বাস পোড়ানোর ঘটনায় রাজধানীর খিলক্ষেত থানায় করা একটি মামলায় বিএনপির ১১৪ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, পূর্বপরিকল্পিতভাবে বাসের স্টাফদের হত্যার উদ্দেশ্যে পেট্রলবোমা ছুড়ে জানালার কাচ ভাঙচুর করেছেন আসামিরা। তবে এজাহারে বাদী হিসেবে নাম থাকা দুলাল হাওলাদারের দাবি, মামলাটি তিনি করেননি। আসামিদেরও চেনেন না। সবকিছু করেছে খিলক্ষেত থানা-পুলিশ।
গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে কুড়িল ফ্লাইওভারের প্রবেশমুখের পাশে দুলাল হাওলাদারের মিনিবাস (ঢাকা মেট্রো ব ১১-৭৩৩৬) দাঁড়িয়ে ছিল। কে বা কারা বাসটিতে আগুন লাগিয়ে পালিয়ে যায়। এই মামলার বাদী দুলাল হাওলাদার।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মোট ১১টি বাস পোড়ানো হয়। এসব ঘটনায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের দায়ী করে রাজধানীর আটটি থানায় মোট ১১টি মামলা হয়। এর মধ্যে খিলক্ষেত থানার মামলাটি ছাড়া বাকি ১০ মামলার বাদীই পুলিশ। এর বাইরে পুলিশের কাজে বাধা এবং গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় আরও দুই থানায় দুটি মামলা হয়েছে।
খিলক্ষেত থানার মামলার এজাহারের কপি সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। এই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হওয়া জাহাঙ্গীর হোসেনকে। তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সভাপতি। মামলার এজাহারে ১১৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১ থেকে ২১ নম্বর পর্যন্ত আসামিদের দলীয় পদবি, ঠিকানা ও বাবার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এরপরে ৯৩ জনের শুধু নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের ঠিকানা বা বাবার নাম দেওয়া নেই। এঁদের সবার নামের পাশে ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য উল্লেখ করা হয়েছে। এই মামলাতেই সবচেয়ে বেশি আসামি।
এজাহারে আরও বলা হয়েছে, ‘আরও অজ্ঞাত অনেকে একই উদ্দেশ্যে পূর্বপরিকল্পিতভাবে বেআইনি জনতাবদ্ধে আমার উক্ত বাসের স্টাফদের হত্যার উদ্দেশ্যে বাসের ভেতর পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে বিস্ফোরণ ঘটায়ে বাসের জানালার কাচ ভাঙচুর করে ক্ষতিসাধন করে বিএনপির দলীয় স্লোগান দিতে দিতে সুকৌশলে ঘটনাস্থল হতে চলে গেছে।’
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা বাদী দুলাল হাওলাদারের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে প্রথম আলোর কাছে তিনি ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেন। তাঁর বাড়ি বরিশালের উজিরপুরে। ঢাকার কুড়িলে তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন। ৯ বছর ধরে তিনি পরিবহনব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। বৃহস্পতিবার পুড়ে যাওয়া গাড়িটি একটি পোশাক কারখানার স্টাফ বাস হিসেবে ভাড়ায় চলত।
দুলাল হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, মিনিবাসটির চালক ও কর্মচারী রাস্তার পাশে গাড়িটি দাঁড় করিয়ে নিচে নেমেছিলেন। তখন তিন ব্যক্তি এসে বাসের বাঁ পাশ দিয়ে বোতলে রাখা পেট্রলে আগুন ধরিয়ে বাসের জানালা দিয়ে ভেতরে ছুড়ে দেয়। এই দৃশ্য দেখে বাসের চালক ও কর্মচারীরা এগিয়ে এলে ওই যুবকেরা দৌড়ে কিছু দূরে রাখা একটি প্রাইভেট কারে করে চলে যান। আগুনে বাসের ছয়-সাতটি আসন পুড়ে গেছে। সামনের গ্লাস এবং পাশের ছয়–সাতটি গ্লাস ভেঙে গেছে।
মামলার বিষয়ে দুলাল হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার গাড়িটা ওরা (পুলিশ) নিয়ে গেছে, নাম–ঠিকানা সব নিয়ে গেছে। শুনসি, ওরা (পুলিশ) মামলা একটা করছে।’ এজাহারে আপনার সই আছে, এ কথা জানানোর পর তিনি বলেন, ‘পুলিশ বলসে, ভাই, আপনি সই দিয়ে যান। আমরা গাড়ির ব্যবস্থা করবানে। আমি একটা সাদা কাগজে সই দিয়ে এসেছি।’
মামলার বিষয়ে দুলাল হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার গাড়িটা ওরা (পুলিশ) নিয়ে গেছে, নাম–ঠিকানা সব নিয়ে গেছে। শুনসি, ওরা (পুলিশ) মামলা একটা করছে।’ এজাহারে আপনার সই আছে, এ কথা জানানোর পর তিনি বলেন, ‘পুলিশ বলসে, ভাই, আপনি সই দিয়ে যান। আমরা গাড়ির ব্যবস্থা করবানে। আমি একটা সাদা কাগজে সই দিয়ে এসেছি।’
এজাহারে বলা হয়েছে, বিএনপির নেতারা গাড়ি পুড়িয়েছেন, ১১৪ জনের নাম লেখা আছে, এক নম্বর আসামি জাহাঙ্গীর হোসেনসহ অন্যদের চেনেন কি না, এই প্রশ্নের জবাবে দুলাল বলেন, ‘আমি তো ভাই কাউরেই দেখি নাই, কাউরেই চিনি না। কারণ হলো যে আমি তো স্পটে (ঘটনাস্থলে) ছিলাম না। ড্রাইভার, স্টাফ ছিল। ওরাও কাউরে চেনে না। পুলিশে কী করসে না করসে, কারে ধরসে, কার কাছ থেকে জবানবন্দি নিসে, এগুলা আমি বলতে পারি না।’
দুলাল হাওলাদারের এমন বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে খিলক্ষেত থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ বোরহান উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁর এই কথা সঠিক নয়। কার না কার সঙ্গে যোগাযোগ করে এমন কথা বলেছে, সেটাও জানা নেই। তিনি বাসের মালিক। মামলা না দিলে মামলা হলো কেমনে?’
বাসমালিক বলেছেন, সাদা কাগজে সই নেওয়া হয়েছিল, এ প্রসঙ্গে ওসি বলেন, ‘এটা সঠিক নয়।’ বাদীর দাবি, তিনি এক নম্বর আসামিকেই চেনেন না এমন প্রসঙ্গ তুললে ওসি বলেন, ‘ঠিক আছে ভাই।’ এরপর তিনি ফোনটি কেটে দেন।
রিমান্ডে বিএনপির আরও ২০ নেতা–কর্মী
বাস পোড়ানোর ঘটনায় ১১ মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী হওয়া ইশরাক হোসেন, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ফজলুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন, সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক রাকিবুল ইসলাম, সদস্যসচিব আমানুল্লাহসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। বৃহস্পতিবারের ঘটনায় পুলিশ সব মিলিয়ে যে ১৩টি মামলা করেছে, তাতে মোট আসামি ৬৪৭ জন। তাঁদের মধ্যে বাস পোড়ানো মামলার আসামি ৫৫৩ জন।
বাস পোড়ানোর ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে করা ১০টি মামলার মধ্যে ৮টির এজাহারে আনা অভিযোগ প্রায় একই। এতে ঢাকা-১৮ আসনে জাতীয় সংসদের উপনির্বাচন (বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত) বানচাল করতে এবং দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পূর্বপরিকল্পিতভাবে বিএনপি, এর অঙ্গসংগঠনসহ ২০-দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা বাসে আগুন লাগিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়।
আদালত সূত্রে জানা যায়, এসব মামলায় শুক্রবার বিএনপির ৩৬ নেতা-কর্মীকে আদালতে হাজির করা হয়। তাঁদের মধ্যে ২৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে (সর্বনিম্ন দুই দিন, সর্বোচ্চ পাঁচ দিন) রিমান্ডে নেয় পুলিশ। গতকাল বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের আরও ২০ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
চট্টগ্রামে থেকেও ঢাকার মামলার আসামি
বৃহস্পতিবার মতিঝিলে অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যাতায়াতে ব্যবহৃত বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় করা মামলায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ৪২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে চট্টগ্রাম নগর যুবদলের সভাপতি মোশাররফ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ শাহেদ রয়েছেন।
মুহাম্মদ শাহেদ গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সাংগঠনিক কাজে তিনি ও মোশাররফ হোসেন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। এরপর থেকে তাঁরা চট্টগ্রামেই রয়েছেন। মতিঝিল থানায় করা মামলায় নাম থাকার বিষয়টি ফোনে গতকাল বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে তাঁকে জানানো হয়। চট্টগ্রামে থেকে ঢাকার মতিঝিলে বাসে পোড়ানোর দেওয়া মামলায় আসামি হওয়ার কথা শুনে বিস্মিত তিনি।