৭১ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কি শুরু হয়ে গেল? উল্কা গতিতে বাড়ছে রোগী

দেশে করোনার সংক্রমণ আবার ঊর্ধ্বমুখী। গত কয়েকদিন ধরেই শনাক্ত বাড়ছে। প্রতিদিনের শনাক্তের হারও বৃদ্ধির দিকে। দশ সপ্তাহের মধ্যে গতকাল সর্বাধিক শনাক্ত ২১শ’র কোটা ছাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণের গতি কয়েকদিন বৃদ্ধি পেয়েছে। সংক্রমণের এই গতি আগামী এক সপ্তাহ চলতে থাকলে বলা যাবে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। তারা বলছেন, শনাক্তের বাইরেও কয়েকগুণ রোগী অশনাক্ত থেকে যাচ্ছে। শীতও শুরু হয়েছে।

এর মধ্যেই দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা বাড়ছে। ইতিমধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কাবু হয়ে পড়েছে। তারাও আবার কড়া বিধিনিয়ম চালু করেছে।

দেশে সরকারি হিসাব মতে, দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৬ হাজার ২শ’ ছাড়িয়েছে। সাড়ে ৮ মাসে শনাক্তের সংখ্যা ৪ লাখ ৩৪ হাজারের বেশি। দেশে ৮ই মার্চ প্রথম করোনা শনাক্ত হয় আর প্রথম মৃত্যু ১৮ই মার্চে। প্রথম থেকেই করোনার থাবা ঢাকাতে। হটস্পট ছিল রাজধানী। দিনে দিনে সারা দেশে ছড়ালেও রাজধানীতেই অর্ধেকের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়গুলো শিথিল হওয়ায় পরিস্থিতি রাজধানীতে আবার সংক্রমণ বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মত, মানুষের মধ্যে সার্বজনীনভাবে মাস্ক ব্যবহার, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাত ধোয়ার অভ্যাস বাড়ানো এবং পরীক্ষা ও আইসোলেশনের মতো স্বাস্থ্যবিধির কঠোর প্রয়োগের ওপর এ রোগের বিস্তার অনেকটা নির্ভর করবে। করোনাভাইরাসের কার্যকর কোনো টিকা না আসা পর্যন্ত এ মহামারি শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম উল্লেখ করে শীতকালে বাংলাদেশে এ ভাইরাসটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, আর্দ্রতা, সূর্যের তাপ, ভিটামিন ডি-এর অভাব এবং রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায়সহ শীতকালে অন্যান্য ভাইরাস ও ফ্লু জাতীয় শ্বাসকষ্টের রোগের লক্ষণ দেখা দেয় বলে এ সময় মানুষ করোনাভাইরাস নিয়ে আরো বেশি সংবেদনশীল হয়ে ওঠতে পারে।

জাতীয় কারিগরি পরামর্শ কমিটির অন্যতম সদস্য, দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, দেশে গত কয়েদিন ধরে করোনা রোগী শনাক্ত আবারা বেড়েছে। এই গতি আরো একসপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করবো। যদি বাড়তেই থাকে তখন বলবো বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ শুরু হয়ে গেছে। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, মাস্ক পরতে হবে। দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করতে হবে। হাঁচি, কাশি হলে রুমাল বা কনুই ব্যবহার করতে  হবে। সরকার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে ভালো করেছে উল্লেখ করেন এই বিশেষজ্ঞ। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ যেভাবে চলছে, তাতে ধরেই নেয়া যায় শীতকালে এ ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়ার প্রকোপ বাড়বে। তার আশঙ্কা শীতকালে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে, কেননা বছরের এ সময়টাতে মানুষের মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত আরো অনেক ভাইরাস ও ফ্লু জাতীয় রোগের লক্ষণ দেখা যায়। তিনি বলেন, শীতে তাপমাত্রা ও কম আর্দ্রতা করোনাভাইরাসকে আরো বেশি সময়ের জন্য বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেবে। সেই সঙ্গে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি ও রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে করোনাভাইরাসটি মানুষের ওপর আরো বেশি প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, শীতে প্রবীণ ব্যক্তি ও শিশুদের এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আরো মারাত্মক হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক  ডা. বে-নজির আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশে এখনও প্রথম ঢেউই শেষ হয়নি।  সংক্রমণ একইভাবে চলছে। টেস্ট বাড়ালে রোগী বেড়ে যায়। পরীক্ষা কম হলে শনাক্তও কমে যায়। কয়েকগুণ রোগী অশনাক্ত থেকে যাচ্ছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ হয়নি দেশে। বেশকিছু দেশে সংক্রমণ শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। আমরা কমাতে পারিনি। তিনি বলেন, বহু রোগী ভাইরাসটি নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। এর মাধ্যমে তারা রোগ ছড়াচ্ছেন। শুরু থেকেই শনাক্ত রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের আমরা বেশি বেশি করে খুঁজে বের করতে পারিনি। কিছুটা করা হয়েছে। কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে কম। প্রচুর টেস্ট করার কথা থাকলেও তা হয়নি। স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন জনগণ। তিনি মনে করেন, করোনার লক্ষণগুলো শীতজনিত রোগের মতো। এটি মূলত শীতের একটি রোগ। যাদের শ্বাসনালী সমস্যা থাকে তাদের করোনার কারণে মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যাবে। এর অনেকগুলো স্ট্রেন আছে যা গ্রীষ্ম ও বর্ষার মৌসুমে বেঁচে থাকতে পারে। অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, শীতে ছোটদের নিউমোনিয়া এবং বড়দের হাঁপানি বেড়ে যায়। তাই এটা নিয়েই আমাদের দুশ্চিন্তা বেশি। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কিছু স্ট্রেন শীতকালে তীব্র ও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। দ্বিতীয় পর্যায়ের ধাক্কা লাগতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য এই বিশেষজ্ঞ। তাই বেশি বেশি প্রতিরোধের দিকে নজর দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। দ্রুত র‌্যাপিড এন্টিজেন পরীক্ষা চালু করার কথা বলেন। একই সঙ্গে এন্টিবডি টেস্ট চালু করাও প্রয়োজন।

নতুন শনাক্ত ২১৩৯, মৃত্যু ২১: দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত মোট ৬ হাজার ২১৫ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ২ হাজার ১৩৯ জন। এখন পর্যন্ত  মোট শনাক্ত হলেন ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৪৭২ জন। ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ১ হাজার ৬০৪ জন। দেশে এখন পর্যন্ত করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন ৩ লাখ ৫১ হাজার ১৪৬ জন। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এতে আরো জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগৃহীত হয়েছে ১৬ হাজার ২১৮টি। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১৫ হাজার ৭৬৮টি। এখন পর্যন্ত করোনার মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ২৫ লাখ ৫৬ হাজার ৯৬২টি। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ আর এখন পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮০ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়াদের ১৫ জন পুরুষ এবং ৬ জন নারী। তাদের মধ্যে ৬০ বছরের  বেশি ১৪ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ১ জন এবং ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ৬ জন রয়েছেন। ঢাকা বিভাগে ১৩ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৪ জন, রংপুর বিভাগে ৩ জন এবং রাজশাহীতে ১ জন রয়েছেন। তাদের ২০ জন হাসপাতালে এবং ১ জন বাসায় মারা গেছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে ৮৩৭ জনকে, কোয়ারেন্টিন থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৮৫৮ জন। এ পর্যন্ত কোয়ারেন্টিনে যুক্ত হয়েছেন ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৫৪২ জন, ছাড়া পেয়েছেন ৫ লাখ ২৭ হাজার ২৯৮ জন। বর্তমানে কোয়ারেন্টিনে আছেন ৩৯ হজার ২৪৪ জন। ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশনে রাখা হয়েছে ১৫৬ জনকে, ছাড়া পেয়েছেন ১২৪ জন। এ পর্যন্ত আইসোলেশনে যুক্ত হয়েছেন ৪৪ হাজার ৫৬৪ জন, ছাড়া পেয়েছেন ৭৬ হাজার ৩৯৪ জন। বর্তমানে আইসোলেশনে আছেন ১২ হাজার ১৭০ জন

Check Also

বাংলাদেশে একটি সফল ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখি: মুহাঃ ইজ্জতউল্লাহ

সাতক্ষীরা সংবাদদাতাঃ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের অন্যতম সদস্য অধ্যক্ষ মুহাঃ ইজ্জতউল্লাহ বলেছেন, প্রত্যেক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।