অগ্নিগর্ভ ইথিওপিয়া মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরলেন ১০৪ বাংলাদেশি

নয়দিনের অবরুদ্ধ জীবন বোমা, গুলির মুখে। এই হয়তো যমদূত কেড়ে নেবে তাদের জীবন। এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পর উদ্ধার হয়েছেন গৃহযুদ্ধকবলিত ইথিওপিয়ার টাইগ্রেতে আটকে পড়া ১০৪ বাংলাদেশি গার্মেন্টকর্মী। এর মাধ্যমে তারা ফিরে পেয়েছেন নতুন জীবন। তারা বললেন, মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি। সত্যিই আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। জাতিসংঘের সহায়তায় শনিবার তাদের উদ্ধার করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জানানো হয়েছে- পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ইথিওপিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস জাতিসংঘ বাহিনীকে উদ্ধারকাজে সহায়তা করছে।

আটকে পড়া ওই শ্রমিকরা ডিবিএল ইন্ডাস্ট্রিজের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। উদ্ধারের পরপরই পোশাককর্মীরা বাংলাদেশে থাকা তাদের উৎকণ্ঠিত স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদেরকে ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবার নিরাপদ স্থানে আপাতত রাখা হয়েছে। মানবজমিনকে জানিয়েছেন ইথিওপিয়ার জন্য মনোনীত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. নজরুল ইসলাম।

বাংলাদেশি গার্মেন্ট কর্মীরা যেখানে আটকা পড়েছিলেন সেখানেই গত এক সপ্তাহে শত শত বেসামরিক লোককে হত্যা করা হয়েছে। ইথিওপিয়ার টাইগ্রে অঞ্চল এখন এক  অগ্নিকুণ্ডুলি। সেখানে ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের মধ্যে তীব্র লড়াই চলছে।
আর এ লড়াই এখন গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছে। এতে ক্রমেই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠেছে ইথিওপিয়া। যুদ্ধকবলিত টাইগ্রে অঞ্চলেই আটকে পড়েছিলেন ১০৪ বাংলাদেশি গার্মেন্টকর্মী। ইথিওপিয়ান সেনাবাহিনী এবং দেশটির অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের মধ্যে ব্যাটেল গ্রাউন্ডের কাছাকাছি এলাকাগুলোতে বেসামরিক লোকজনের সঙ্গে বাংলাদেশিরাও অনেকটা নিরুপায় হয়ে পড়েছিলেন। উদ্ধার করার আগে বাংলাদেশিদের দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা বাংলাদেশ সরকারের কাছে আকুতি জানিয়েছিলেন বাংলাদেশি পোশাক কর্মীদের নিয়োগকারী কোম্পানি ডিবিএল গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জব্বার ইথিওপিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশি গার্মেন্ট কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এরইমধ্যে তাদের ডিবিএল ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসি’র কারখানা চত্বরে বোমা পড়েছে। টাইগ্রে অঞ্চলে থাকা কারখানা থেকে বাংলাদেশি গার্মেন্টকর্মীদের দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া জরুরি। আর এটি করতে অবশ্যই সরকারি পর্যায়ে সহায়তা প্রয়োজন। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, আমাদের কর্মীরা এখন পর্যন্ত নিরাপদে আছেন। তবে পরিস্থিতি যেকোনো সময় ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। যুদ্ধকবলিত এলাকা থেকে বাংলাদেশি কর্মীদের অন্যত্র সরিয়ে নিতে তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তা চেয়েছেন জানিয়ে বলেন, টাইগ্রে অঞ্চলে যেকোনো সময় চরমমাত্রার সহিংসতার সৃষ্টি হতে পারে। যা বেসামরিক লোকজনকে নিশ্চিত জীবন ঝুঁকিতে ফেলবে। এ বিষয়ে ঢাকায় অবস্থানরত ইথিওপিয়া মিশনের জন্য মনোনীত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. নজরুল ইসলাম অবশ্য বলেছেন, টাইগ্রে অঞ্চলের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির ওপর দূতাবাস সার্বক্ষণিক নজর রাখছে। ইথিওপিয়ায় আটকেপড়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে আদ্দিস আবাবাস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা। এরপরই জাতিসংঘের সহায়তায় শনিবার তাদের উদ্ধার করা হয়। আল জাজিরার রিপোর্ট বলছে, ইথিওপিয়ার অস্থির টাইগ্রে অঞ্চলে লড়াই তীব্র হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে এতে সেখানে কয়েক শত মানুষ মারা গেছেন। ইরিত্রিয়া এবং সুদান সীমান্তের মধ্যবর্তী অঞ্চলে এর অবস্থান হওয়ায় সেখানে একটি নতুন গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদি যুদ্ধ বেধে যায় তাহলে এটা হবে আফ্রিকার দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ। ২০১৮ সাল থেকে সেখানে শত শত মানুষ মারা গেছে। মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে বলেছে, ইথিওপিয়ার টাইগ্রে অঞ্চলে গৃহযুদ্ধে সম্ভবত শত শত বেসামরিক মানুষ মারা গেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ সতর্কতা জারি করেছে। বৈশ্বিক ওই সংস্থা বলছে, ত্রাণকর্মীরা দুর্গত এলাকাগুলোতে খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং প্রয়োজনীয় সরবরাহ পৌঁছে দিতে পারছে না। এর ফলে সেখানে নতুন করে শরণার্থী সংকট সৃষ্টি হতে পারে। অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ইথিওপিয়ায় খাদ্যের মজুত ফুরিয়ে আসায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশটিতে বিনিয়োগকারী বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশি কোম্পানি ডিবিএল গ্রুপ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা সম্ভাবনা দেখে ইথিওপিয়ায় নিটওয়্যার কারখানা স্থাপন করে, যা ২০১৮ সাল থেকে অপারেশনে যায়। এটি সেখানকার তৈরি পোশাক রপ্তানিতে একটি শীর্ষ স্থানীয় প্রতিষ্ঠান। আফ্রিকার দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করতে শুল্ক ছাড় দেয়া হয়। সেই সুবিধা পাওয়ার জন্য এই কোম্পানিটি ইথিওপিয়ায় তাদের কারখানাটি খুলে। আফ্রিকার দেশগুলো যেমন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানি সুবিধা পায়, বাংলাদেশ এখন আর সেটি পায় না। বাংলাদেশের জন্য ২০১৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র এই সুবিধা জিপিএস (জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্সেস) স্থগিত রেখেছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে কারখানা রয়েছে ডিবিএলের। তাদের রয়েছে প্রায় ৩৮ হাজার শ্রমিক। চীনের পরেই সারাবিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশ।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।