মহানবী (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা

করোনায় ক্ষত-বিক্ষত জীবনীশক্তি লেখনীর শক্তিকেও থমকে দিয়েছিল। তাই কিছুটা বিলম্বিত এ লেখা। তবে আইন, বিচার, সভ্যতা, যুক্তি, সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় সম্প্রীতির বিবেচনায় এ লেখার বিষয়বস্তু এখনও গুরুত্ব বহন করে বৈ কি। একজন মুমিনের কাছে রাসুল (সা.) পৃথিবীর সবকিছুর চেয়ে বেশি প্রিয়। তিনি মুমিনের আত্মার আত্মীয়। রাসুল (সা.) উম্মতের জন্য তাদের মা-বাবার চেয়েও বেশি স্নেহশীল ও দয়ার্দ্র। এমনকি ব্যক্তির নিজের চেয়েও তার জন্য তিনি বেশি কল্যাণকামী। কঠিন কেয়ামতের দিন সবাই শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, কেউ কাউকে পরিচয় দেবে না। কিন্তু প্রিয় নবী (সা.) সেদিনও তর উম্মতের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে সিজদায় পড়ে থাকবেন। তাই প্রকৃত মুমিন পৃথিবীর সব সম্পর্কের ওপর রাসুল (সা.)-এর সম্পর্ককে প্রাধান্য দেয়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমাদের কোনও ব্যক্তি ততক্ষণ মুমিন হতে পারে না যতক্ষণ না রাসুল (সা.) তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান-সন্ততি ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় হয়।’ (বুখারি, ১৪) স্বয়ং মহান আল্লাহ রাসুল (সা.)-এর মর্যাদাকে দুনিয়ার সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি আপনার খ্যাতিকে সমুচ্চ করেছি’ (সুরা ইনশিরাহ: আয়াত ৪) যেখানে আল্লাহর নাম আসে সেখানে নবী (সা.)-এর নামকেও মহান আল্লাহ প্রাসঙ্গিক করে দিয়েছেন। যেমন, আজান, নামাজসহ অন্যান্য বহু জায়গায়। বিশ্বে প্রতি মুহূর্তে কোটি কোটি বার রাসুল (সা.)-এর নাম উচ্চারিত হয়ে থাকে। পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে নবী (সা.)-এর নাম এবং গুণ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা হয়েছে। নবী (সা.)-এর আনুগত্যকে মহান আল্লাহ নিজের আনুগত্যরূপে শামিল করেছেন এবং নিজের আদেশ পালন করার সঙ্গে সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর আদেশও পালন করতে মানব সম্প্রদায়কে নির্দেশ দিয়েছেন।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘(হে রাসুল! আপনি) বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ কর; তাহলেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাশীল দয়ালু।’ (সুরা আল-ইমরান: আয়াত ৩১)

মুসলমানদের প্রাণাধিক প্রিয় এমন নবী সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ বিশেষ করে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয়ভাবে মুহাম্মদ (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন বিশ্বের মুসলিমদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, যে ব্যঙ্গচিত্রকে রাসুল (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র বলছে কুলাঙ্গাররা, তা কখনই রাসুল (স.)-এর ব্যঙ্গচিত্র হতে পারে না। কারও ব্যঙ্গচিত্রে তার মুখাবয়ব দেখে বুঝা যায় এটি কার ব্যঙ্গচিত্র। ব্যঙ্গচিত্রের জন্য একজনের অবয়ব/ইমেজ/চিত্র/ছবির ধারণা থাকা দরকার।

১৩৮৮ বছর আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া রাসুল (সা.)-এর কোনও ছবি/ইমেজ/চিত্র/অবয়ব কারও কাছে থাকা তো দূরের কথা, কারও অনুমান করারও সাধ্য নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি রাসুল (সা.)-এর কোনও ব্যঙ্গচিত্র আঁকা সম্ভব নয়। এটি ইসলামের প্রতি বিদ্বেষের প্রকাশ। এর সঙ্গে জড়িত আছে মুসলিমবিদ্বেষী উগ্রপন্থীদের অভিবাসনবিরোধী রাজনীতি। মুসলমানদের উসকে দিয়ে ইউরোপ থেকে মুসলমানদের বিতাড়নের ভয়ানক ষড়যন্ত্র। এজন্য এরা শুধু রাসুল (সা.)-এর অবমাননাই করছে না, বরং মহান আল্লাহর পবিত্রবাণী কোরআন শরিফ পোড়ানোসহ নানাভাবে পবিত্র গ্রন্থেরও অবমাননা করছে। রাসুল (সা.) নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রথম প্রকাশিত হয় ১৪১০ সালে ইতালিতে। উত্তর ইতালির বোলগোনায় ‘San Petronio Basilica নামক গির্জায় Giovanni da Modena এর আঁকা ব্যঙ্গচিত্রটি ১৪১০ সাল থেকে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু মুসলমানরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিল না। ২০০১ সালে ইতালির স্থানীয় মুসলমানরা প্রথম এই ব্যঙ্গচিত্রটি সরাতে ইতালি সরকারের কাছে দাবি উত্থাপন করে, কিন্তু ইতালি সরকার তাদের উপেক্ষা করে মুসলমানদের গ্রেফতার করে প্রতিবাদ দমনের চেষ্টা করে। (সূত্র: Richard Owen, Italy’s Muslims say ‘insulting’ fresco must be destroyed, The Times, London, June 29 2001, Frank Bruni, Italy Arrests 5; Fresco Showing Muhammad Is Issue, August 21, 2002)

রাসুল (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের বিষয়টি ব্যাপক আন্তর্জাতিক আলোচনা-সমালোচনার বিষয়ে পরিণত হয় ২০০৬ সালে ডেনমার্কে জাইল্ল্যান্ডসের আঁকা কার্টুনের মাধ্যমে। এরপর সুইডেনের কার্টুনিস্ট লারস ভিকস ২০০৭ সালের জুলাই মাসে রাসুল (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কন করে। সুইডিশ শিল্প গ্যালারি তার আঁকা এসব কার্টুন প্রদর্শন করতে অস্বীকৃতি জানালেও সুইডিশ পত্রিকা নেরাইকস আল্লেহান্ডো নামের একটি পত্রিকা এসব কার্টুন ছাপিয়ে ধর্মীয় মুক্তচিন্তা দাবি করে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এরপর ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডসহ অনেক দেশের সংবাদমাধ্যম এসব কার্টুন প্রকাশ করে। সারাবিশ্বে মুসলমানরা এর প্রতিবাদ জানায়। পরিস্থতি কিছুটা থিতু হয়ে আসলে ফ্রান্সের রম্য সাময়িকী শার্লি এবদো ২০১৫ সালে নবী মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে একটি কার্টুন প্রকাশ করে। এটি প্রকাশের পর প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলায় পত্রিকাটির ১২ সাংবাদিক নিহত হন। তবে কার্টুনটি প্রকাশ বন্ধ করেনি কর্তৃপক্ষ। সেই কার্টুনের ছবি পরে ফরাসি অন্যান্য সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশ করা হয়। পাঁচ বছর আগের ওই হামলায় জড়িত সন্দেহে ১৪ জনের বিচার শুরু হয় চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ। বিচার শুরুর একদিন আগে শার্লি এবদোর মলাটে বিতর্কিত সেই ১২টি কার্টুন চিত্র আবার ছাপা হয়। এরই মধ্যে ফ্রান্সের সরকারি বিভিন্ন সংস্থার দেয়ালে শার্লি এবদোর সেই বিতর্কিত ১২টি কার্টুন প্রদর্শন করা হয়। মুসলমানরা এর প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু  ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, তারা ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন বন্ধ করবে না। এটা তাদের বাক-স্বাধীনতা।

কোনও ধর্মের নবীর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ তথা অবমাননা কী বাক-স্বাধীনতা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা? আইন ও বিচারের রায় কী বলে? এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, ইউরোপের আঞ্চলিক মানবাধিকার আইন ও ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের রায় সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক ও প্রণিধানযোগ্য। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, ১৯৬৬-এর ১৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনোরূপ হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে মতামত পোষণ করার অধিকার প্রত্যেকেরই থাকবে।’ ১৯ (২)অনুচ্ছেদে বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত করে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘প্রত্যেকেরই বাক-স্বাধীনতা থাকবে; সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে এ অধিকারের মধ্যে মৌখিক, লিখিতভাবে অথবা মুদ্রিত আকারে, শিল্পকলা অথবা স্বীয় পছন্দমতো অন্য কিছুর মাধ্যমে, তথ্য ও সকল প্রকার ধ্যান-ধারণার অন্বেষণ, গ্রহণ এবং জ্ঞাত করার স্বাধীনতা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।’ ১৯ (৩) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে বাক-স্বাধীনতার অধিকার চূড়ান্ত, নিরঙ্কুশ ও অবাধ নয়, বরং শর্তযুক্ত। ১৯ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এ ধারার (২) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত অধিকারসমূহ প্রয়োগের সঙ্গে বিশেষ কর্তব্য ও দায়িত্ব জড়িত রয়েছে। অতএব এসব অধিকারের ওপর কিছু বাধা-নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে। তবে অনুরূপ বাধা-নিষেধসমূহ কেবল আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে এবং সেগুলো: (ক) অন্যের অধিকার ও সুনামের প্রতি সম্মানের জন্য; (খ) জাতীয় নিরাপত্তা অথবা জনশৃঙ্খলা অথবা জনস্বাস্থ্য অথবা নৈতিকতার জন্য যেরূপ আবশ্যক কেবল সেরূপ হবে।’ অন্যদিকে, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের ২০ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিভেদ, শত্রুতা অথবা সহিংসতা প্ররোচিত করে এমন কোন জাতিগত, বংশগত অথবা ধর্মগত বিদ্বেষের সপক্ষে প্রচার-প্রচারণা করা আইনের দ্বারা নিষিদ্ধ থাকবে।’ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন বিশ্লেষণে এটি প্রতীয়মান হয় যে, বাক-স্বাধীনতার নামে ইচ্ছাখুশি সবকিছু করা যাবে না। কারণ বাক-স্বাধীনতার সঙ্গে বিশেষ কর্তব্য ও দায়িত্ব জড়িত রয়েছে। একইভাবে ধর্মগত বিদ্বেষমূলক প্রচার-প্রচারণা যা বিভেদ, শত্রুতা অথবা সহিংসতা উসকে দেয় তা-ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ফ্রান্সসহ ইউরোপের সকল দেশ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, ১৯৬৬-এর স্বাক্ষরকারী পক্ষ।

১৯৫০ সালে গৃহীত ইউরোপীয় মানবাধিকার আইন European Convention on Human Rights and Fundamental Freedoms-এর ১০ অনুচ্ছেদে মত প্রকাশের স্বাধীনতা তথা বাক-স্বাধীনতা বিষয়ে বলা হয়েছে ‘10(1) Everyone has the right to freedom of expression. This right shall include freedom to hold opinions and to receive and impart information and ideas without interference by public authority and regardless of frontiers. This Article shall not prevent States from requiring the licensing of broadcasting, television or cinema enterprises. (2) The exercise of these freedoms, since it carries with it duties and responsibilities, may be subject to such formalities, conditions, restrictions or penalties as are prescribed by law and are necessary in a democratic society, in the interests of national security, territorial integrity or public safety, for the prevention of disorder or crime, for the protection of health or morals, for the protection of the reputation or rights of others, for preventing the disclosure of information received in confidence, or for maintaining the authority and impartiality of the judiciary.’

ইউরোপীয় মানবাধিকার আইন পর্যালোলনা করলে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় বাক-স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা শর্তহীন নয়। এ অধিকার উপভোগের সঙ্গে দায়িত্ব ও কর্তব্য জড়িত রয়েছে। অন্যের অধিকার ও সুনাম রক্ষা, জাতীয় নিরাপত্তা, ভৌগোলিক অখণ্ডতা, জনশৃঙ্খলা, জননিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার জন্য যেরূপ আবশ্যক সেরূপ কিছু বাধা-নিষেধ এ অধিকারের ওপর আরোপ করা যেতে পারে। অন্যদিকে, ধর্মনিরপেক্ষতা-ফরাসি ভাষায় যাকে বলে ‘লাইসিতে’ তা ফ্রান্সের জাতীয় পরিচয়ের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। ফরাসি বিপ্লবের পর থেকেই ‘মুক্তি, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ব’ ফরাসি রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র। কিন্তু লাইসিতে বা ধর্মনিরপেক্ষতাকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয় ফ্রান্সে। লাইসিতের মূল কথা হলো জনসমক্ষে—তা ক্লাসরুম হোক বা কাজের জায়গায় হোক- সেখানে ধর্মের কোনও কথাই চলবে না। এরপরও প্যারিসের উপকণ্ঠে একটি স্কুলে, সংবাদ মাধ্যমে এমনকি রাষ্ট্রীয়ে উদ্যোগে রাসুল (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনকে ফ্রান্স সরকার বাক-স্বাধীনতা দাবি করছে। জাতিসংঘের ঘোষণায়ও ধর্মীয় বিদ্বেষ বা ঘৃণা ছড়ায় এমন প্রচার-প্রচারণাকে ‘হেট স্পিচ’ উল্লেখ করে তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। According to the United Nations, ‘hate speech is: any kind of communication in speech, writing or behaviour, that attacks or uses pejorative or discriminatory language with reference to a person or a group on the basis of who they are, in other words, based on their religion, ethnicity, nationality race, colour, descent, gender or other identity factor.’ ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের রায়ে বাক-স্বাধীনতার যে মানদণ্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে বিষয়ে কয়েকটি মামলার রায় উল্লেখ করা যেতে পারে। Handyside v. United Kingdom (1976) মামলায় ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত উল্লেখ করেন যে, বাক-স্বাধীনতা যেমন নিরীহ ও নির্দোষ বক্তব্য প্রকাশ করে তেমনই এর মাধ্যমে এমন বক্তব্যও প্রকাশ পেতে পারে যা সহিংসতা উসকে দেয়, ঘৃণা ছড়ায়, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে। Dahlab v. Switzerland (2001) মামলায় একজন স্কুল শিক্ষয়িত্রী ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে হিজাব পরে স্কুলে আসলে সুইস সরকার হিজাব নিষিদ্ধ করে এ যুক্তিতে যে, এর মাধ্যমে সুইস সরকারের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি লংঘিত হয়েছে। ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত সুইস সরকারের পদক্ষেপকে সমর্থন করে রায়ে উল্লেখ করে যে, হিজাবের দ্বারা কোমলমতি শিক্ষার্থীরা একটি বিশেষ ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। প্রশ্ন হলো, হিজাব পরার কারণে যদি ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি লংঘিত হয় কিংবা ইসলাম ধর্মের দিকে শিক্ষার্থীদের ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, তাহলে ইসলাম ধর্মের নবী (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র স্কুলে প্রদর্শন কী ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি লংঘন করে না? এর মাধ্যমে কী ইসলাম ধর্মের প্রতি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে বিদ্বেষ বা বিরূপ ধারণা সৃষ্টির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় না? ঘৃণা ছড়ায় এমন বাক-স্বাধীনতার ওপর ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র জাতীয় পর্যায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের বিরুদ্ধে হেট স্পিচের পক্ষে ইউরোপের আদালতে দায়ের করা অসংখ্য মামলা ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, Walendy v. Germany, Remer v. Germany, Witzsch v. Germany, Honsik v. Austria, Marais v. France, Schimanek v. Austria মামলার উল্লেখ করা যেতে পারে। Wingrove v. United Kingdom (1996) মামলার ঘটনায় একটি ভিডিও তৈরি করা হয়, যেখানে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর পাশে একজন নারীকে নান (খ্রিস্ট ধর্মের সন্ন‌্যাসিনী)-এর পোশাক পরিয়ে ‘Saint of Teresa’ পরিচয় দেওয়া হয়। ভিডিওতে সন্ন‌্যাসিনীকে যিশুখ্রিস্টের পাশে যৌন উদ্দীপক ফ্যান্টাসিমূলক দৃশ্যে উপস্থাপন করা হয়। British Board of Film Classification ভিডিওটি প্রদর্শনের ছাড়পত্র দিতে অস্বীকার করে এ যুক্তিতে যে, এটি খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসীদের জন্য অপমান ও অমর্যাদাকর। ব্রিটিশ সরকারের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে  ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতে মামলা করা হলে আদালত রায়ে বলেন, ব্রিটিশ সরকার ভিডিওর ছাড়পত্র দিতে অস্বীকার করে যে যুক্তি দিয়েছে তা প্রাসঙ্গিক ও যথাযথ। আদালত আরও উল্লেখ করেন, ব্রিটিশ সরকারের পদক্ষেপ ইউরোপীয় মানবাধিকার আইনের ১০ (২) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। খ্রিস্টধর্মের নবীর অবমাননা যদি বাক-স্বাধীনতা না হয় ইসলাম ধর্মের নবী (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন কীভাবে বাক-স্বাধীনতা হবে?

রাসুল (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনকে যারা বাক-স্বাধীনতা দাবি করছেন তারা আইন ও আদালতের রায়ে প্রতিষ্ঠিত মানদণ্ডের বিরুদ্ধে অসত্য ও ভ্রান্ত দাবি করছেন যা সুস্পষ্ট বিদ্বেষ বৈ আর কিছু নয়। ইসলাম ধর্মের রাসুল (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন তথা তার অবমাননা করে ফ্রান্সের অর্জন করার কিছুই নেই, বরং এটি বিভেদ, ঘৃণা ও সহিংসতাকে উসকে দেবে যা ফ্রান্সের জাতীয় ঐক্য ও সংহতিকে মারাত্মকভাবে বিনষ্ট করবে। মুসলমানদের উচিত হবে সকল সহিংসতা পরিহার করে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানানো ও ইসলামবিদ্বেষী উগ্রপন্থীদের কৌশলের সঙ্গে মোকাবিলা করা। ক্লাসে রাসুল (সা.)-এর কার্টুন দেখানো শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটিকে হত্যার পর ফ্রান্সের জনমত জরিপ বলছে, ফ্রান্সে জনমত আরও কঠোর হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষজন মনে করেন, শার্লি এবদোতে নবীর কার্টুন ছাপানো সঠিক ছিল। এর আগে, অধিকাংশ ফরাসি মনে করতো, এ ধরনের উসকানির প্রয়োজন নেই।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: zhossain1965@gmail.com

Check Also

গাড়িচাপায় বুয়েট শিক্ষার্থী মাসুদের মৃত্যু ‘হত্যাকাণ্ড’

প্রাইভেটকার চাপায় বুয়েট শিক্ষার্থী মুহতাসিম মাসুদের মৃত্যুকে ‘হত্যাকাণ্ড’ বর্ণনা করে দায়ীদের সর্বোচ্চ শাস্তিসহ ৬ দফা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।