কৃষি পণ্যের মূল্য বনাম বাজার ব্যবস্থাপনা

বর্তমান সময়ে কৃষি পণ্যের মূল্য ও বাজার ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তথা টেলিভিশনের টকশোতে ব্যাপক আলোচনা চলছে যা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো বাজারে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, মরিচ, আদা, রসুন ডিম, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষি পণ্যের দাম ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলছে যার শেষ কবে হবে কেউ বলতে পারছে না। এর সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছে আলু যা ছিল একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত। বিভিন্ন মিডিয়ার মধ্যমে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা স্বর্ণা জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮-৫০ টাকায়, প্রতি কেজি মসুর ডালের বিক্রি মূল্য বর্তমানে ৮০ টাকায়, খোলা আটা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা যার বিক্রয় মূল্য কিছুদিন আগেও ছিল ২৫ থেকে ২৬ টাকা, আলুর দাম প্রতি কেজি ২২ – ২৫ টাকা থেকে হঠাৎ করে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় উন্নিত হওয়ায় সবাই বিস্মিত যা এর আগে এই ধরনের অযুক্তিক আচরণ আলুর ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। তারপর আসে ডিম প্রতি ডজন বর্তমানে ১২০ টাকা, শাক-সবজির দামও চড়া। সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষের এখন এক আতঙ্কের নাম মূল্যবৃদ্ধি যা অনেকের কাছে করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর বলে প্রতিয়মান হয়। এই মূল্যবৃদ্ধির কারণ অনেকটা প্রাকৃতিক। আবার কেউ বলছেন মানুষ্য সৃষ্টি যার পেছনে আছে নীতি-আদর্শহীন কিছু ব্যক্তি বিশেষের কারসাজি যাদের কাছে সরকারের নীতিনির্ধারক, গণমাধ্যম ও অর্থনীতিবিদগণ মনে হয় দায় বদ্ধ হয়ে আছে। বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাবি করেছে বর্তমানে সব নিত্যপণ্যেরই মজুদ ও সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। তাহলে দাম বেড়েই চলছে কেন বিশেষত: চাল, পেঁয়াজ ও আলু যেগুলো কম পচনশীল দ্রব্য যা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গুদামজাত করে রাখা যায়।

প্রথমত : আসা যাক চালের ব্যাপারে যেখানে দেখা যায় দেশে করোনা পরিস্থিতি শুরুর প্রথম থেকেই মিলাররা কারসাজি করে সব ধরনের চালের দাম বাড়াতে থাকলেও সরকারের হস্তক্ষেপে সিদ্ধান্ত হয় সবচেয়ে উচ্চমানের ৫০ কেজির এক বস্তা মিনিকেট চালের মূল্য (মিলগেট) ২ হাজার ৫৭৫ টাকা এবং মাঝারি ধরনের বিআর-২৮ চালের দাম ২ হাজার ২৫০ টাকা নির্ধারণ করলেও মিলাররা সেটা মানছে না। মিলগেটে প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৭৫০ টাকা যা এক মাসেই সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা ব্যবধানে বিক্রি হচ্ছে আর সরকারের বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকা বেশি দরে। দ্বিতীয়ত : গত বছরও সেপ্টেম্বর মাসে পেঁয়াজের বাজার অস্থির বিরাজ করায় এ বছরও একই কায়দায় হঠাৎ করে পেঁয়াজের দাম আকাশছোঁয়া হওয়ায় ভোক্তারা বিপাকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যে দেখা যায় দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ৩০ লাখ টন আর উৎপাদন হয় ২২-২৪ লাখ টন যার বাদ-বাকি আমদানি করতে হয়। গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এ বছর সঙ্কট সৃষ্টির আগেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পেঁয়াজ আমদানি করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তা না হওয়ায় সঙ্কটে সাধারণ ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হলো আর ব্যবসায়ী সম্প্রদায় লাভবান হলো । পেঁয়াজের বাজার অস্থিরতার পেছনে বৈধ আমদানির ছাড়পত্র, এলসি খোলার কাগজপত্র ছাড়া আমদানিকারকের কমিশন এজেন্ট, আড়তদার পরিচয়ে পেঁয়াজসহ কিছু ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী জনগণকে জিম্মি করার বিষয়টিকে দায়ী করছেন অনেকে। দেশের চাহিদার সিংহভাগ দেশীয় উৎপাদন দিয়ে মেটানো সম্ভব হলেও ব্যবসায়ীরা আমদানিকৃত পেঁয়াজ বিক্রিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

তৃতীয়ত : আলুর বাজার নিয়ে যেখানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু সর্বোচ্চ ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে যা অকল্পনীয়। এই অবস্থায় দাম নিয়ন্ত্রণে প্রথম দফায় গত ৭ সেপ্টেম্বর হিমাগার, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে আলুর দাম বেঁধে দেয় সরকার যা কার্যকর সম্ভব হয়নি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হিমাগার পর্যায়ে আলু বিক্রি হচ্ছে ৩৩-৩৬ টাকায়।

অনেকেই নিত্য ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থির হওয়ার পেছনে শক্তিশালী ভোক্তা সংগঠনের তৎপরতাকে দায়ী করছেন। সে যাই হোক না কেন সরকারের কাছে জনগণ দুটি জিনিস প্রত্যাশা করে যার একটি হলো আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং অপরটি হলো দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি রোধ।

উপরের আলোচনা কৃষিপণ্য মূল্যের উর্ধগতিকে এক আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে যা সরকারী তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এখন আসা যাক বাস্তবতার নিরিখে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টির একটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ যা সময়ের দাবি বলে বিবেচিত। অর্থনীতির তত্ত্ব বলছে চাহিদার সঙ্গে পণ্য মূল্যের যে সম্পর্ক তা বিপরিতমুখী অর্থাৎ দ্রব্যমূল্য বাড়লে চাহিদা কমবে এবং দ্রব্যমূল্য কমলে চাহিদা বাড়বে যা আবার মৌলিক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এই বিষয়টি বাজারে সংঘটিত হয়ে থাকে যেখানে থাকে ক্রেতা, বিক্রেতা, পণ্য ও মূল্য এবং সঙ্কট সমাধানে প্রথমে বাজারকে বুঝতে হবে যার প্রধান উপায় হলো পণ্যে ও চাহিদার সরবরাহের পরিমাণ নির্ণয় যার ভিত্তিতে পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হবে এটি অর্থনীতির সাধারণ পাঠ। বাজারে তিন ধরনের স্টকহোল্ড্ার পাওয়া যায় যেমন উৎপাদক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা এবং বাজার অর্থনীতির নিয়ম অনুসারে সরকার তাদের কার্যাবলিতে নিয়ন্ত্রণের চেয়ে সহযোগিতা করে থাকে। এমতাবস্থায় উৎপাদক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে তাদের নিজ নিজ কার্যসম্পাদন করবে যেখানে সবকিছুই সন্তুষ্টির পথে চলাচল করবে যা বাজার অর্থনীতির মূলমন্ত্র এবং বর্তমান সরকার এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করেছে যার মূল কাজ হলো বাজারে কোন প্রকার অসঙ্গতি দেখা দিলে এই কমিশনের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

আলুতে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নেপালে রফতানির রেকর্ড রয়েছে। তারপরও মূল্য বাড়ার কারণ সরবরাহের ঘাটতি নয়, সেটা ব্যবসায়ীদের তথা কোল্ডস্টোরেজ মালিকদের কারসাজি মাত্র যা বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব হবে; সবজি উৎপাদনে দেশ কেবল স্বয়ংসম্পূণই নয়, বিশ্বে তৃতীয় স্থানে থাকলেও কৃষক এবং ভোক্তা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত বর্তমান সময়ে। যার কারণ সবজি উৎপাদন এলাকাগুলোতে বন্যার প্রাদুর্ভাব যা একটি মৌসুমী সঙ্কট। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ২৫ লাখ ক্ষুদ্র্র বা অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসায়ী ও ১৮টি মন্ত্রণালয় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। এখন আমাদের উচিত হবে নিরাপদ খাদ্যের মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার জন্য কৃষিবান্ধব নীতি-সহায়তা দেয়া এবং তার বাস্তবায়ন করা। এ উদ্যোগ কৃষক থেকে ভোক্তা সবার সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সম্ভব। তাহলেই জাতি হিসেবে আমরা এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সুস্থ-সবল হিসেবে বেড়ে উঠবে; ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের বিপরীতে টিসিবি অথবা অন্য কোন উপায়ে পণ্যের সরবরাহ বাড়ালে দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে। পেঁয়াজ, আলু, আদাসহ বেশ কয়েকটি পণ্য আছে, তা পচনশীল। এগুলো বেশিদিন ধরে রাখা যায় না। ফলে বিকল্প উপায়ে সরবরাহ বাড়লে এমনিতে ব্যবসায়ীরা পণ্য ছেড়ে দেবে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার রক্ষায় বিভিন্ন আইন আছে এগুলোও বাস্তবায়ন করতে হবে। পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখার পাশাপাশি যাতে কেউ কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করতে না পারে, সে বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ ক্রেতার সাধ্যের মধ্যে রাখতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

Check Also

প্রত্যেকটা অফিসের কেরানি পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের দোসর : আসিফ মাহমুদ

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।