগণের মত উপেক্ষা করে কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হলে সে উন্নয়ন হবে যান্ত্রিক এবং সাময়িক।
জলাবদ্ধতা দূর করতে কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা, সততা ও উদ্যোগের প্রতি জোর দিয়ে সাতক্ষীরা-২ আসনের সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবি বলেন, ছোট বেলায় যে নদী দেখেছি, তা এখন মাঠ হয়ে গেছে। সেই নদীগুলো খুঁজে বের করতে হবে। না হলে নদীতে আর জোয়ার-ভাটা খেলবে না। সব নদী খনন করে এর মুখ যদি সাগরের দিকে দেওয়া যায়, তা হলেই কেবল সমাধান মিলবে। নদী বাঁচাতে এবং জলাবদ্ধতা নিরসনে টিআরএম একমাত্র সমাধান।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, আশির দশক থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চিংড়ি ও মাছ চাষের কারণে সমস্যা শুরু হয়েছে। নদীর প্রবাহ বন্ধ রেখে মাছ চাষ করতে দেওয়া যাবে না। এই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছাই পারে সমাধান।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক প্রকৌশলী এ এম আমিনুল হক বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সমস্যা খুবই জটিল। টিআরএমের পাশাপাশি বড় সমাধান হচ্ছে জোয়ারকে ছয় ঘণ্টা চলমান রাখার সুযোগ করে দেওয়া। শুধু খাল ড্রেজিং নয়, কানেক্টিভিটি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
উত্তরণের পরিচালক শহিদুল ইসলাম বলেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রতি বছর মানুষ জলাবদ্ধতার শিকার হন। এই জলাবদ্ধতা ছয়-আট মাস এবং কোথাও কোথাও প্রায় সারাবছর লেগে থাকে। প্রতি বছর ১০-১৫ লাখ মানুষ এর ভুক্তভোগী। আশির দশকের মাঝামাঝিতে মানুষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করে। ১৯৯৬ সাল থেকে এশিয়ান উন্নয়ন ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের একটি প্রকল্প শুরু হয়। নদীগুলোর ভিন্নতার কারণে এই অঞ্চলে টিআরএম ২০১২ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু বিল কাপালিয়াতে একটি সামাজিক সমস্যার কারণে টিআরএম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে জলাবদ্ধতা আবার বেড়েছে। ২০১১ সালে ২৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে টিআরএম পদ্ধতি অনুসরণ করে কপোতাক্ষ নদ পুনর্খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এখনও এই অববাহিকায় জলাবদ্ধতা নেই।
তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের সাতক্ষীরায় ইতোমধ্যে সরকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে। কিন্তু এই প্রকল্পে পলি অপসারণ, নদী খনন, বাঁধ সংস্কার করার কথা থাকলেও টিআরএম পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে না।
সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান বলেন, জমিদার প্রথার সময় অষ্টমাসী বাঁধ থাকত। আট মাস এই বাঁধ স্থানীয় মানুষ ব্যবস্থাপনা করত। পরে যখন জনগণের কাছ থেকে এটি কেন্দ্র্রে চলে আসে, তখন স্থানীয় মানুষের মতামত না নিয়েই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। জলাবদ্ধতার সমাধান নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে- ওই এলাকার মানুষই এটার সমাধান করতে পারেন। স্থানীয় মানুষ টিআরএমের কথা বলছে, কারণ তারা এটি প্র্যাক্টিস করেছে।
৯৪ শতাংশ মানুষ টিআরএমের সঙ্গে নদী খননের কথা বলছে জানিয়ে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) সহকারী নির্বাহী পরিচালক জহিরুল হক খান বলেন, যখন টিআরএম ছিল না তখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জোয়ার-ভাটার পরিমাণ ছিল ০.৯ মিলিয়ন। টিআরএম চালুর পর ছয় গুণ বেড়ে জোয়ার-ভাটার পরিমাণ ৫.৩ মিলিয়ন হয়ে গেল। নদীর গভীরতা বেড়ে গেল ছয় মিটার, যা আগে ছিল দশমিক এক মিটার। ১৫-১৬ মিটার গভীরতা বেড়েছে পাঁচ মাসের ভেতরে। টিআরএম হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক সমাধান। এটাতে কোনো অবকাঠামো প্রয়োজন হয় না। প্রাকৃতিকভাবেই জোয়ার-ভাটা যাওয়া-আসা করে। নদীর নাব্য বাড়ে। তবে এটির সামাজিক চ্যালেঞ্জ আছে। টিআরএমের জন্য যে জমির দরকার, মানুষ সেই জমি অধিগ্রহণ করতে দিচ্ছে না।
পানি কমিটির সভাপতি এবিএম সফিকুল ইসলাম বলেন, এই অঞ্চলে গত ৩০ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেও সমস্যার সমাধান হয়নি। টিআরএমই একমাত্র সমাধান। প্রতিটি নদীর অববাহিকায় এটি করতে হবে।
পায়রা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিষুষ্ণপদ দত্ত বলেন, যে বিশাল পরিমাণ পলি নদীতে আসে তা দূর করতে না পারলে জলাবদ্ধতা যাবে না। এই এলাকার মানুষের ঘর থেকে বের হওয়ার অবস্থা নেই। নদী বাঁচানো না গেলে জলাবদ্ধতার সমাধান হবে না।
পানি কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুজ্জামান বলেন, নদী খননে যে খরচ হয়, তার চেয়ে অনেক কম খরচে অবাধ জোয়ার-ভাটার প্রচলন করা যায়।
জাগো নারীর প্রধান নির্বাহী ও স্টার্ট ফান্ড বাংলাদেশের নির্বাহী সদস্য হোসনে আরা হাসি বলেন, উপকূলের মানুষ সবারই কমবেশি ক্ষতি হয়েছে। উপকূলের নাব্য প্রতিনিয়ত কমছে। অনেক নদী হারিয়ে ফেলেছি। বাঁধ দিয়ে নদী মেরেছি। আমাদের অঞ্চল ভাগ করে কাজ করতে হবে।
স্থানীয় সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ বলেন, পানির প্রবাহ সব নদী সমানভাবে পাচ্ছে না। নদীগুলো ইছামতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। এতে এখানে ভয়ংকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। চিংড়ি চাষ গলার ফাঁসে পরিণত হয়েছে। বাঁধগুলো পানি নিস্কাশনে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাতক্ষীরা পৌরসভার কাউন্সিলর জোছনে আরা বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে জলাবদ্ধতার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে নারী, শিশু, কিশোর-কিশোরী ও বয়স্কদের। শিশুরা প্রতিনিয়ত পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। নারীরা নানা রোগে ভুগছেন।
পানি কমিটির সদস্য হাসেম আলী ফকির বলেন, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা- জলবায়ু পরিবর্তন, জলোচ্ছ্বাস, সিডর, আইলা ও আম্পান। বারবার নদী খনন হচ্ছে, পরের বছর আবার নদী ভরাট হচ্ছে। নদী যেহেতু সংকীর্ণ হয়েছে, জোয়ারের পানি তার প্লাবনভূমি পাচ্ছে না। ফলে জলাবদ্ধতা তীব্র হচ্ছে। অথচ টিআরএমের সুফল ১৫-১৬ বছর ধরে পেয়েছি- এটা পরীক্ষিত।
আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা: ৯/১১/২০২০
০১৭১২৩৩২৯৯