গণতন্ত্র নীরবতাকে ঘৃণা করে!

৬ই ডিসেম্বর, ১৯৯০। আনন্দ-বেদনার অদ্ভুত এক দিন। মিলন, নূর হোসেন। নাম জানা-অজানা। কত মানুষের জীবনের বিনিময়ে আসা দিন। দিনটি এলেই আলী আকবরের কী যেন হয়! ভীষণ অস্থিরতা। মনে হয় এইতো সেদিনকার ঘটনা। চোখের সামনে যেন সবকিছু দেখতে পায় সে! ঢাকা ছিল উৎসবের নগরী।

মানুষের মনে ছিল আনন্দ, যন্ত্রণা আর আশার অন্যরকম এক মিশেল।

এতোদিন পর জলডাকা গ্রামে বসে আলী আকবর হিসাবের খাতা উল্টায় । বয়স হয়েছে। শরীরটাও ভালো নেই। সময়টা ছিল তখন অন্যরকম। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া টগবগে তরুণ আলী আকবর। কৃষকের সন্তান। ভাগ্য বদলাতে এসেছিল ঢাকায়। অর্থনীতি বিভাগের ক্লাস রুমে বসে প্রখ্যাত শিক্ষকদের লেকচার শুনে। আগে যাদের লেখা পত্রিকায় পড়তো সে। মনে উঁকি দেয় নানা স্বপ্ন। হঠাৎ হঠাৎই কানে আসে স্লোগান। এরশাদের পতন চায় একদল তরুণ। আকবর রাজনীতি ওতোটা বুঝে না। এস এম হলে রুমমেটদেরও সে মাঝে মাঝে এ নিয়ে আলাপ করতে দেখে। অবশ্য তখনো ওতোটা প্রকাশ্যে নয়। সরকার দলীয় ছাত্রদের লাল চোখের খবরদারি। স্বাধীন দেশেও যেন তারা পরাধীন। পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। ধীরে ধীরে ফুসে উঠে মানুষ। অগ্রভাবে তরুণরা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। ঢাকার রাস্তা প্রকম্পিত করেন তারা। ফ্রন্ট আলাদা। তবে প্রায় সব প্রধান রাজনৈতিক দলই ডাক দেয় আন্দোলনের। ময়দানে দুই নেত্রী। এইসব দেখে আলী আকবরও স্থির থাকতে পারে না।

একদিন মিছিলে শামিল হয় সেও। জীবনটা তার একদম বদলে যায়। অবশ্য তখনই সবকিছু শেষ হয়ে যেতে পারতো। গুলিটা ডা. মিলনের বুকে না লেগে তার বুকেও লাগতে পারতো। স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক- শুধু নূর হোসেন নয়, নূর হোসেনের সেই চাওয়াটাকেও হত্যা করতে চেয়েছিলেন এরশাদ। কিন্তু তাতো আর হওয়ার নয়। প্রায় সব স্বৈরশাসকের যে পরিণতি হয় এরশাদকেও তা বরণ করতে হয়। কিন্তু বহুজীবন, সংসার তছনছ হয়ে যায় ইতিমধ্যে।

অবশেষে সেই দিন এলো। উৎসবের দিন, আনন্দের দিন। আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো সেই অমোঘ স্লোগান কার্যকরের দিন। স্বাধীনভাবে মানুষ তারা নেতা নির্বাচনের অধিকার ফিরে পেলো। ক’দিন আগে লেখক আশীফ এন্তাজ রবীর একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস আলী আকবরের মনে দাগ কাটে। তিনি লিখেছেন, ‘গোলাপ, রজনীগন্ধা কিংবা শিউলি নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ফুলের নাম- গণতন্ত্র।’ গণতন্ত্রে ফেরার দিনগুলোতে এ যে কত বড় সত্য ছিল। প্রাণবন্ত এক সংসদের জন্ম। ওয়াক আউট, বিতর্ক। যদিও অসংগতিও কম ছিল না।  স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা একদল ছাত্র নেতা দ্রুতই সম্পদশালী হতে থাকেন।

সেই যাই হোক পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে ক্রমশ। গণতন্ত্রের মহান মূল্যবোধ জাতীয় ও ব্যক্তিজীবনে প্রতিষ্ঠা পায়নি মোটেও। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও রাজনীতির ময়দানে জায়গা পান। পতিত স্বৈরশাসকের বিস্ময়কর উত্থানের কাহিনী। তাকে নিয়ে টানাটানি চলে বিস্তর। ভোটারদের একদিনের বাদশাহী অবশ্য তখনো ছিল। তারা মোটামুটি স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারতেন।  হরতাল-অবরোধ-বাসে আগুন সব চলে নিয়মিতই। ইতিহাসের এক প্রেক্ষাপটে আসে ওয়ান ইলেভেন। এরপর আবার নতুন অধ্যায়।

আজ ৬ই ডিসেম্বর, ২০২০। রাজধানী ঢাকা থেকে বহুদূরের এক গ্রামে বসে আলী আকবর দেখে গণতন্ত্র নিয়ে তেমন কোনো বাতচিৎ নেই। না শহরে, না গ্রামে। উন্নয়নের কথাই শোনা যায় বেশি। সেদিনের কথা যেন সবাই ভুলে গেছে। মানুষ ভুল করে কোনো কিছু করে এবং ভুল করে যে করেছিল পরে তাও ভুলে যায়- জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিটশের কথাটা আলী আকবরের খুব প্রিয়। তবে কী সে ভুল করে যোগ দিয়েছিল গণতন্ত্রের সংগ্রামে। তার কি অনুশোচনা করা উচিত? দু’ এক দিন আগেই বিবিসি বাংলার অনলাইনে সে একটি রিপোর্ট পড়ছিল। বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজ কীভাবে নীরব হয়ে গেছেন সে বয়ান। অথচ কে না জানে, গণতন্ত্র নীরবতাকে ঘৃণা করে!

Check Also

প্রত্যেকটা অফিসের কেরানি পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের দোসর : আসিফ মাহমুদ

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।