ইটভাটার তারে জড়িয়ে নিহত হলো দশ বছরের শিশু জাহিদুল: ১০ দিনের ব্যবধানে মায়ের কাছে ফিরলো লাশ হয়ে

সামিউল মনির, শ্যামনগর: শিশু শ্রমের বলি হয়ে জাহিদুল ইসলাম নামের দশ বছর বয়সী এক শিশু মাত্র পনের দিনের ব্যবধানে লাশ হয়ে পরিবারের কাছে ফিরেছে। কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার রামনগর এলাকার ইটেরভাটায় কাজ করতে যেয়ে সোমবার দুপুরে তার মৃত্যু হয়। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার জয়নগর গ্রামের প্রতিবন্ধী ও মানসিক ভারসাম্যহীন হামজার আলী আর মোমেনা দম্পতির একমাত্র ছেলে ছিল সে। পনের দিন আগে ইট উল্টানোর কাজের জন্য স্থানীয় শ্রমিক সর্দার রবিউল ইসলাম জাহিদুলকে কুমিল্লায় নিয়ে যায়।

মঙ্গলবার ভোরে জাহিদুলের মৃতদেহ বহনকারী এ্যাম্বুলে¯œ জম্মস্থান শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ী ইউনিয়নের জয়নগর পৌছালে সেখানে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। পরবর্তীতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি আর গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে শিশু জাহিদুলকে দাফন করা হয়।
এরআগে স্থানীয়ভাবে সমঝোতার ভিত্তিতে জাহিদুলের পরিবারকে এক লাখ টাকা বুঝিয়ে দেয়ার বিষয়ে তাকে ইটেরভাটায় নিয়ে যাওয়া শ্রমিক সর্দারকে নির্দেশ দেয়া হয়।

এদিকে ইটভাটার কাজের মতো কঠোর পরিশ্রমে শিশুদের জড়িত করার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জাহিদুলের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ীদের আইনের আওতায় নেয়ার দাবি জানিয়েছে সুজনসহ বিভিন্ন সংগঠন।

জয়নগর গ্রামের আকবর আলী ও আব্দুল হকসহ কয়েকজন জানান, জাহিদুল ইসলামের পিতা সহায় সম্বলহীন হামজার আলী একজন অসুস্থ বাক প্রতিবন্ধী। তার মা মোমেনা বেগম মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়েও ভিক্ষাবৃত্তি করে সংসার চালায়। তারা আরও জানান, অভাবের সংসারে ঠিকমত খাওয়া জোটে না বিধায় স্থানীয় শ্রমিক সর্দারের প্রস্তাব মেনে দুই সপ্তাহ আগে শিশু জাহিদুলকে তার হাতে উঠিয়ে দেয় পরিবার। মাত্র পনের দিন কাজ না করতেই গত সোমবার দুপুরের দিকে জাহিদুলের মৃত্যুর খবর পরিবারের কাছে পৌছে।

স্থানীয়রা জানায়, কর্মস্থলে মাটি ভেজানোর কাজে ব্যবহৃত মোটরের তারে জড়িয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলে জাহিদুলের মৃত্যু হয় বলে তাদেরকে জানানো হয়েছে। তবে ইটভাটার কাজে যাওয়ার পর থেকে সে কঠোর পরিশ্রমের কাজ করতে না পারার কথা একাধিকবার পরিবারকে জানিয়ে বাড়িতে ফেরার দাবি তুলেছিল বলেও তারা জানান।

নিহত শিশুর খালা সফুরুন্নেছা বেগম জানান, অভাবের কারনে ঠিকমত খাওয়া জোটে না। বাধ্য হয়ে তিরিশ হাজার টাকা চুক্তিতে জাহিদুলকে সর্দার রবিউলের হাতে তুলে দেয়া হয়। সোমবার বেলা একটার দিকে কুমিল্লা থেকে মুটোফোনে শ্রমিক সর্দার রবিউল তাদেরকে জাহিদুলের মৃত্যুর খবর দেয়। তিনি আরও জানান কষ্টের কাজ করতে না পেরে শেষ দু’তিন দিন জাহিদুল সেখানে কান্নাকাটি করছিল। কিন্তু সর্দারের থেকে নেয়া দাদনের টাকা ফিরিয়ে দেয়ার সামর্থ্য না থাকায় তারা শিশুটিকে ফেরানোর উদ্যোগ নেয়নি।

জাহিদুল ইসলামকে ইটভাটায় নেয়া শ্রমিক সর্দার রবিউল ইসলাম জানান, চরম অভাবের শিকার জাহিদুলদের পরিবারটি অসহায়ত্বের মধ্যে দিনাতিপাত করছিল। তাই বাধ্য হয়ে নিজ ছেলে রাকিবের সাথে জাহিদুলকে চান্দিনার একটি ইটের ভাটায় নিয়ে যাওয়া হয়। সোমবার বেলা সাড়ে এগারটার দিকে মটরের তারে জড়িয়ে আহত হলে চান্দিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। তিনি আরও জানান, দুর্ঘটনায় শিশু জাহিদুলের মৃত্যু হলেও স্থানীয়দের অনুরোধে নিহত শিশুর পরিবারকে এক লাখ টাকা দিতে সম্মত হয়েছেন। ইট ভাটা কতৃপক্ষের তরফ থেকে নিহত শিশুর পরিবারকে সহায়তার দেয়ার বিষয়ে তিনি কোন তথ্য দিতে পারেননি।

সংশ্লিষ্ট ইটভাটার ম্যানেজার মামুন কারিকর ও কোম্পানী পরিচালক গিয়াসউদ্দীনের সাথে মুঠোফোনে একাধিক বার চেষ্টা করা হলেও তারা কেউই ফোন রিসিভ করেননি।
সিডিইও ইয়ুথ টিমের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আল ইমরান বলেন, নানা কৌশলে শত শত শিশুকে দেশের বিভিন্ন অংশের ইট ভাটায় হাড়ভাঙা খাটুনির কাজে যোগদান করা হচ্ছে। শ্রমিক সর্দারদের দাদনের যাঁতাকলে জড়িয়ে নিরুপায় অভিভাবকরা কোলের শিশুদের দুর-দুরান্তে কষ্টের কাজে পাঠাতে সম্মত হচ্ছে। জনপ্রতিনিধি আর প্রশাসনকে কর্মক্ষেত্রে শিশু শ্রমিকের ব্যবহারে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। অন্যথায় শিশু জাহিদুলের মত আরও অনেক শিশুকে নির্মম পরিনতির শিকার হতে হবে। তিনি নিহত শিশু জাহিদুলের পরিবারকে সংশ্লিষ্ট ইটভাটা মালিকের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি সহকারী অধ্যাপক আশুতোষ রায় বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ইট ভাটার শ্রমের কাজে ব্যাপকহারে শিশুদের ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে ভাটাগুলোতে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। একইসাথে অভাবী শিশুদের পরিবারের জন্য সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। একইভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিশুদের ব্যাপারে শিক্ষকদেরও অনেক বেশী সচেতন ভুমিকা পালন করতে হবে।
‘সুজন’ এর শ্যামনগর উপজেলা শাখার সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বলেন, ইট ভাটায় শিশু শ্রমিকের ব্যবহার বন্ধে আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। এমন মর্মস্পর্শী ঘটনার দায় এড়াতে পারে না কোন পক্ষ। দায়ীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা রুজু হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, এক বছর পুর্বে ঢাকার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠানস্থলে বিদ্যুৎ এর তারে জড়িয়ে এক মেধাবী ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা ও ক্ষতিপুরণ দেয়ার মত ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। তাই জরুরী ভিত্তিতে শিশু জাহিদুলের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিয়ে ইট ভাটায় শিশু শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করার সতর্ক বার্তা দিতে হবে

Check Also

সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ডের উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ড (রাজারবাগান ও সরকারপাড়া ইউনিট) এর উদ্যোগে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।