ক্রাইমবাতা ডেস্করিপোট: নানা স্বার্থের দ্বন্দ্বে সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী সংগঠনগুলোর মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি চরম আকার ধারণ করেছে। দুই গ্রুপের সিনিয়র নেতারা পৃথক শক্তিশালী বলয় তৈরি করে একে অপরের বিরুদ্ধে তোপ দাগছেন। পাল্টাপাল্টি অভিযোগের প্রধান বিষয় দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। ফলে কারও কারও দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত সম্পর্কেও বড় ব্যবধান তৈরি হয়েছে।
উভয় গ্রুপের নেতারা নিজেদের সরকার সমর্থক ও স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি দাবি করলেও বাস্তবে কেউ কারও যুক্তি ও তথ্য মানতে নারাজ। দশম গ্রেডের কর্মকর্তাদের জন্য যাতায়াতসহ চার ধরনের ভাতার দাবিতে সম্প্রতি ৮টি সংগঠনের নেতারা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দেয়ায় এই বিভক্তির বলিরেখা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে তির্যক ভাষায় বিষোদ্গার করা অব্যাহত রেখেছে। এমনকি নবগঠিত সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ পরিষদসহ কয়েকটি সংগঠনের কমিটি গঠনের বৈধতা নিয়েও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন সচিবালয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতারা। এদেরকে ভুয়া সংগঠনের নেতা আখ্যা দিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাতে আজ দুপুরে সচিবালয় সমবায় সমিতির হলরুমে জরুরি সভা আহ্বান করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঐক্য পরিষদের মহাসচিব ও স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুহুল আমীন এবং অতিরিক্ত মহাসচিব ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ‘অযোগ্যতা ও দুর্নীতির কারণে ঐক্য পরিষদে টিকতে না পেরে কতিপয় নেতা নামধারী কর্মকর্তা ও কর্মচারী এখন সচিবালয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদের বিরুদ্ধে পাল্টা সংগঠন দাঁড় করানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত সফল হবে না। রোববারের মিটিং থেকে তাদের সমুচিত জবাব দেয়া হবে।’ তারা বলেন, ‘শুধু প্রতিহিংসার কারণে চক্রটি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বার্থবিরুদ্ধ কাজ করেই যাচ্ছে। ফলে ন্যায্য দাবি আদায়ের পরিবর্তে উল্টো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যেমন, এওপিওদের দশম গ্রেড থেকে নবম গ্রেডে উন্নীত করার দাবি নিয়ে আমরা যখন বাস্তবায়নের পথে অনেকটা অগ্রসর হয়েছি, তখন তারা এটাকে বাধাগ্রস্ত করতে পরিকল্পিতভাবে গত সপ্তাহে এই গ্রেডের কর্মকর্তাদের জন্য কয়েকটি ভাতার দাবিকে সামনে এনেছেন। অথচ এসব দাবি উত্থাপনের এখন কোনো প্রয়োজনই নেই। কেননা, নবম গ্রেডে উন্নীত হলে ভাতার দাবি এমনিতে পূরণ হয়ে যাবে। বরং এওপিওদের দীর্ঘদিনের এই দাবি পূরণ হলে তাদের মর্যাদা আরও সমুন্নত হবে। কিন্তু এসব করে প্রকারান্তরে তারা ষড়যন্ত্রের দেয়াল তৈরি করেছেন। এজন্য কুচক্রী মহলের বিষয়ে সাধারণ কর্মচারীদের সব সময় সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে রুহুল আমীন যুগান্তরকে বলেন, ওনারা নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি দাবি করে থাকলে তাদের সংগঠনে কতজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আছে, সেটি আগে দেখাক। কিন্তু আমরা জানি, তাদের সঙ্গে কারা আছে। মূলত রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চক্রটি সচিবালয়ের মধ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়।
অপরদিকে সচিবালয় কর্মজীবী কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা গোলাপ মিয়া শনিবার এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরাই সচিবালয়ে প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার সপক্ষের সংগঠন। গঠনতন্ত্রসহ সব ধরনের নিয়মকানুন মেনে দীর্ঘদিন থেকে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি। কিন্তু যারা তাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন, তারা সচিবালয় বহুমুখী সমবায় সমিতিকে পুঁজি করে এক যুগ ধরে লুটপাট করে যাচ্ছেন। তাদের এক নেতা তো একাই তিন সংগঠনের পদ দখল করে আছেন।’ তিনি বলেন, ওনারা সংগঠনের কোনো গঠনতন্ত্রই দেখাতে পারবে না। তাদের আসল উদ্দেশ্য হল, সমবায় সমিতির চেয়ার আঁকড়ে ধরে বিশেষ ফায়দা নেয়া। এজন্য তারা নিজেদেরকে আওয়ামীপন্থী দাবি করে ইচ্ছেমতো পকেট কমিটি করে সমবায় সমিতিকে লুটেপুটে খাচ্ছে। এমনকি করোনা পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচন ছাড়াই গোপনে সমবায় সমিতির কমিটি করে নিয়েছে। তিনি বলেন, ওদের সময় শেষ। সাধারণ কর্মচারীদের স্বার্থপরিপন্থী কাজ করে এতদিন পার পেয়ে গেলেও ভবিষ্যতে তাদেরকে কেউ আর নেতা বলে মানবে না।’
সূত্র জানায়, সচিবালয়ে সরকারপন্থী দাবিদার কর্মকর্তা-কর্মচারী নেতারা স্পষ্টত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ায় এর সুযোগ নিচ্ছে বিএনপি ও জামায়াত সমর্থকরা। এতদিন তারা পর্দার আড়ালে সক্রিয় থাকলেও কেউ কেউ এখন সামনে আসার চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যে অনেকে রাতারাতি সাইনবোর্ড পাল্টে সরকারপন্থীদের দলে ঢুকে পড়েছেন। বাকিরা জায়গা করে নিয়েছেন মন্ত্রণালয় ও বিভাগভিত্তিক কল্যাণ ফোরামে। মূলত সচিবালয় প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক আগে থেকেই বিএনপি ও জামায়াতপন্থীদের নীরব প্রভাব বজায় রয়েছে। বর্তমান সরকার দীর্ঘদিন থেকে ক্ষমতায় থাকায় দৃশ্যত সবাই এখন আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে। অনেকটা পানির রঙের মতো। কাউকে চেনার উপায় নেই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আবার অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা যাচ্ছে, যারা প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী পরিবারের কর্মকর্তা-কর্মচারী, তাদের মূল্যায়ন সেভাবে হচ্ছে না। মাঠের রাজনীতির মতো প্রশাসনও হাইব্রিডদের দখলে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা পদোন্নতি ও প্রাইজপোস্টিংয়ে এগিয়ে রয়েছেন। যুগান্তরের কাছে এমন সব ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন কর্মচারী নেতাও।
দুই সমিতির কমিটি গঠন : গত সপ্তাহে সচিবালয় সাঁটমুদ্রাক্ষরিক ও কম্পিউটার অপারেটর সমিতির নতুন কমিটি গঠন করা হয়। ৩ বছরের জন্য এই কমিটির সভাপতি হয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের মহিবুল্লাহ এবং সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের রেজাউল ইসলামকে। ৩৫ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নজরুল ইসলাম ও যুগ্ম সম্পাদক হয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটার অপারেটর হামিদা মুক্তি প্রমুখ। অপরদিকে সচিবালয় অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক সমিতির ৩ বছরের জন্য সভাপতি হয়েছেন আইন মন্ত্রণালয়ের মাসুদুর রহমান এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের শামীম মোড়ল সাধারণ সম্পাদক। ২৯ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে রবিউল ইসলামকে।
অফিস সহায়কদের দাবি : অফিস সহায়ক থেকে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পদোন্নতির জন্য টাইপিং গতি পরীক্ষা শিথিল করার দাবি জানিয়েছে সচিবালয়ে কর্মরত অফিস সহায়করা। বাংলাদেশ সচিবালয় ১৬-২০ গ্রেড সরকারি কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল হালিম মিয়া যুগান্তরকে বলেন, নতুন নিয়োগবিধি অনুযায়ী টাইপিং পরীক্ষা দিতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে টাইপের গতি প্রতি মিনিটে ২০ থাকার শর্ত শিথিল করতে হবে। তিনি বলেন, নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে এই শর্ত রাখা যেতে পারে। কিন্তু পদোন্নতির ক্ষেত্রে এটি থাকা সমীচীন নয়। কারণ প্রতিদিনের দাফতরিক কাজের চাপে অফিস সহায়কদের অনেকের পক্ষে টাইপিংয়ে সময় দেয়া খুবই কঠিন।