দেশের অধিকাংশ মানুষ খাদ্য চাহিদা পূরণ ও জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষিকাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ক্রমহ্রাসমান আবাদযোগ্য জমি বর্তমানে কৃষকের জীবন ও জীবিকা নির্বাহের অন্যতম প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আবাদযোগ্য কৃষি জমি হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে ব্যাপকভাবে। ফলে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা নিশ্চিতকরণ, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থেই কৃষির বহুমুখীকরণ তথা সমন্বিত ভূমির ব্যবহার এখন সময়ের দাবি।
এমনই এক বহুমুখী সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস্থাপনার নাম হল কৃষি বনায়ন, যা পরিবেশের উপকরণগুলো যেমন- গাছপালার সঙ্গে কৃষিজ ফসল, গবাদি পশুপাখি, হাঁস-মুরগি, মৎস্য ইত্যাদির সমন্বিত ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই উৎপাদন, ভূমির জৈব পদার্থ বৃদ্ধি, সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সর্বোপরি পরিবেশের ভারসাম্য নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি জ্বালানি কাঠ, গো-খাদ্যের চাহিদা পূরণ, ভেষজ চিকিৎসা ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ উৎপাদনের কাঁচামাল সরবরাহে কৃষি বনায়নের ভূমিকা অপরিহার্য। আমাদের দেশে কৃষি বনায়নের ব্যাপক সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। আবাদি জমি ছাড়াও পতিত জমিগুলো যেমন- বসতবাড়ির আঙিনা, কৃষি জমির আইল, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আঙিনা, সড়ক ও রেললাইনের ঢাল, বাঁধ ও ঢালু জমি, নদীর তীর, চর অঞ্চলে কৃষি বনায়নের সুযোগ রয়েছে ব্যাপক।
দেশের চাষযোগ্য ভূমির এক বৃহৎ অংশ অবস্থিত চরাঞ্চলজুড়ে। প্রতি বছর নতুন নতুন চর জেগে ওঠার ফলে চরাঞ্চলের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। দুর্গম চরাঞ্চলের এসব জমির সুষ্ঠু ব্যবহার ও টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য কৃষি বনায়ন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। সাধারণত নদীর গতিপ্রবাহে পলি সঞ্চারণের ফলে গড়ে ওঠা ভূভাগকে চর বলা হয়। নদীবেষ্টিত এসব অংশ চরভূমি হিসেবে পরিচিত। দেশের মোট ভূমির প্রায় ১০ শতাংশ চরভূমি এবং মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫ শতাংশ এসব অঞ্চলে বসবাস করে থাকে। দেশের বেশিরভাগ চর পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকায় গঠিত এবং প্রায় ৩২টি জেলার শতাধিক উপজেলা চরাঞ্চলের অংশবিশেষ। মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন এসব চরাঞ্চল অতিদারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। চরাঞ্চলের মানুষ মূলত কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া পশুপালন, হাঁস-মুরগি পালন ও মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত থাকে। চরাঞ্চলের মানুষ সাধারণত ধান, সরিষা, গম, ডাল, আলু, বাদাম, মরিচ, শাকসবজি ইত্যাদি শস্য চাষাবাদে অভ্যস্ত। এসব অঞ্চলের মানুষ জমিতে বছরের পর বছর একই ধরনের ফসল উৎপাদন করে থাকে। ফলে জমির উর্বরতা যেমন হ্রাস পাচ্ছে তেমনি আকস্মিক বন্যার কবলে পড়ে তারা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। অকাল বন্যা ও নদীভাঙন চরের নিত্যদিনের সঙ্গী। চরাঞ্চলে ভূমিক্ষয় মারাত্মক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। আবার কৃষকরা গভীরভাবে জমি চাষ করে ফসল উৎপাদন করায় ভূমিক্ষয়ও বেশি হয়। তাছাড়া চরাঞ্চলে সেচের পানির অভাব প্রকট। বালি মাটির গঠনের কারণে পানির স্তর অনেক নিচে থাকে। বালি মাটির পানি ধারণক্ষমতা কম থাকায় শস্য উৎপাদনে প্রচুর সেচ প্রয়োজন। চরাঞ্চলের এসব সমস্যা সমাধানে, কৃষকের জীবনমান ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে কৃষি বনায়ন বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
চরাঞ্চলের মানুষের জীবনের অসংখ্য সমস্যার মধ্যে অন্যতম হল খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ না হওয়া। ঘন ঘন বন্যা, ভূমিক্ষয়, বালুময়তা, জমির অনুর্বরতা, সেচের পানির অভাব, উন্নত কৃষিপ্রযুক্তির অভাবসহ বিভিন্ন কারণে খাদ্যের স্বল্পতা এসব অঞ্চলে বিদ্যমান। ফলে প্রয়োজনীয় ও পুষ্টিকর খাদ্য চাহিদা কখনও তারা পূরণ করতে পারে না। নদী ও জীবন প্রকল্পের গবেষণায় দেখা যায়, চরাঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষের একটা বড় অংশ সারা বছর একবেলা খেয়ে জীবন ধারণ করে থাকে। বিশেষ করে আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরে এসব চরের অধিকাংশ মানুষই একবেলার বেশি পেট পুরে খেতে পারে না। এছাড়া এসব অঞ্চলের মানুষ যে মানের খাদ্য গ্রহণ করে থাকে, তা মোটেও পুষ্টিসমৃৃদ্ধ নয়। ফলে পুষ্টিকর খাদ্য চাহিদা পূরণ না হওয়ায় বেশিরভাগ নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর পুষ্টিহীনতাসহ নানা রোগব্যাধিতে ভুগে থাকে।
চরাঞ্চলে বসবাসরত এসব হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিতকরণে এবং ক্ষুধা-বঞ্চনা নিরসনে কৃষি বনায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ কৃষি বনায়ন জমির সর্বোত্তম ব্যবহার, ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি, আয়ের বৈচিত্র্যকরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের স্থিতি বৃদ্ধিকরণের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষা দিতে সক্ষম। সমন্বিত ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি হিসেবে কৃষি বনায়ন কৃষকের বিকল্প অর্থ উপার্জনের উৎস ও খাদ্য নিরাপত্তা বিধানে অবদান রাখতে পারে। এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফলমূল, শাকসবজি প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজের উৎস হিসেবে সেখানকার মানুষের, বিশেষ করে নারী, শিশু, কিশোরদের পুষ্টি চাহিদার জোগান দিতে পারে।
বসতবাড়িতে বিভিন্ন স্তরভিত্তিক কৃষি বনায়নের মাধ্যমে সারা বছরই খাদ্যের চাহিদা পূরণের সঙ্গে সঙ্গে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে। অর্থাৎ কৃষি বনায়নের মাধ্যমে চরাঞ্চলের হতদরিদ্র্য মানুষের জন্য নির্ভরযোগ্য খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিত করা সম্ভব। দেশের প্রধান চরবিধৌত জেলাগুলো হচ্ছে- জামালপুর, ময়মনসিংহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী, ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ, নোয়াখালী। বর্তমানে দেশের এসব চরাঞ্চলে সমন্বিত পদ্ধতিতে ভূমি চাষাবাদ হিসেবে কৃষি বনায়নের বিভিন্ন পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বন্যার আর্থিক ক্ষতি লাঘব ও দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা ভোগের জন্য মানুষ কৃষি বনায়ন পদ্ধতিতে ভূমি ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছে। এসব চরাঞ্চলের মানুষ এখন ফসলি জমিতে একইসঙ্গে কৃষিজ ফসলের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষরোপন করছে। ফল-ফলাদিভিত্তিক কৃষি বনায়ন, গো-খাদ্যভিত্তিক কৃষি বনায়ন, জ্বালানি কাঠভিত্তিক কৃষি বনায়ন, ঔষধি গাছভিত্তিক কৃষি বনায়ন ইত্যাদি চরাঞ্চলে জনপ্রিয় হচ্ছে। এছাড়া বসতবাড়িতে গবাদি পশুপাখি, হাঁস-মুরগি পালনের পাশাপাশি শাকসবজি, আদা, হলুদ, কচু, পেঁয়াজ, রসুন চাষ এবং আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লেবু, মেহগনি, লম্বু, পীতরাজ, বাবলা, কড়ই, রেইনট্রি, নারিকেল, সুপারি ইত্যাদি গাছ লাগানো হচ্ছে। এছাড়া শিশু, পিটালি, ছাতিম, কদম, খয়ের, মান্দার, পলাশ, জিয়ালভাদি, জিলাপি, বাবলা ইত্যাদি গাছও চরাঞ্চলে লাগানোর উপযোগী। তাছাড়া ধানভিত্তিক শস্য বিন্যাসের পরিবর্তে সমন্বিত শস্য বিন্যাসে চরাঞ্চলের কৃষকরা আগ্রহী হচ্ছে বেশি। যেমন- জমির আইলে অথবা জমিতে শাকসবজি ও গাছের সমন্বিত চাষ। আরও কিছু কৃষি বনায়ন পদ্ধতি যেমন- মেহগনি, লালশাক, পাটশাক-আদা/হলুদ-তুলা, আম-লাকশাক-কলমি শাক-আদা-তুলা, আকাশমনি-আম-বরই-জলপাই-সরিষা, আকাশমনি-শসা-মরিচ, পেয়ারা-লালশাক-কলমিশাক-আদা/হলুদ, জলপাই-মুলা-লালশাক-পাটশাক, ইউক্যালিপটাস-লেবু-মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদি সমন্বিত চাষ চরাঞ্চলে করা হচ্ছে।
চরাঞ্চলের কৃষকদের দীর্ঘমেয়াদি মুনাফা অর্জন এবং পুষ্টি চাহিদা পূরণের মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কৃষি বনায়ন অপরিহার্য ভূমিকা রাখতে পারে। এ পদ্ধতিতে স্বল্পমূলী ফসলের সঙ্গে দীর্ঘমূলী গাছ চাষাবাদ করা হয়, যা ভূমিক্ষয় রোধ করতে সক্ষম। তাছাড়া দীর্ঘমূলী গাছ মাটির স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করে, যার ফলে নদীভাঙন অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব। কৃষি বনায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে মাটির উর্বরতা, পানি ধারণক্ষমতা, পুষ্টি গুণাগুণ ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়। দীর্ঘমূলী এসব গাছ মাটির ‘পুষ্টি উপাদান আবর্তনের’ (নিউট্রিয়েন্ট সাইক্লিং) মাধ্যমে মাটির পুষ্টিগুণ বজায় রাখে। তাছাড়া নন-লিগিউম ফসলের সঙ্গে বিভিন্ন লিগিউম গাছ চাষাবাদে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং একইসঙ্গে রাসায়নিক সারের ব্যবহার অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। কারণ লিগিউম ধরনের ফসলের মূলে নডিউল থাকায় তা বাতাস থেকে ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে মাটিতে সরাসরি নাইট্রোজেনের ব্যবহার নিশ্চিত করে। কৃষি বনায়নের মাধ্যমে পানি সহিষ্ণু গাছ যেমন করঞ্জা, হিজল, মান্দার, জারুল, পিটালি, ছাতিম ইত্যাদি রোপণ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ‘সম্পূর্ণ কৃষি ফসলের ক্ষতি’ পুষিয়ে আনা সম্ভব।
কৃষি বনায়নের এসব পদ্ধতি সম্পর্কে চরাঞ্চলের মানুষের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এবং কৃষিবিষয়ক এনজিওগুলো অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। তাছাড়া আদর্শ কৃষকের বাড়ি পরিদর্শনের মাধ্যমে সাধারণ কৃষকদের আগ্রহ বাড়ানো যেতে পারে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে চরাঞ্চল তথা দেশের সব কৃষককে এ পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। দেশের দুর্গম চরাঞ্চল তথা সমগ্র দেশের প্রান্তিক কৃষকদের জীবিকা নিশ্চিতকরণ, দারিদ্র্যবিমোচন, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কৃষি বনায়ন এক অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মাচন করেছে।
মোহাম্মদ কামরুল হাছান : সহযোগী অধ্যাপক, এগ্রোফরেস্ট্রি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়; রোজিনা আক্তার : প্রভাষক, এগ্রোফরেস্ট্রি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়; নাছিমা আক্তার রশনী : এমএস গবেষক, এগ্রোফরেস্ট্রি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়