জিডিপির প্রবৃদ্ধি দিয়ে একটি দেশের উন্নয়ন পরিমাপ করার অর্থনৈতিক যুক্তি ভীষণ দুর্বল হয়েছে বহু আগেই; কিন্তু সাম্প্রতিককালে এ উপমহাদেশে এ বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট রাজনীতি করতে দেখা যায়। ভারতের সরকার বা বাংলাদেশের সরকার তার জিডিপির প্রবৃদ্ধি দিয়ে উন্নয়ন বয়ান তৈরি করার চেষ্টা করে। আবার এ ক্ষেত্রে কোনো খামতি হলে বিরোধীরা সেটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে সরকারের বিরুদ্ধে। যেমন কিছুদিন আগেই ব্যাপারটা ঘটল ভারতের ক্ষেত্রে। সেই প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার আগে জিডিপি দিয়ে উন্নয়ন পরিমাপের ব্যাপারটা কতটা ঠিক, সেটি একটু দেখে নেয়া যাক।
জিডিপির প্রবৃদ্ধি এবং সেটির ভিত্তিতে হিসাব করা মাথাপিছু আয় উন্নয়নের নির্দেশক হিসেবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে গত কয়েক দশক থেকেই। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক কাজ হয়েছে ২০০৮ সালে। সেই সময়ের বিশ্বমন্দার মধ্যেই ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি দু’জন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎজ এবং অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিখ্যাত ফরাসি অর্থনীতিবিদ জাঁ পল ফিটুসিকে দায়িত্ব দেন জিডিপিভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিমাপের সমস্যা এবং এর বিকল্প নিয়ে প্রস্তাবনা দিতে। ২০১০ সালে বের হয় এ তিন লেখকের গবেষণার ফল ‘মিসমেজারিং আওয়ার লাইভস: হোয়াই জিডিপি ডাজনট অ্যাডআপ’ শিরোনামের বইয়ে। বইটির শিরোনামই আমাদের বলে দেয় জিডিপির প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে করা অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিমাপ করার সনাতন পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের বেশিরভাগ মানুষের সত্যিকারে ভালো থাকা পরিমাপ নয়; তাই বিকল্প পরিমাপ পদ্ধতি জরুরি। তার ফলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয়ভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেখানোর প্রবণতা বিশ্বে বিলুপ্তই হয়ে গেছে প্রায়। কিন্তু আমাদের মতো দেশে এ ঘটনা এখনও এ ‘সেকেলে’ চর্চাটা চলছেই এবং ক্ষমতাসীনদের কাছে এটিই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
জিডিপির প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ নিয়ে সম্প্রতি যে চাপান-উতোর চলছে ভারতে, তার ভিত্তি আইএমএফের একটি সাম্প্রতিক রিপোর্ট। তারা বলছে, ডলারের মূল্যে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৪ শতাংশ বেড়ে ১,৮৮৮ ডলারে দাঁড়াবে। কিন্তু ভারতের ১০.৫ শতাংশ হ্রাস পেয়ে হবে ১,৮৭৭ ডলার। চার বছরের মধ্যে এটিই সর্বনিম্ন। অর্থাৎ, বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ভারতের মাথাপিছু জিডিপিকে ছাড়িয়ে যাবে। অবশ্য ২০২১ সালে ভারতের প্রবৃদ্ধি ৮.২ শতাংশ হয়ে ২,০৩০ ডলার স্পর্শ করবে। আর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫.৪ শতাংশ বেড়ে হবে ১,৯৯০ ডলার। ফলে এটি হবে শুধু চলতি বছরের জন্যই, আর হবে না। ভারত আবার বাংলাদেশকে মাথাপিছু জিডিপিতে ছাড়িয়ে যাবে। অবশ্য পিপিপি (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি) ভিত্তিতে এখনও ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ৬ হাজার ২৮৪ পিপিপি ডলার, আর বাংলাদেশের ৫ হাজার ১৩৯ পিপিপি ডলার।
বলছিলাম মাথাপিছু জিডিপির রাজনৈতিক ব্যবহারের কথা। আইএমএফের এ রিপোর্টের পরপরই কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এ তথ্যটি যুক্ত করে মোদির বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন। এর ফলে ভারতে এটি নিয়ে নানা রকম চাপান-উতোর শুরু হয়েছে। মাথাপিছু জিডিপিতে কয়েক বছর আগেও বেশ পিছিয়ে থাকা দেশ বাংলাদেশ ভারতকে অতিক্রম করে চলে যাচ্ছে, এটি ভারতের ক্ষমতাসীন দলের অহমে লেগেছে খুব। আমাদের সরকার মাথাপিছু আয়ে ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়ার খবরটি নিয়ে কিছুই বলেনি। কেন? দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা বাংলাদেশের ওপরে যে ধরনের টানাপোড়েন সৃষ্টি করেছে, সেটি আর না বাড়ানোর জন্যই কি সরকার একেবারে নিশ্চুপ?
মাথাপিছু জিডিপি দিয়ে একটি দেশের অবস্থান বুঝতে চাওয়া একেবারেই বোকামি। বাংলাদেশ ভারতের মতো দেশগুলোয় জিডিপির হিসাব নিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ আছে, অভিযোগ আছে বাংলাদেশের জনসংখ্যা কমিয়ে দেখানোর প্রবণতা নিয়েও। ফলে মোট জিডিপিকে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে যে গড় মাথাপিছু জিডিপি পাওয়া যায় সেটি সঠিক না হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। কিন্তু তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া যাক সব তথ্য-উপাত্ত সঠিক। তাতে কী বোঝা যায়, এ দেশের জনসাধারণ কেমন আছে? রাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী মানুষটি আর সবচেয়ে দরিদ্র মানুষটির আয় যোগ করে গড় করে যদি বলা হয়, গড়ে তাদের আয় এত, তাতে কি দরিদ্র মানুষটির জীবনযাপন সম্পর্কে কিছু বোঝা যায়?
এ সমস্যার কারণেই জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে এবং মাথাপিছু জিডিপি নিয়ে বড়াই করার দিন গত হয়েছে বহু আগেই। এখনকার অর্থনীতিবিদরা খুব সিরিয়াসলি দেখার চেষ্টা করেন একটি রাষ্ট্রের সম্পদ যত বৃদ্ধি হয়, তার তুলনায় সেটির বণ্টন কেমন হচ্ছে। সমাজের একেবারে প্রান্তিক মানুষটি উন্নয়নের কতটা সুফল পাচ্ছে। সেটি বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের পেছনে এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার (২১.৮ শতাংশ) ভারতের (১১.১ শতাংশ) তুলনায় দ্বিগুণ। মাথাপিছু জিডিপিতে এখন এগিয়ে থেকেও বাংলাদেশ শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলোয় জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দে দক্ষিণ এশিয়ায় একেবারে সর্বনিম্ন অবস্থানে আছে।
এখানে যুক্ত করতে চাই অতি সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টের সারাংশ। জাতিসংঘের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন (ইউএনএসক্যাপ) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘দ্য প্রোটেকশন উই ওয়ান্ট: সোশ্যাল আউটলুক ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে চলমান কোভিড-১৯ মহামারীর প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশে গৃহীত সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা করা হয়। প্রতিবেদনে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর জিডিপিতে স্বাস্থ্যবহির্ভূত সামাজিক সুরক্ষা ব্যয়ের হার নিয়ে একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়।
এ অঞ্চলে জিডিপিতে স্বাস্থ্যবহির্ভূত সামাজিক সুরক্ষা ব্যয়ের হারের দিক থেকে শীর্ষ দুটি দেশ হচ্ছে ইরান ও তুরস্ক; যেগুলোয় এ খাতে ব্যয় যথাক্রমে মোট জিডিপির ১০.১ শতাংশ ও ৯.৯ শতাংশ। শ্রীলংকায় এ হার ৫.২ শতাংশ। এ ছাড়া ভারতে জিডিপির ৩.২ শতাংশ, মালদ্বীপে ২.৯, নেপালে ২.১, পাকিস্তানে ১.৮, আফগানিস্তানে ১.৮ ও ভুটানে ১ শতাংশ স্বাস্থ্যবহির্ভূত সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়। এদিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশে এ হার মাত্র ০.৭ শতাংশ। অর্থাৎ, পাকিস্তান, এমনকি আফগানিস্তানের মতো দেশেও এ খাতে ব্যয় বাংলাদেশের আড়াই গুণ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং এর বাইরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বাংলাদেশের খুব কম ব্যয়ের মাশুল আমরা দেই আমাদের দারিদ্র্যের হার এবং মানবসম্পদের ক্ষেত্রে অনেক দুর্বলতার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে আমাদের ভীষণ লজ্জা দিতে পারে আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপাল।
স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় তিনটি শর্ত হচ্ছে এ রকম। মাথাপিছু আয় (১২৮০ ডলারের বেশি), মানবসম্পদ সূচক (৬৬ বা তার বেশি) এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক (৩২ বা তার কম)। এ তিনটি বিষয়ের মধ্যে কমপক্ষে দুটিতে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। এর মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সূচক, মানবসম্পদ সূচক নিয়ে নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা দেখা যাক। মানবসম্পদ সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৭৩.২, আর নেপালের স্কোর বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য কম-৭১.২। এ সূচকের মধ্যকার কিছু কম্পোনেন্ট এ দুই দেশের তুলনা দেখি। নেপালে শিশুমৃত্যুর হার ৩৪.৫, আর আমাদের ৩৪.২। সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তির হার নেপালে ৬৯.৬, আর আমাদের দেশে ৬৩.৫। অবিশ্বাস্য পরিসংখ্যান আছে অপুষ্টির শিকার নাগরিকদের অনুপাতে। যেখানে বাংলাদেশে ১৫.১ শতাংশ মানুষ অপুষ্টির শিকার, সেখানে নেপালে এ হার আমাদের প্রায় অর্ধেক, ৮.১ শতাংশ। নেপালের মাথাপিছু জিডিপি আমাদের ৬০ শতাংশ মাথাপিছু আয় নিয়ে আমাদের সমান সার্বিক মানবসম্পদ সূচক অর্জন করেছে নেপাল এবং অনেক উপসূচকে আমাদের চেয়ে ভালোও করেছে।
এ দেশের যতটুকু অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে তার সুফল যে আসলে হাতে গোনা কিছু মানুষের হাতেই চলে গেছে তার প্রমাণ আমরা পাই এ দেশে ধনী বৃদ্ধির হারে। সারা বিশ্বে অতি ধনী (২৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক) বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ প্রথম, আর ধনী বৃদ্ধির হারে (সাড়ে ৮ থেকে ২৫০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক) বাংলাদেশ তৃতীয়। দেশের বৈষম্য মাপার সূচক আমাদের এটি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়। ২০১৬ সালেই আমাদের জিনি সহগ ০.৪৮৩ এবং পা’মা অনুপাত (সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ আর সবচেয়ে দরিদ্র ৪০ শতাংশ মানুষের আয়ের অনুপাত) নির্ণীত হয়েছে ২.৯৩; দুটি নির্দেশকই বাংলাদেশে বিপজ্জনক মাত্রার বৈষম্য নির্দেশ করে।
ইদানীং দেখি কিছু অর্থনীতিবিদ বৈষম্য নিয়ে এক ধরনের ন্যারেটিভ বাজারে ছাড়ার চেষ্টা করছেন-কোনো রাষ্ট্র দ্রুত উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলে উচ্চ বৈষম্য অনিবার্য। এমন দাবি তথ্যগতভাবে ভুল। বাংলাদেশের আগে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ হওয়ার যোগ্যতা অর্জনকারী ভিয়েতনাম আর মালদ্বীপের ক্ষেত্রে কী ঘটেছে সেটি দেখা যায়। এ দুটি দেশ বাংলাদেশের চেয়েও দ্রুত উন্নতি করেছে।
ভিয়েতনামের গিনি সূচক ২০০৭ সালে ছিল ০.৩৭, আর ২০১৮ সালে সেটি কমে হয়েছে ০.৩৫। মালদ্বীপের ক্ষেত্রে ২০০২ সালে সেখানে গিনি সূচক ছিল ০.৪১, আর ২০১৬ সালে সেটি বেশ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে হয়েছে ০.৩১। অর্থাৎ, রাষ্ট্র যদি চায় এই বৈষম্য নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা তো যায়ই, কমিয়েও ফেলা সম্ভব।
ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাকটিভিস্ট