ক্রাইমবাতা রিপোট: জরুরি ভিত্তিতে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর ভেঙে যাওয়া ঘাটাখালির রিং বাঁধ ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে মেরামত করা হয়। কিন্তু ছয় মাস যেতে বা যেতেই সেই বাঁধ মঙ্গলবার (১৭ নভেম্বর) দিনগত রাতে ফের ভেঙে গেছে। এতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এর ফলে বর্তমানে টেন্ডার ছাড়াই জরুরি কাজের নামে চলমান সাড়ে আট কোটি টাকা ব্যয়ের বাঁধ মেরামত কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে ভেঙে যাওয়া বাঁধ যথাযতভাবে মেরামত না হওয়া, জরুরি মেরামতের নামে অর্থ লোপাট এবং দশটি গ্রাম এখনও পানিতে তলিয়ে থাকায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সাতক্ষীরা পওর বিভাগ-২-এর আওতায় আম্পানের পর ঘাটাখালি বাঁধের মেরামত কাজে অনিয়ম এবং অদক্ষ লোক দিয়ে কাজে ফাঁকি ও অর্থ লোপাট হয়েছে। ফলে বাঁধ টেকসই হয়নি। আর এখন চলমান বাঁধ মেরামত কাজেও অদক্ষ লোক নিয়োগ ও কাজের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পাউবো কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ।
নিয়ম অনুযায়ী ডিপিএম পদ্ধতির কাজের স্থানে জন-অবহিতকরণ সাইনবোর্ড থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে চলমান সাড়ে আট কোটি টাকার বাঁধ মেরামত কাজের কোনও সাইনবোর্ড নেই। ফলে স্থানীয় মানুষ কাজ সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাচ্ছে না। যেনতেনভাবে এ সব কাজ বাস্তবায়ন হওয়ায় জোয়ারের পানির চাপে বা ছোটখাটো দুর্যোগে ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে ভেঙে যাওয়া বাঁধ যথাযতভাবে মেরামত না হওয়া, জরুরি মেরামতের নামে অর্থ লোপাট, ১০টি গ্রাম এখনও পানিতে তলিয়ে থাকায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, মঙ্গলবার দিনগত রাত সোয়া ১টার দিকে কয়রা উপজেলা সদর ইউনিয়নের ঘাটাখালি রিং বাঁধ ভেঙে গেছে। জোয়ারের পানির চাপে এ বাঁধের ১০ হাত জায়গা ভেঙে যায়। এর ফলে এ বাঁধ সংলগ্ন গোররা, ঘাটাখালি ও হরিণখোলা গ্রামে পানি উঠে যায়। এ গ্রাম তিনটির প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এ ভাঙন মেরামতে বুধবার ভোরে আম্পানের পর কাজ করা ঠিকাদার শ্রমিক পাঠিয়ে পুনরায় মেরামতের উদ্যোগ নেন। স্থানীয় নাগরিক নেতারা এ সময় সেখানে এ কাজ তদারকি করেন।
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দীন বলেন, ‘সরকার উপকূলবাসীকে দুর্যোগ-দুর্ভোগ থেকে বাঁচাতে যথেষ্ট বরাদ্দ দিয়েছে এবং দিচ্ছে। তবে এ সব বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার না হওয়ায় কয়রার মানুষকে এখনও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় এখন ঘাটাখালি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় তিনটি গ্রামের মানুষ ফের সঙ্কটে পড়েছেন। বাঁধটি ভাঙা থাকলে বিল হবে না, তাই ঠিকাদার শ্রমিক পাঠিয়ে পুনরায় মেরামত কাজ করছে।’
তিনি বলেন, ‘আম্পানের পর ঘাটাখালির রিং বাঁধে সাধারণভাবে কাজ হয়। ফলে টেকসই হয়নি। বাঁধটি শক্তিশালী করতে ৮৫ লাখ টাকারও বেশি বরাদ্দ হয়। সঠিকভাবে কাজটি না করায় আবারও ভেঙেছে। কোনও প্রকার সাইনবোর্ড না থাকার কারণে কাজে লুকোচুরি হয়। স্বচ্ছতা থাকে না। আমরা চাই বাঁধ মেরামতের সব ধরনের কাজে স্বচ্ছতা ফিরে আসুক। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজে স্বচ্ছতা ফিরে আসা জরুরি।’
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, কয়রা উপজেলার ১৪/১ ও ১৩-১৪/২ নম্বর পোল্ডারে আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের ৩২টি স্থানে সংস্কার বা মেরামত কাজ চলমান রয়েছে। যার মোট দৈর্ঘ্য সাড়ে আট কিলোমিটারের বেশি। এসব কাজ ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড (ডিপিএম) বা সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
অভিযোগে জানা গেছে, পাউবোর চলমান কাজ দরপত্র ছাড়াই হচ্ছে। এ কাজ অদক্ষ ঠিকাদার দিয়ে করানোর কারণে বেশির ভাগ কাজই দায়সারা হচ্ছে। অনেক স্থানে বাঁধের ঢাল কেটে উঁচু করা হচ্ছে। মাটির কাজের সঠিক নিয়ম মানা হচ্ছে না। এ কারণে সংস্কার কাজ করার পরপরই অনেক স্থানে বাঁধ ধসে গেছে।
ভাঙনপ্রবণ দক্ষিণ বেদকাশির মেদেরচর ও চরামুখা এলাকার তিনটি স্থানে কাজ করা স্থানীয় ইউপি সদস্য মোজাফ্ফর হোসেন জানান, পাউবোর লোকজনের মৌখিক নির্দেশে কাজ করছেন তিনি। কার্যাদেশ, প্রাক্কলন অথবা অন্য কোনও কাগজপত্র তাকে দেওয়া হয়নি। এ জন্য কোন কাজে কত বরাদ্দ তা তিনি জানেন না। কাজ শেষে মেপে দেখে বিল জমা দেওয়া হয়। মহারাজপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মামুন লাবলু জানান, তিনি দশহালিয়া এলাকার তিনটি স্থানে কাজ করছেন। তিনিও এ কাজের বরাদ্দ সম্পর্কে জানেন না।
পাউবোর কয়রা উপজেলার দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মশিউল আবেদীন বলেন, ‘সঠিক প্রক্রিয়া মেনে বাঁধ মেরামত কাজ করতে গেলে সময় লাগবে। সে ক্ষেত্রে জনদুর্ভোগ আরও দীর্ঘ হবে। বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতিরও ঝুঁকি থাকে। বড় দুর্ঘটনা এড়াতেই জরুরি কাজ হিসেবে দেখিয়ে এ পদ্ধতিতে কাজ করা হয়।’
পাউবো সাতক্ষীরা পওর বিভাগ-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার বলেন, ‘জরুরি মেরামতের কাজগুলো ডিপিএম পদ্ধতিতেই করা হয়। মেরামত কাজ শেষ হলে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মেপে বিল করা হয়।